বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তুঙ্গের হেফাজত কেন এখন ধরাশায়ী?

  •    
  • ৯ মে, ২০২১ ১৭:১৪

এক সময়ের নিয়ন্ত্রণহীন হেফাজতে এখন কতটা দিশাহীন হয়ে পড়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। হেফাজত আগে কখনও নিজেদেরকে ক্ষমতায়, কখনও জামায়াত শিবিরের বুদ্ধি পরামর্শে দেশে যা ঘটাতে চেয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশি বিদেশি শক্তির শলাপরামর্শ এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হেফাজতে ইসলাম নিজেদেরকে অরাজনৈতিক একটি সামাজিক ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে দাবি করেছিল। এই সংগঠনে মূলত বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহের শিক্ষক জড়িত। আলিয়া কিংবা অন্যান্য ধারার মাদ্রাসার শিক্ষক এই সংগঠনের সঙ্গে ততটা যুক্ত নন।

মাদ্রাসা শিক্ষায় অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীলদের অবস্থান হচ্ছে কওমি মাদ্রাসায়। তাদের গঠিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মূলত সরকারের নারীনীতি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়ার বিরোধিতা করে এই সংগঠনের জন্ম হয়। সুতরাং, নিজেদের সংগঠনের অরাজনৈতিক চরিত্রের দাবি করা কতটা যৌক্তিক তা দেশের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

একদিকে তখন নারীনীতির বিরোধিতা করে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সরকার এবং নারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করেছিল, অপরদিকে গড়ে ওঠা এই সংগঠন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে যায়। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছিল হেফাজতেকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য নেপথ্যে জামায়াত এবং বিএনপি উদ্যোগ নেয়। হেফাজতের অবস্থান তখন সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের অধিকতর রক্ষণশীলতার পরিচয় প্রদান করে। দেশে তখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য আস্তিক-নাস্তিকের একটি ধোয়া রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। কয়েকটি গণমাধ্যম এবং জামায়াত ও বিএনপি এই প্রচারটি ছড়িয়ে দেয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন শাহবাগের আন্দোলনকারীদের প্রকাশ্যে নাস্তিক বলে দাবি করেন। আমার দেশ, নয়াদিগন্তসহ কটি পত্রিকা এবং দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিও শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকে।

মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য এই অপপ্রচারটি শাহবাগ আন্দোলনের তরুণদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হয়। গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে হেফাজতের নেতাকর্মীরাও যুক্ত হয়। তখন থেকে হেফাজতে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামায়াত ও বিএনপির পরামর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে। জামায়াত এবং বিএনপি বিচারের ট্রাইবুন্যালের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একই সুরে কথা বললেও, বিএনপির সব নেতাকর্মী এবং তরুণদের একটি বড় অংশই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে পারছিল না।

যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাড়া বিএনপির আর কেউ অভিযুক্ত ছিল না। বিএনপি যেহেতু নিজেদেরকে একটি গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে তাই বিএনপির নেতাকর্মীদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পক্ষাবলম্বন করে জামায়াত-শিবিরের মতো ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে মাঠে নামা, দৃষ্টিকটু ঠেকছিল। তবে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কখনও কখনও বক্তৃতায়, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই তবে, বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন’, আবার পরক্ষণেই মুজাহিদদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের মুক্তির দাবিও করেন। জামায়াত প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেও এটে উঠতে পারছিল না। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি তখন শুধু সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ একাই করেনি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং তরুণ প্রজন্মের বড় অংশও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। সেকারণে বিএনপির মধ্যে দোদুল্যমানতা ভর করে।

মাহমুদুর রহমান আমার দেশ নামক পত্রিকার মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসা, মতবাদ, ধর্মহীনতা ইত্যাদি প্রচার করতে থাকেন। তেমন পরিস্থিতে জামায়াত এবং বিএনপি হেফাজতেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণজাগরণ মঞ্চকে ঠেকাতে ব্যবহার করে। হেফাজতের মধ্যেও অনেক নেতা ছিলেন যারা ২০-দলীয় ঐক্যজোটের সদস্যদল বলে পরিচিত। রাজনৈতিকভাবেও তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদেরই কোনো না কোনো উত্তরাধিকার সংগঠন। ফলে হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার দাবি করে দেশব্যাপী প্রচারণায় নামে। এটি অনেকটাই তখন গণজাগরণ মঞ্চের পালটা শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে।

প্রথমত ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে। তাতে সারা দেশ থেকে কয়েক লাখ কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক লংমার্চ করে এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল হেফাজতের আন্দোলনের এক ধরণের স্টেজ রিহার্সাল। জামায়াত-বিএনপি হেফাজতেকে তখন সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা থেকে সংগঠিত হতে সাহায্য করে।

ওই বছরে ৫ মে হেফাজত ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর আগে হেফাজত ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোপন বৈঠক হয়। ৫ তারিখে ঢাকা অবরোধকে শাপলা চত্বরে নিয়ে আসা এবং বায়তুল মোকাররম, সচিবালয়, মতিঝিল এলাকার সকল ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি অফিস দখল করে ৬ মে তারিখ সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করা হয়। ওই সমাবেশে ৬ তারিখে বিএনপি এবং জামায়াত সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। এসবই ছিল গোপন পরিকল্পনা। তবে হেফাজতের প্রধান আল্লামা শফী এবং তার বেশ কিছু অনুসারী গোপন ষড়যন্ত্রের অনেক কিছুই জানতেন না। সরকার উৎখাতের বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের কয়েকজন জামায়াত বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে গোপন রেখেছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে হেফাজত একইভাবে সারা দেশ থেকে কয়েক লাখ কওমি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের ঢাকা অবরোধে অংশ নেয়ার নাম বলে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে তুলে নিয়ে এসেছিল।

সকালে এসব কওমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ঢাকার সবকটি প্রবেশমুখে চারদিক থেকে জড়ো হতে থাকে। এরপর বিভিন্ন দিক থেকে সমবেত নেতাকর্মী ঢাকার ভেতরে দলবেঁধে প্রবেশ করতে থাকে। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের এই পদযাত্রাকে ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তারা বিকাল ৫টা পর্যন্ত শাপলা চত্বরে দোয়া ও মোনাজাত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।

সরকার তাদেরকে তা করার অনুমতি দেয়। কিন্তু বিকাল গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতের নেতাকর্মীরা এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা পল্টন এলাকা, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডব চালাতে থাকে। গাড়ির ওপর নির্মিত মঞ্চে হেফাজতের নেতৃবৃন্দ সরকার উৎখাতের উত্তেজনাকর বক্তৃতা একের পর এক প্রদান করছিলেন। সেই মঞ্চে সংগঠনের প্রধান আল্লামা শফী সাহেব উপস্থিত ছিলেন না। তিনি সরকারের পরামর্শে সন্ধ্যার দিকে বিমানযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে যান। সন্ধ্যার দিকে চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছিল। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ঢাকাবাসীকে হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ হেফাজতের কর্মীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বোতল ও ড্রামভর্তি পানি বিতরণে নেমে পড়েছিলেন।

হেফাজত ৫টা পর্যন্ত শাপলা চত্বরে অবস্থানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। তারা একের পর এক উত্তেজনাকর বক্তৃতা প্রদান করে। ব্যাপক তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলা এরইমধ্যে সংগঠিত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বায়তুল মোকাররম এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন বইয়ের দোকান, কোরআন-হাদিসের বিক্রয়কেন্দ্র তাদের অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এসব চিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে সরাসরি দেখানো হচ্ছিল। ফলে ঢাকায় যে হেফাজত একটি বড় ধরনের তাণ্ডব করতে যাচ্ছে সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিকাল থেকেই হেফাজতের কর্মসূচি-গতিপ্রকৃতি লক্ষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিকাল ৫টার মধ্যে হেফাজতকে শাপলা চত্বর ত্যাগ করে চলে যাওয়ার দাবি জানান। এর অন্যথা হলে দায়দায়িত্ব হেফাজতকে নেয়ারও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু হেফাজত ওইসবে কান দেয়নি। তারা কওমি শিক্ষার্থীদের মতিঝিলে বসিয়ে রেখে নানা ধরনের বক্তৃতা দিয়ে চলছিলেন। আগে পরিকল্পনা ছিল এই অবস্থান গ্রহণটিকে সকাল পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া।

রাতের মধ্যেই জামায়াত-বিএনপি, হেফাজত সংগঠিত হয়ে ভোরবেলায় চূড়ান্ত পর্ব শুরু করা হবে। কিন্তু মধ্যরাতের আগেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকার পুবদিক খোলা রেখে বাকি দিকগুলো থেকে কামানের আওয়াজ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন শুরু করে। তা দেখে ও শুনে সবাই ঢাকার পুবদিকে পালাতে থাকে। এদেরকে ঢাকা থেকে অনেকটাই বের হয়ে যাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করা হয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। অধিকাংশই ছিল নিরীহ কওমি শিক্ষার্থী। হেফাজতের কর্মীদের অনেকেই সন্ধ্যার পরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পরদিনের প্রস্তুতিও কোথাও কোথাও নেয়া হচ্ছিল। মধ্যরাতেই তাদের স্বপ্নের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙে যায়। দেশ রক্ষা পায় এক ভয়াবহ ‘অভ্যুত্থানের’ হাত থেকে।

সেই সময় থেকে এবং পুলিশের রিমান্ডে থাকা কজন হেফাজত নেতা ৫ মের ষড়যন্ত্র এবং সরকার গঠনের পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন। এই বিবরণ থেকে যেটি স্পষ্ট তা হচ্ছে, হেফাজত নিজে জামায়াত এবং বিএনপির সঙ্গে মিলিতভাবে সরকার উৎখাতের যে পরিকল্পনাটি করেছিল, সেটি নিশ্চয়ই কোনো ধর্মীয় বিষয় ছিল না, ছিল সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ৬ তারিখ ভোরে যদি তাদের পরিকল্পনামতো কিছু ঘটানোর চেষ্টা করত তাহলে সরকারের আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা নিশ্চয়ই প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নিত।

সেক্ষেত্রে ঢাকায় কী পরিমাণ রক্তপাত ও প্রাণহানি ঘটত তা কল্পনা করতেও আমাদের আঁতকে উঠতে হয়। একটি বৈধ নির্বাচিত সরকারকে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজত যেভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল, সেটি কোনোভাবেই দেশ বা বিদেশে সমর্থন পাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আল্লামা শফী এবং হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সরকার গঠনের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল সেটি বিএনপি এবং জামায়াত কোনোভাবেই রক্ষা করত কি না সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে হেফাজতের ক্ষমতা দখলকারী সরকার আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের বার্তাই পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিত। সেই পরিস্থিতিতে দেশে যে নৈরাজ্য, রক্তপাত এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতো সেটি রাজনীতিসচেতন মানুষ নিশ্চয়ই বুঝতে ভুল করার কথা নয়।

হেফাজতের ৫ মের তাণ্ডব, পরিকল্পনা ও তাদের মদতদাতাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর দেশ-বিদেশে অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছিল। দাবি করা হয় কয়েক হাজার কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের হত্যা করে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, রাতের আঁধারে ভারতে গুম করা হয়েছে। এসব আজগুবি অপপ্রচার গিলে খাওয়া বা বিশ্বাস করার মতো মানুষের অভাব বাংলাদেশে নেই।

২০১৩ সালে ৬টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমন অপপ্রচারই হেফাজতের নেতাকর্মী ভোটারদের ঘরে ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকেই সাদা মনে ‘হুজুরদের’ বিশ্বাস করে ভোটও দিয়েছিলেন। ৬ সিটি কর্পোরশনে সরকারবিরোধী তথা বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। বিএনপির এই জয়ের পিছনে হেফাজতের নেতাকর্মীদের অবদান ছিল।

বাংলাদেশে ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার করে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন দুর্বল করা গেল, শাপলা চত্বরের ষড়যন্ত্রের ইস্যুটাকে ভুলভাবে মানুষকে ঘুরিয়ে নেয়া গেল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে কতটা নড়বড় হয়ে যেতে পারে তা হেফাজতের উত্থান তুঙ্গে ওঠা এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার নজির থেকেই বোঝা যায়। সরকার এসব অবস্থাগুলো বিবেচনায় নিয়েই হয়তো হেফাজতের প্রধান আল্লামা শাহ শফীর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় আশার উদ্যোগ নিয়েছিল। হেফাজতকে জামায়াত ও বিএনপির কোল থেকে নামিয়ে কিছুটা কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে। এতে তাদের কিছু দাবি মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট করা হয়।

সংগঠনের প্রধান যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন হেফাজত আর বেশি নড়াচড়া করেনি। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল হেফাজতের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির মিত্রশক্তি বলে পরিচিতরা নড়েচড়ে উঠতে শুরু করেছে। কারণ পেছনে আসল মিত্ররা কলকাঠি নাড়ছিল। সরকার উৎখাতে তাদের ধৈর্যধারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। শাহ শফীর মৃত্যুর পর পরই হেফাজতের আসল হেফাজতকারীরা আবির্ভূত হতে থাকে। তারা হেফাজতের একটি কমিটি গঠন করে।

হেফাজতের কজন নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে। দেশে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু করোনার সংক্রমণ এবং মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যস্ততায় এসব উত্তেজনা খুব বেশি হালে পানি পায়নি। বিএনপিসহ কিছু দল সরকার উৎখাতের দিন তারিখও ঘোষণা করেছিল। হেফাজত এবার সেই আয়োজন সম্পন্ন করতে পারেনি। ফলে ২০২০ সালের সরকার পতনের টার্গেট বাস্তবায়িত হয়নি। তবে তাতেই রণেভঙ্গ দেয়নি বিরোধীরা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ইস্যু করার একটি পরিকল্পনা ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়। বিএনপি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে দীর্ঘ তালিকার এক কর্মসূচি ঘোষণা করে। মার্চে দিন ধরে ধরে দিবস উদযাপন করতে থাকে। হেফাজত নরেন্দ্র মোদিকে প্রত্যাখান করে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দেশব্যাপী তাণ্ডব সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিল। কিছুটা সফল তারা হয়েওছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েক জায়গায় ভাঙচুর, তাণ্ডব ও ২৮ তারিখ হরতাল ডাকা হয়। বিএনপি নৈতিকভাবে এই হরতালকে সমর্থন দেয়। জামায়াত দৃশ্যত চুপচাপ ছিল কিন্তু ভেতরে ভেতরে অংশগ্রহণ করেছে।

আমাদের কিছু বাম ‘বন্ধু’ সংগঠন রয়েছে। তারা নরেন্দ্র মোদিবিরোধী স্লোগান মিছিলে যার যার এলাকা ‘প্রকম্পিত’ করে। অতি ডান ও অতি বাম কখনও কখনও এককালে আওয়াজ দেয়। তাতে লাভ হয় অতি ডানের। বামদের কি লাভ হয় জানি না। তবে তাদের পেছন থেকে জনগণ যে বহুদূরে ছুটে চলে যায় সেই উপলব্ধি তাদের কোনো কালেই ছিল না, এখন তো একেবারেই নেই।

২৮ তারিখের হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে লণ্ডভণ্ড করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদীতে কওমি শিক্ষার্থীদের নামিয়ে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছিল তা দেখে অনেকেই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ধর্মের কল আপনিই বাজে। এবারের হেফাজত নেতা বাবুনগরীর চাইতেও তিন কাঠি উপরে উঠে গিয়েছিলেন যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হক। তিনি এইসময়ে ধর্মীয় ওয়াজের নামে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবিরোধিতা, সরকারবিরোধিতা এবং বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মের ব্যাপারেও নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান করছিলেন। কিন্তু তারপরও মামুনুল হকই এই সময়ের আলোচিত কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে উঠলেন। কেন্দ্রীয় নেতার এই স্থানটিতে তিনি উঠতে গিয়ে পা পিছলে সিঁড়ির তলদেশে পড়ে গেলেন।

৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে এক নারীর সঙ্গে অবস্থানটি জানাজানি হয়ে গেল। এটি নিয়েও কওমি শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মীরা ভাঙচুর, তাণ্ডব চালায়। কিন্তু মামুনুল হকের চরিত্রের পবিত্রতা কতখানি নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেটি তিনি আর মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। তার গোপন জারিজুরি একের পর এক ফাঁস হতে থাকে। একই সঙ্গে অন্যদের কর্মকাণ্ড সামনে চলে আসে। হেফাজত প্রথমে চেষ্টা করেছিল সব কিছুকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলবে কিন্তু সম্ভব হলো না। হেফাজতের মধ্য থেকেও বিরোধিতা শুরু হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। ৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এটিও বিরোধিরা গ্রহণ করেনি। হেফাজতের ভেতরেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। মামুনুল হকসহ আরও বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে সংগঠনের অভ্যন্তরেই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে। হেফাজত এখন বেশ বেকায়দায় পড়েছে। বেশ কজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকেই পুলিশের রিমান্ডে আছেন।

সরকার হেফাজতের তান্ডব, ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাদিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিহত করতে পারেনি। তেমনটি করা হলে অনেক নিরীহ শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটত। তাতে সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যাপকভাবেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হতো। এরপরও ২৬-২৮ তারিখে মোট ১৭টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। সংখ্যাটি আরও বাড়লে দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সরকার বুঝে শুনেই তা হতে দেয়নি। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর সরকার জাল ফেলে মাছ ধরার মতো অপরাধীদের একে একে ধরা শুরু করেছে। এর ফলে হেফাজতের মধ্যে এক ধরনের ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাদের ভয়-ভীতির কথা জানিয়েছে। মন্ত্রী তাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন যারা নিরাপরাধী তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য।

এক সময়ের নিয়ন্ত্রণহীন হেফাজতে এখন কতটা দিশাহীন হয়ে পড়েছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। হেফাজত আগে কখনও নিজেদেরকে ক্ষমতায়, কখনও জামায়াত শিবিরের বুদ্ধি পরামর্শে দেশে যা ঘটাতে চেয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশি বিদেশি শক্তির শলাপরামর্শ এবং অর্থে পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তারা কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। নিজেদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা অবিশ্বাস, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্য এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য যেকোনো অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করছে না। অনেকেই আছেন এমন বোধ বিশ্বাস ও আচরণের বিপক্ষে। তারা ধর্মের বিশ্বাস ও চর্চা থেকে সংগঠনকে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু তাদের হাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।

লেখক: গবেষক, অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর