বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট: সামনে আরেক কঠিন চ্যালেঞ্জ

  • ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ   
  • ১২ মে, ২০২১ ১২:৩৪

শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এরইমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অতিসম্প্রতি ভারতফেরত যাত্রীদের মধ্যে আটজনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়, এদের মধ্যে দুইজনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং সরকারের এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।

নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্ট সামাল দিতে ভারত বর্তমানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে এক ভয়াবহ ও মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়ে সারা বিশ্বের সংক্রমণের এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট দায়ী বলে জানিয়েছে দেশটি।

গত মার্চে প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়। দেশটির ধারণা দেশে করোনার যে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে এর পেছনে রয়েছে এই শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট। ডবল মিউট্যান্ট এই ভ্যারিয়েন্টের নাম দেয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। দেশটির একাধিক রাজ্যে এই ভ্যারিয়েন্টের উচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও এর গবেষকরা এখনও দ্বিতীয় ঢেউ ও নতুন ভ্যারিয়েন্টের মধ্যেকার সম্পর্কের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন।

নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিষয়ে নিশ্চিত হতে বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতীয় গবেষকরা। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনা ১৩ হাজার নমুনা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এর মধ্যে ৩ হাজার ৫০০টিই নতুন ভ্যারিয়েন্টের। দেশটির ৮ রাজ্যে এর উপস্থিতি নিশ্চিত। এগুলোর মধ্যে কটি হচ্ছে- মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট ও ছত্রিশগড়। এর আগে ভারত দাবি করে আসছিল যে, ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্টের কোনো সম্পর্ক নেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট আর নতুন ঢেউয়ের আঘাতে সমস্ত ভারত আজ টালমাতাল ও বেসামাল অবস্থা।

এ মুহূর্তে ভারতের করোনার তিনটি ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617, B.1.617+S:V382L এবং B.1.618) নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মারুফুর রহমান অপু বলেন, B.1.617 এটাকে বলা হচ্ছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টে তিনটি মিউটেশন অব কনসার্ন আছে। যেগুলোতে ইমিউন এসকেপ (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দেয়া, বেশি ইনফেক্টিভিটি (সংক্রমণ) এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত।

দিল্লিতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ ডাইন্যামিকস, ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. রামানান লক্ষ্মীনারায়ণ জানিয়েছেন, এই মাপের মানবিক বিপর্যয় তিনি তার জীবনে আগে দেখেননি। ‘হাসপাতালে মানুষ শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এ ঘটনা তো অত্যন্ত দরিদ্র দেশে হয়। এই ট্র্যাজেডি ঘটছে দিল্লির মতো শহরে। গ্রামাঞ্চলে মানুষের পরিণতি তাহলে কী হচ্ছে অনুমান করতে পারেন!” মৃত্যু, অনিশ্চয়তা আর অশুভ হতাশা মিলে ভারতীয় জনগণ এখন দিশেহারা। করোনার নিষ্ঠুর থাবায় ভারতের অসহায়ত্বে প্রতিবেশী দেশ যেমন- নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়ছে।

ভারতের করোনা এ ভ্যারিয়েন্ট সকল রাজ্যগুলোতে দ্রুত বিস্তার ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংক্রমণ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু দুটোই হু হু করে বাড়ছে। দেশটির মহামারি এখন পুবদিকে এগোচ্ছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করে দিয়েছে। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, ঝাড়খন্ড ও বিহার- পূর্ব ভারতের এই পাঁচটি রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আপৎকালীন বৈঠকের পরই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এ মন্তব্য করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই রাজ্যগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। দক্ষিণ, পশ্চিম বা উত্তর ভারতের তুলনায় পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি এতদিন কিছুটা ভালো ছিল। রাজ্যগুলোতে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, যেমন বাড়ছে মৃত্যুহারও।

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অবাধে নেপালে ছড়িয়ে পড়ার কারণে নেপালে ক্রমশ করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে ধাবিত হতে চলেছে। এ ক্ষেত্রে ভারত থেকে নেপালে অবাধে যাতায়াত, ভারতে কাজ করা নেপালি শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার বিষয়গুলোও রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের মতো করোনা বিপর্যয়ের মুখে নেপাল। সংকট মোকাবিলায় দেশটির সরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলে সংক্রমণের মাত্রা অনেক বেড়েছে। এই এলাকাগুলোতে সংক্রমণের হার ৪৭ শতাংশ।

এই পরিস্থিতিতে দেশটিতে একদিকে দেখা দিয়েছে টিকার সংকট অপরদিকে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। চলতি সপ্তাহে তিনি টিকার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন। টিকাদান কর্মসূচিতে সরকারের বিশৃঙ্খলার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে নাগরিকদের। এভাবে আরও ভাইরাস বিস্তার ঘটাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

নেপালের বিষয়টি আমাদের জন্য এক সকর্তবার্তা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ১৮টি স্থলবন্দর ও দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা। এর মধ্যে কোনোটি পুরোপুরি বন্ধ, কোনোটিতে শুধু পণ্য পরিবহনের সুযোগ রাখা হয়েছে, আবার কোনো কোনোটি দিয়ে জরুরি কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিরা দেশে আসার সুযোগ পাচ্ছে। এই সুযোগ নিয়ে প্রতিদিনই শত শত যাত্রী ভারত থেকে দেশে ঢুকছে। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বৈধভাবে আসা এসব যাত্রী ছাড়াও অবৈধভাবে বিভিন্ন সীমান্ত হয়ে প্রতিদিনই আরও কিছু মানুষ দেশে ঢুকছে যা হয়তো আমাদের অজানা। যদিও আমাদের সীমান্ত এখন কড়াকড়িভাবেই বন্ধ করা আছে। যারা ফিরছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনও বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। তবু চারদিকে ভারত সীমান্তবেষ্টিত হওয়ায় বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট খুব সহজে দেশে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা কোনো এক অসতর্ক মহূর্তের জন্যই মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এরইমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অতিসম্প্রতি ভারতফেরত যাত্রীদের মধ্যে আটজনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়, এদের মধ্যে দুইজনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে বলে জানানো হয়। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং সরকারের এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।

ভারতে করোনাভাইরাসের ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়্যান্ট’-এর কথা। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির অন্তত চারটি রাজ্যে এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। বাকি রাজ্যগুলো হচ্ছে দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও ছত্রিশগড়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি নতুন এই ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণের ক্ষমতা তিন গুণ বেশি। নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো লাগাম পরানো না গেলে এবার সংক্রমণের সুনামি ঘটবে। ভারত থেকে যাতে দেশে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে, সে জন্য ২৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশও ভারতের সঙ্গে স্থলপথে যাতায়াত বন্ধ করেছে। তবে বিভিন্ন পণ্যবাহী পরিবহনে আমদানি-রপ্তানি চালু থাকায় পরিবহন শ্রমিকদের মাধ্যমে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনে ভারত থেকে দেশে প্রবেশকারীরাও সংক্রমণ ছড়ানোর হুমকি হয়ে উঠেছে।

চলমান লকডাউনে একটু শিথিলতায় ঈদে দোকানপাট ও শপিংমলে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের যেভাবে উপচেপড়া ভিড় এবং ঘরমুখো মানুষের বাঁধভাঙা তীব্র জনস্রোত দেখা গেছে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি অনেকটা ভেঙে পড়েছে। সচেতন নাগারিক হিসেবে আমাদেরকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমাদের বাইরে বের হওয়া ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। সবাইকে সরকারি নির্দেশনা মানতে হবে। সবাইকে মাস্ক ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে কারণ একমাত্র মাস্কই পারে করোনার বিরুদ্ধে ৯০-৯৫ ভাগ রুখে দিতে। ভারতের মতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার আগে সরকারকে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে করোনাকে মোকাবিলা করতে হবে।

আমাদের সিংহভাগ জনগণ এখনও ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে, অপরদিকে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে ঢুকে পড়েছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতির নিরিখে সরকারকে প্রয়োজনে সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনে যেতে হবে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য ও অক্সিজেন মজুদ করে রাখতে হবে। বিশেষ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চীন, রাশিয়া ও বিকল্প উৎস থেকে ভ্যাকসিন এনে সিংগভাগ জনগণকে টিকার আওতায় আনতে হবে। তাহলেই হয়তো এ অতিমারির বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব।

আমরা দেখেছি করোনার ঊর্ধ্বগতি সংক্রমণে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ তো দূরের কথা, সাধারণ বেডই পাওয়া দুষ্কর, সেখানে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়লে আমাদের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা কিছুতেই সম্ভব হবে না। ভেঙে পড়বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির জন্য আমাদেরকে মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে।

লেখক: গবেষক-কলাম লেখক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি

এ বিভাগের আরো খবর