বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কিউবিকল ও চেয়ার: ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ববাদ

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ১২ মে, ২০২১ ১৩:৫২

সরকারপ্রধানগণ সাধারণত সুইভেল বা ঘূর্ণি চেয়ার ব্যবহার করেন না। তারা সাধারণত মেটাল, কাঠ বা কাঠ-মেটালের সমন্বয় তৈরি চেয়ার ব্যবহার করেন। তাদের চেয়ারের পেছনের অংশ মাথা ছাপিয়ে ওঠে না। কারণ, তারা হয়ত বুঝে গেছেন চেয়ার কোনো অংশই মাথার উপরে উঠতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাসায় খুব সাধারণ মানের কাঠের তৈরি হাতলওয়ালা চেয়ার ব্যবহার করতেন।

অফিস পরিসরে কিউবিকল ও নতুন অবয়বের চেয়ার কর্পোরেটাইজেশনের সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে দৃশ্যমান হচ্ছে। কিউবিকল ও চেয়ারের সাইজ, ডিজাইন ও সুবিধা-অসুবিধা বুঝিয়ে দিচ্ছে অফিসে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব কীভাবে বণ্টিত হচ্ছে। এগুলো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পরিমাপের স্মারক হয়ে উঠছে। কিউবিকল ও চেয়ারকে কেবল বিভিন্ন ম্যাটেরিয়ালের সমষ্টি ভাবলে ঠিক হবে না। যদিও অনেকে এগুলো অধিকতর আরামদায়ক ও কর্মপোযোগী অফিস পরিবেশের সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করেন। বিশ্বাস করেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা বা একান্তে কাজের জন্য কিউবিকল সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

অফিস পরিসরে কিউবিকল ও চেয়ার ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ রয়েছে। বিশেষত ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও অধস্তন মনোকাঠামো বিশ্লেষণে এ দুটি উপকরণ বিশেষভাবে সহায়ক।

প্রথমেই কিউবিকল প্রসঙ্গে আসা যাক- পশ্চিমাকরণ ও বৈশ্বিক পুঁজি ব্যবস্থার প্রভাবে সরকারি বা বেসরকারি অফিসগুলো বিশেষ রূপ ধারণ করছে। অফিস পরিসরের ডিজাইন বদলে যাচ্ছে। অফিস স্পেস মেপে মেপে খণ্ড খণ্ড করে কর্মীদের জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে। অফিস ব্যবস্থাপকরা এখন কেবল কর্মদায়িত্ব বণ্টন করেন না, অফিস পরিসরও ভাগবাটোয়ারা করেন। এ জন্য তারা পূর্ণ স্বত্ববানও বটে, যা অফিসের অভ্যন্তরে বিভক্তি বা খণ্ডিকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে।

কর্তাব্যক্তিগণ অফিসে গ্রুফওয়ার্ক, টিমস্পিরিট ও যৌথ উদ্ভাবনের কথা বলেন। অপরদিকে, কর্মীদের কবুতরের খোপে ঢোকার ব্যবস্থা করেন।

একটি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় দেখেছি চিফ অব পার্টি (প্রকল্প ব্যবস্থাপক) একজন সহকর্মীকে বিরক্ত হয়ে বলছিলেন- সারাদিন কবুতরের খাঁচার ভিতরে মাথা গুঁজে কী করেন? অর্থাৎ তিনি এ অফিস বিন্যাস ভেতর থেকে মেনে নিতে পারেননি। এ আধুনিক অবয়বের প্রতি প্রত্যাখ্যান রয়েছে। তবে দ্বিচারিতা বাঙালি স্বাভাবের মৌলিক দিক। ঐতিহ্যের প্রতি যেমন রয়েছে গভীর অনুরাগ অপরদিকে রয়েছে অনুকরণপ্রিয়তা।

পশ্চিমা সংস্কৃতি সামগ্রিক জীবনকে প্রভাবিত করছে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে বাড়ি ও অফিস ডিজাইন সবকিছু তাদের অনুকরণেই হচ্ছে। একসময় বাড়ি থেকে দূরে অবস্থিত শৌচাগার কত সহজেই অ্যাটাচ টু দ্য বেড হয়ে গেল।

অফিসের সংস্কৃতি সহনশীল অবয়বগুলো হারিয়ে গেল। সবকিছুর ভেতর জমকালো ব্যাপার, দেখানোর ব্যাপার ঢুকে পড়ল। পরিবর্তিত এ অফিস বিন্যাসে সেবাগ্রহীতা স্বাছন্দ্যবোধ করেন না। একধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেন, যা তাদের মধ্যে শক তৈরি করছে।

অফিসকর্মী হিসেবে যে কেউ থাকবে, হবে দ্বিমুখী অবস্থায়। একদিকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করার প্রেরণা, অপরদিকে কিউবিকলের বিচ্ছিন্নকরণ।

নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ‘দ্য বেস্ট প্রফেশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রবন্ধে সাংবাদিকদের জন্য কিউবিকল নির্ভর কর্মপরিবেশকে টয়েল ইন আইসোলেশন অর্থাৎ খাটুনির জন্য এক নিঃসঙ্গ খোপ হিসেবে উল্লেখ করেন।

অফিস ব্যবস্থাপকরা যদি অফিসের ডিজাইনগত পুনর্বিন্যাসের জন্য কোনো ইনটেরিওয়র ডিজাইন হাউসের সঙ্গে একবার বসেন তাহলে তার আর নিস্তার নেই। থ্রিডিসহ এমন বর্ণিল ডিজাইন তুলে ধরবে যাতে অফিস ব্যবস্থাপকদের মনে হবে তারা যথেষ্ট আধুনিক কর্মপরিবেশে কাজ করেন না। অফিস ব্যবস্থাপকগণ কিছুটা হতাশ হয়ে পড়বেন।

ডিজাইন হাউজগুলো দক্ষতার সঙ্গে কিউবিকলসহ আরও অনেক নতুন বিষয়ের চাহিদা তৈরি করবে, যা অফিস ব্যবস্থাপকদের আগে জানাও ছিল না। এভাবে অফিস ব্যবস্থাপকেরা সুন্দর ও অধিকতর কার্যকর কর্মপরিবেশের নামে দীর্ঘমেয়াদি এক চাহিদার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবেন। এগুলো সময়ান্তর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হবে। খরচ বাড়বে।

কিউবিকল সংস্কৃতির রয়েছে এক রাজনৈতিক অর্থনীতি। প্রচলিত অফিস ফার্নিচারগুলো বদলে নতুন উপকরণ দিয়ে অফিসগুলো সাজানো হচ্ছে, যা মোটেও সস্তা কর্মযজ্ঞ নয়। এসব উপকরণ তৈরি ও সরবরাহের জন্য গড়ে উঠছে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। অসংখ্য ইনটেরিওয়র ডিজাইন হাউজ। গড়ে ওঠছে বিশাল বাজার।

সমবেত উদ্যোগে অফিসগুলোর ভেতর দেয়াল তোলার প্রক্রিয়া গতিশীল হচ্ছে। বসানো হচ্ছে মাথা বরাবর কিউবিকলের কাঠামো আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য ঘোলা কাচের দেয়াল ও সাধারণ কাচের দরজা। ঘরের ভেতর অনেক ঘর। ঘোলা কাচের দেয়ালসর্বস্ব অফিস কর্মপরিবেশকে অধিকতর ঘোলা করে তুলছে। অফিস সাজানো প্রতিযোগিতা এত তীব্র হয়েছে যে, সরকারি ও বেসরকারি অফিস একই রূপ ধারণ করছে। সরকারি অফিস ডিজাইন কীভাবে হবে, কী উপকরণ দিয়ে হবে? কত টাকা খরচ করা যাবে? তার কি কোনো সরকারি নির্দেশনা রয়েছে?

কিউবিকল-নির্ভর অফিস পরিচালন অফিস পলিটিক্সকে প্রমোট করছে। অর্থাৎ অফিস পরিসরের সব জায়গায় সমান আলো-বাতাস বা টয়লেট সুবিধা থাকে না। অফিসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের সঙ্গে যাদের সখ্য তারা অধিকতর ভালো কিউবিকল পান। একে ঘিরে সহকর্মীদের ভেতর চাপা অসন্তোষ তৈরি হয়। তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষোভ। এক আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সময় দেখেছি এক সিনিয়র কলিগের জন্য যে কিউবিকলটি বরাদ্দ করা হয়েছিল তাতে এসির বাতাস লাগতো সরাসরি এবং তা লাগত মাথায় পেছনে। অথচ অপেক্ষাকৃত ভালো কিউবিকল পেয়েছিলেন প্রজেক্ট ম্যানেজারের অফিস সহকারী।

পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের অফিস কাঠামো, ব্যবস্থাপনা বা কর্মপরিবেশ এক নয়। আমরা অতিদ্রুত কিউবিকল সংস্কৃতির ভেতর ঢুকে পড়লাম। কাচ, মেটাল আর আর্টিফিশিয়ার উপকরণে অফিস ভরে ফেললাম। আমরা যে নিজেদের মতো করে অফিস সাজাতে পারতাম না, তা তো নয়। নিরপেক্ষ ও উৎপাদনশীল কর্মপরিবেশের জন্য উপযুক্ত বিন্যাস কী হবে তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আলো, বাতাস ও স্বাস্থ্যগত দিক উপেক্ষিত হলো। অনুকরণে গেলাম। বৈশ্বিক অফিস ব্যবস্থাপনার অংশ হয়ে উঠতে উঠেপড়ে লাগলাম। তা করলাম নির্বিচারে জনগণের টাকা খরচ করে।

এবার আসা যাক চেয়ার প্রসঙ্গে- চেয়ার ক্ষমতার সূচক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে অফিস পরিসরে। অফিসগুলোতে নানা ধরনের নানা সুবিধা চেয়ারের ছড়াছড়ি। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার দুঃখ করে বলেছিলেন- একটা টেবিল, একটা চেয়ার এবং ফলের ঝুড়ি, একটা ভায়োলিন- একজন মানুষকে সুখী হওয়ার জন্য আর কী কী দরকার? সত্যি তো চেয়ারগুলো হয়ে উঠছে সুখী হওয়ার উপায়। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে বোঝাপড়ার ভিন্ন সূচক।

চেয়ার দায়িত্ববোধ, রুচি, সংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। চেয়ারকে নিছক চেয়ার হিসেবে দেখলে হবে না। চেয়ারগুলোর মধ্যে কী কী অর্থ লুকিয়ে আছে তা দেখতে হবে নিবিড়ভাবে। এ লেখাটি তৈরির উদ্দেশ্যে পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন পাবলিক ফিগারগুলোর ব্যবহৃত চেয়ারের ডিজাইনগত দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেমন. আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, কানাডা ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত চেয়ারগুলোর আকার ও ডিজাইনের ভাবগত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশে অফিস পরিসরে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারের আকার ও ডিজাইনের ভাবগত অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, কানাডা ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত চেয়ারগুলোর আকার ও ডিজাইনের মধ্যে একটি যৌক্তিক ও সহনশীল অবয়ব লক্ষ করা গেছে। এ চেয়ারগুলো আকার ও ডিজাইনের মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়নি। ব্যবহৃত চেয়ারগুলো বিভক্তির সূচকও নয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কীভাবে সহনশীল উপায়ে ব্যবহৃত আর্টিফেক্টগুলোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় তার মান উদহারণ মনে হয়েছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশে অফিস পরিসরে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারের আকার ও ডিজাইনের ভাবগত অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এগুলো হলো- ক্ষমতার বিচ্ছুরক, অনেকক্ষেত্রে অস্বাভাবিক আকার ও ডিজাইন; ক্ষমতার স্তরবিন্যাস পরিমাপের বিশেষ সূচক; অধস্তন মানসিকতার বস্তুগত প্রকাশ; ম্যানিফ্যাকচারেরা নিপুণভাবে চেয়ারের ডিজাইন ও আকারের মধ্যে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সেক্সের মিশেল ঘটিয়েছেন; চেয়ারগুলো ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্যোতক।

একটি কথা চালু রয়েছে-সুইভেল বা ঘূর্ণি চেয়ারে বসে কোনো ভালো কাজ বা সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। চেয়ারগুলোর অবয়ব বিশ্লেষণের সময় দেখা গেছে সরকারপ্রধানগণ সাধারণত সুইভেল বা ঘূর্ণি চেয়ার ব্যবহার করেন না। তারা সাধারণত মেটাল, কাঠ বা কাঠ-মেটালের সমন্বয় তৈরি চেয়ার ব্যবহার করেন। তাদের চেয়ারের পেছনের অংশ মাথা ছাপিয়ে ওঠে না। কারণ, তারা হয়ত বুঝে গেছেন চেয়ার কোনো অংশই মাথার উপরে উঠতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাসায় খুব সাধারণ মানের কাঠের তৈরি হাতলওয়ালা চেয়ার ব্যবহার করতেন।

বলা হয়, সেই চেয়ার সবচেয়ে উত্তম যে চেয়ারে অন্যকে বসার জন্য অনুরোধ করা যায় এবং যাকে অনুরোধ করা হয় তিনি সেই চেয়ারে বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অফিস পরিসরে কিউবিকল ও চেয়ারের পুনর্পাঠ নতুনভাবে অনুভূত হচ্ছে।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর