করোনা মহামারি নাকি অতিমারি এই বিতর্কে না জড়িয়েও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান সর্বগ্রাসী এই যুগে করোনার অভিঘাত বহুমুখী। মানুষে মানুষে অনাস্থা-অবিশ্বাস আর সর্বতো বিদ্যমান সচকিত সতর্কতা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সামাজিকতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম পর্যন্ত মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আজ নেহাতই বাক্সবন্দি ভার্চুয়াল জগতে।
মুখে মাস্ক পরে মুখোশের আড়ালে মনের যাবতীয় ভাবভঙ্গি সুকৌশলে গোপন করা গেলেও জীবনের বাস্তব সমস্যা-সংকট কি এত সহজেই আড়াল করা যায়? কিংবা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের যাবতীয় সংকট?
করোনা আমাদের সামনে উন্মোচিত করল বহুকিছু। আমাদের যাবতীয় গর্ব আর ঔদ্ধত্য যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিল এক করোনা। পরম ক্ষমতাধর দেশেও আমরা দেখছি অলঙ্ঘনীয় মৃত্যুর মহামিছিল। আর কমিউনিস্ট শাসিত চীনে যার উৎপত্তি সেই চীন রয়ে গেল মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় হিসাবের তলানিতে।
স্মরণযোগ্য কিউবা আর ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও। আমরা দেখছি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে খোদ রাজধানী থেকে শুরু করে একদিকে চলছে রাজ্যের পর রাজ্যে হাসপাতাল বেড, আইসিইউ আর অক্সিজেন সংকট। আর অন্যদিকে কমিউনিস্ট শাসিত কেরালা সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে নিজ রাজ্যের সংকট কাটিয়ে অন্য রাজ্যকে অক্সিজেন সরবরাহ করছে।
এই ঘটনা আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিল মানুষ বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন আর পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন আমাদের কোন পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত!
ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব-দুর্বৃত্তায়ন আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার এই দেশ ও জাতির কাঁধে করোনা যেন সিন্দাবাদের ভূতের মতো জেঁকে বসেছে।
বলা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি আমরা। তথাকথিত ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার’ দিকে ধাবিত হচ্ছে আগামী পৃথিবী। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই নাকি নিয়ন্ত্রণ করবে সবকিছু। আর তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তবে এই করোনাকালকেই কি ব্যবসায়ী প্রযুক্তিবিদেরা সেই পৃথিবীতে পৌঁছানোর ড্রেস রিহার্সালের সময় হিসেবে বেছে নিয়েছেন? কেননা করোনাই নিয়ে এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ (!) যা প্রায় এক ধাক্কাতেই মানুষকে ঠেলে দিয়েছে অমানবিক প্রযুক্তির যূপকাষ্ঠে।
আমরা এককালে পড়তাম ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ!’ তাই তো মানুষে মানুষে যে বন্ধন ছিল একসময় এই পৃথিবীর চালিকাশক্তি- তার জায়গায় প্রযুক্তির যাবতীয় আবিষ্কার ও আশ্রয় আজ মানুষে মানুষে সেই বন্ধন ও মানবিকতাকে যেন কোথায় কোন অতল গহ্বরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
করোনাকালের অব্যবহিত আগে অভিযোগ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হারিয়ে যাচ্ছে তারুণ্য, এমনকি শৈশব ও কৈশোর। সুতরাং আমাদের শিশুদের গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত মানুষ হিসেবে যাবতীয় ডিভাইস আর গেজেটের ঘেরাটোপ এড়িয়ে। এমনকি রেফারেন্স হিসেবে ভুল-শুদ্ধ হিসেবে হাজির হতো তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যার আবিষ্কারক রথি-মহারথিদের ভবিষ্যৎ বংশধররা নাকি প্রযুক্তিকে অধরা রেখেই বড় হচেছন অন্তত হাই স্কুলের সীমানা পেরুনো পর্যন্ত।
কাজেই এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না প্রকৃতির অমোঘ খেয়াল কিংবা মানবসৃষ্ট কোন অসাধ্য সাধনে আবির্ভাব এই করোনার! যদিও আমরা ক্ষমতার বাদানুবাদের জড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের পাল্টাপাল্টি প্রমাণ প্রদর্শন দেখেছি করোনার উৎপত্তি বিষয়ে। প্রকৃত তথ্য যেহেতু কখনোই উদ্ঘাটন সম্ভব না, বাতাসে ভেসে বেড়াবে আরও নানা মান-অনুমান।
কিন্তু করোনা যে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের অগ্নিতে ঘি ঢেলে যাচ্ছে সে কথা বলতে আজ কোনো দ্বিধা নেই। এমনকি যেই শিশুদের গেজেটমুক্ত রাখার প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আমাদের একসময়, সেই বাঁধও আজ ভেঙে গেছে।
শিক্ষার নাম করে আমরা তাদের গেজেট ডিপেন্ডেন্ট করে গড়ে তুলতে বাধ্য হচ্ছি। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নামে পৃথিবী উদ্ধারের যাবতীয় চেষ্টায় লিপ্ত আমরা অভিভাবকেরা নিজেরাও প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে তথাকথিত এই যুগের হাওয়াকেই বাতাস দিয়ে যাচ্ছি। করোনা মহামারির (যদি কখনো শেষ হয়) পর আরেকটা মহামারি হবে সম্ভবত গেজেট ডিপেন্ডেন্ট ভার্চুয়াল এইসব শিশুর প্রকৃত জীবন ও জগতে ফিরিয়ে আনতে!
করোনাকে সত্যি সত্যিই মহামারি বিবেচনা করে একে পজিটিভলি মোকাবিলা করার মাধ্যমে মানবিক পৃথিবী গড়ার কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করার এক অনাবিল সুযোগ আমরা হেলায় হারালাম। করোনা আমাদের সুযোগ দিয়েছিল আমাদের কর্মকাণ্ডগুলো পর্যালোচনার, অনেকটা পেছন ফিরে তাকানোর, প্রশ্ন করার- কোন পৃথিবী চাই আমরা? অথচ আমরা সেই সুযোগকে অধরা রেখে প্রবেশ করছি নিত্যনতুন ডাবল মিউট্যান্ট থেকে ট্রিপল মিউট্যান্ট করোনা সংক্রমণের ঢেউয়ে!
তাই মহামারি মোকাবিলার এই পর্যায়ে এই প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক, করোনা হতে বাঁচতে কোন পথে অগ্রসর হব আমরা- মানুষের বসবাসযোগ্যে মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলা, নাকি যন্ত্রনির্ভর এক আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া? আমরা নিজেরা না পারলেও ভবিষ্যৎই একমাত্র খুঁজে নেবে এই প্রশ্নের জুতসই উত্তর।
লেখক: উন্নয়নকর্মী