বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পশ্চিমবঙ্গে জোড়াফুল সুনামির নেপথ্যে

  • অনিন্দ্য আরিফ   
  • ৯ মে, ২০২১ ১৩:৪৩

নির্বাচনি প্রচারণায় মমতা মুসলিমদের ভোট বিভক্তি না করার যে অনুরোধ করেছিলেন, তা এই সম্প্রদায়ের মানুষ ভালোভাবেই রেখেছে। এমনকি আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ মাত্র একটি আসন পেয়ে সংযুক্ত মোর্চার নির্বাচনি অবস্থান একেবারে শূন্যতা থেকে রক্ষা করলেও, মুসলিম ভোটের প্রায় অধিকাংশই তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে। এমনিতেই বরাবরই মুসলিম সমর্থন মমতার পক্ষে ছিল।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অতি সাম্প্রতিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় শুধু নাটকীয় নয়, ঐতিহাসিকও বটে।

ভারতের স্বাধীনতার পর এই রাজ্যের নির্বাচনে শুধু ১৯৭২ সালেই একক দল হিসেবে কংগ্রেস এর চাইতে বেশি ভোট পেয়েছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি ছিল।

কেননা, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের ঝড়ের তীব্র ঝাপটা মোকাবিলা করে তৃণমূলের বিজয় লাভ করা অনেকটাই দুষ্কর ছিল। কিন্তু নিজেদের দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বকে বিভিন্ন প্রলোভনের হাতছানিতে গেরুয়া শিবিরে ভিড়ে যেতে দেখে এবং ভারতীয় কর্পোরেট পুঁজির একটা বিপুল সমর্থন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে বিনিয়োগ হয়ে অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি অর্থের অন্তঃসারশূন্য চাকচিক্য তৈরি করলেও তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে ভড়কে যাননি।

তিনি ‘খেলা হবে’ স্লোগান দিয়ে বাঙলার চিরায়ত অসুরবোধিনী ‘দুর্গা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কেন্দ্রের ‘জয় শ্রীরাম’ রণধ্বনিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার এই বিজয়ের মাধ্যমে দেশটির রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের বিপরীতে সর্বভারতীয় কোনো দলের চাইতে আঞ্চলিক জনপ্রিয় দলগুলোর ভূমিকাকে বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলল।

ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর চাইতে পশ্চিমবঙ্গের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে ‘শ্রীরামে’র জনপ্রিয়তা থাকলেও এখানে ‘মা দুর্গা’র আবেদনটা বেশি। অন্য রাজ্যে নিরামিষভোজী হিন্দুদের প্রাবল্য থাকলে বাংলায় মাংসাশী হিন্দুদের আধিক্য বেশি। আর রাজ্যের রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া মনন এখানে তীব্রভাবে বহমান। কলকাতার কসমমোপলিটান সংস্কৃতিতে এই মানসিক গঠনের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের বামপন্থী রাজনীতির হেজিমনি এখানে আন্তর্জাতিকতাবাদী আবহাওয়া সীমিত আকারে হলেও সংযুক্ত করেছে। ‘পার্ক সার্কাস’, ‘পার্ক স্ট্রিট’, ‘শেকসপিয়ার সরণি’-এর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার অনেক রাস্তার নামে ‘লেনিন সরণি’ কিংবা ‘হো চি মিন স্ট্রিট’ ইত্যাদি দেখা যায়। আবার কলকাতার ‘বাবু সংস্কৃতি’ গোটা পশ্চিমবঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ আবহাওয়া সৃষ্টি করে এসেছে।

ভারতের স্বাধীনতার সময় থেকে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘে’র বিভেদের রাজনীতি শ্যামাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে এখানে তেমন জমিন পায়নি; এমনকি ২০০৪ সালে বাজপেয়ী-আদভানীর ‘ভারত উদয়’ও সারা ভারতে জনপ্রিয়তার রসায়ন তৈরি করলেও পশ্চিমবঙ্গে তেমন হালে পানি পায়নি। সুতরাং বিজেপির মনুবাদী দর্শন অনেককে আচ্ছন্ন করলেও এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে যে ব্রাহ্মণ্যবাদের বুদবুদে আবদ্ধ করতে পারবে না, সেটা মমতা ভালো করেই জানতেন। তাই তো তিনি ‘জয় শ্রীরামে’র বিপ্রতীপে ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করে বাজিমাত করেছেন। আর তাতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে তার বিগত দশ বছরের সমস্ত দুর্নীতি আর অনিয়ম এবং প্রবল কর্তৃত্ববাদ।

পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতীয় রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট

একদিকে বিজেপি যেমন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্যকে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে পুঁজি করতে চেয়েছিল, তেমনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র থেকে বিজেপি বিতাড়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হাজির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে বিজেপি অপসারণ আরম্ভ হবে এবং দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে।’ নির্বাচনে জয়ের পর তিনি বলছেন ‘বাংলা গোটা দেশকে উদ্ধার করেছে।’

ভারতের ছত্রিশগড়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুরজিৎ সি. মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘এমন একটা ন্যারেটিভ গোটা ভারতের জন্য প্রয়োজন ছিল, যার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যাবে মোদি-অমিত শাহ জুটি ধরাশায়ী হচ্ছে। এখন প্রমাণ করা যাচ্ছে যে, এই জুটিকে পরাস্ত করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে অন্য রাজ্যগুলোতে এই বার্তা ছড়িয়ে পড়বে। আর মোদি সরকারের করোনা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা যেভাবে গোটা ভারতের মানুষকে ফুঁসিয়ে তুলছে, তাতে এই বার্তা স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করতে পারে।’

আসাম বা পদুচেরিতে জয়লাভ করলেও বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ, তা সবারই জানা। পশ্চিমবঙ্গকে করায়ত্ত করতে পারলে তার হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতো। আর এখানে ধাক্কা খাওয়া যে এই কভিড পরিস্থিতিতে তাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে, সেটাও তাদের জানা আছে। এজন্যই তো তারা নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে আর ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের পারদ চড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন জিততে চেয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের ভূমিধস জয় তার জয়রথকে থামিয়ে দিয়ে প্রমাণ করল যে বিজেপিকেও চরম ধরাশায়ী করা যায়। তবে বিজেপিকে পরাস্ত করতে গেলে এখন যে কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় দলের চাইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এম কে স্ট্যালিন, পিনারাই বিজয়নের মতো আঞ্চলিক নেতৃত্ব বা দল বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, তা ভারতের সাম্প্রতিক পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনি ফলাফল প্রত্যক্ষ করাল।

মমতার প্রকল্প জাদু

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে গত আম্পানের সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তার ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের অব্যবাস্থপনার অভিযোগ যে খুব একটা জমে ওঠেনি, তা ফলাফল প্রমাণ করছে। তবে মমতার নেয়া ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, ‘খাদ্য সাথী’, ‘সবুজশ্রী’, এবং শিক্ষাশ্রী’ প্রকল্পগুলো যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী ভোটারদের ভালোভাবেই প্রভাবিত করেছে, তা ভোটের ফলে প্রমাণিত হয়েছে। নিজেদের দলের দুর্নীতির অভিযোগ ঢাকতে তৃণমূল সরকার ভোটের অল্প আগে ‘দুয়ারে সরকার’, ‘পাড়ায় পাড়ায় সমাধান’ এবং ‘স্বাস্থ্য সাথী’-এর মতো বেশ কিছু প্রকল্প উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ২০২০ এর ডিসেম্বরে শুরু হওয়ার পর ‘দুয়ারে সরকার’ উদ্যোগটি মাত্র দুই মাসে দুই কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছিল।

নির্বাচনি প্রচারের সময় এই উদ্যোগগুলো সামনে নিয়ে এসেছিল তৃণমূলের প্রার্থীরা। তারা ভোটারদের সামনে এসব প্রকল্পগুলোর সাফল্য তুলে ধরেছিল। আবার তারা ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছিল যে, বিজেপি জিতলে তাদের এ উদ্যোগগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। তৃণমূলের এই উদ্যোগগুলো জনগণের মধ্যে কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই প্রশ্ন চাপা পড়ে গিয়েছে এই প্রকল্পগুলোর নির্বাচনি প্রভাবের ফলে।

দলবদলে পালাবদল ব্যর্থ

এবারের নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কিনে নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার করতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল আগের নির্বাচনগুলোর তৃণমূলী সিপাহসালারদের বেশ কয়েকজনকে নিজেদের দলে ভিড়ালেই তৃণমূল ধারশায়ী হবে। তাদের এই নীতি যে বুমেরাং হয়ে যাবে, তা তারা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। এই নৈতিকতাবিবর্জিত দলবদল একদিকে যেমন নিজের দলের মধ্যে অনেকটা অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে, তেমনি জনগণও একে প্রত্যাখান করেছে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সব্যসাচী দত্ত, জিতেন্দ্র তেওয়ারী, রথীন চক্রবর্তী এবং বৈশালী ডালমিয়ার মতো হেভিওয়েট দলবদলকারীরা বিজেপির টিকিটে পরাজিত হয়েছেন। এক শুভেন্দু অধিকারীর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও মমতার এসব দলত্যাগীদের প্রতি ‘মীরজাফর’ আখ্যা বেশ যে কাজে দিয়েছে, তা প্রায় সব দলবদলকারীদের পরাজয়ে উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং, বিজেপি যে দলবদল করিয়ে ‘আসল পরিবর্তনে’র হাঁক দিয়ে পালাবদল করতে চেয়েছিল, তা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে।

‘বহিরাগত’ আওয়াজের সাফল্য

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ট্রাম্পকার্ডের বিপরীতে তৃণমূল বেছে নিয়েছিল ‘বহিরাগত’ তকমা। মোদি-অমিত শাহ জুটির প্রবল আক্রমণকে রুখতে তাদের প্রতি এই আওয়াজ ছুড়ে মমতা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে প্রধান অস্ত্র বানিয়েছিলেন। ‘জয় শ্রীরামে’র বিপ্রতীপে আওয়াজ উঠেছিল ‘জয় বাংলা’। বিজেপি যেখানে ‘আসল পরিবর্তনে’র ডাক দিয়েছিল, সেখানে তৃণমূল আওয়াজ তুলেছিল ‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’। সবশেষে তারা নির্বাচনি রণধ্বনি তুলেছিল-‘খেলা হবে’। তাদের এই স্লোগানের কৌশলগুলো ভালোই কাজ দিয়েছে। জনগণের মধ্যে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের জিগির ভালোভাবেই তৃণমূলের নির্বাচনি জয়ের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণ ব্যর্থ

নির্বাচনের আগে বিজেপি তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল যে, তারা রাজ্যটিকে মুসলিমদের অনকূলে নিয়ে যাচ্ছে এবং অচিরেই এটি বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। কিন্তু বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা বড়ভাবে কাজে লাগেনি। এর জোরে ৭৭টি আসনে জয়লাভ করলেও সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে এই কৌশলকে ব্যর্থ করে দিয়েছে তৃণমূলের কিছু কৌশল। দলটি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়টিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। জনমত সমীক্ষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বর্ণহিন্দুত্ববাদী বিভেদের বিরুদ্ধে মমতা কীভাবে মতুয়া, বাগদী এবং আদিবাসীদের ভোটকে সংহত করেছেন। তিনি হিন্দু পুরোহিতদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন, দুর্গা পূজার সময় ক্লাবগুলোর প্রণোদনার জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি প্রায়ই হিন্দুদের সংস্কৃত শ্লোক আওড়িয়েছেন, প্রতিদিন হিন্দুধর্মের আচারগুলো পালন করেছেন এবং নিজের ব্রাহ্মণ পরিচয়টিকে সামনে এনেছেন। বিজেপির গোড়া হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের মৃদু হিন্দুত্ববাদের কৌশল নেয়াতে আগের হারানো হিন্দু ভোট পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন মমতা।

প্রায় একচেটিয়া মুসলিম সমর্থন

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় মুসলিম নেতা আব্বাস সিদ্দিকী ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট নামে রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন করে বামপন্থীদের সঙ্গে জোট করায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোট দ্বিধা-বিভক্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল এই মুসলিম ভোটের বিভক্তি বিজেপিকে লাভবান করে তুলবে। কিন্তু সেই শঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট প্রকারান্তরে তৃণমূলের পক্ষেই বেশি গিয়েছে।

নির্বাচনি প্রচারণায় মমতা মুসলিমদের ভোট বিভক্তি না করার যে অনুরোধ করেছিলেন, তা এই সম্প্রদায়ের মানুষ ভালোভাবেই রেখেছে। এমনকি আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ মাত্র একটি আসন পেয়ে সংযুক্ত মোর্চার নির্বাচনি অবস্থান একেবারে শূন্যতা থেকে রক্ষা করলেও, মুসলিম ভোটের প্রায় অধিকাংশই তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে। এমনিতেই বরাবরই মুসলিম সমর্থন মমতার পক্ষে ছিল।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের পক্ষে পড়েছিল অধিকাংশ মুসলিম ভোট। এবার বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং তারই এজেন্ডা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের ভয়ে মুসলিমরা সংহত হয়ে তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছে। কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ এবার তৃণমূলের দিকে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের ২২টি কেন্দ্রের নির্বাচন হওয়া ২০টির মধ্যে তৃণমূলই পেয়েছে ১৮টি, কংগ্রেসের প্রয়াত মন্ত্রী গনি খান চৌধুরীর এলাকা হিসেবে খ্যাত মালদাতে ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রের আটটিই দখল করেছে দলটি, দক্ষিণ দিনাজপুরে বিজেপির সমান সমান ৬টি আসন পেলেও উত্তর দিনাজপুরের নয়টি কেন্দ্রের সাতটিতেই জয়লাভ করেছে মমতার দল।

প্রশান্ত কিশোর ফ্যাক্টর

নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের বাইরে ইলেকশন আনালিস্টের ভূমিকা যে আজকের দুনিয়ায় বেশ কিছু জায়গায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তা ভারতের প্রশান্ত কিশোর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আরেকবার উপলব্ধি করালেন। এর আগে ভারতের আটটি বিধানসভা নির্বাচন এবং তানজানিয়ার জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনি কৌশলবিদ হিসেবে অংশগ্রহণ করে আটটিতে জয় এনে দেয়া বিহারের এই নির্বাচনি কৌশলবিদের পাল্লায় আরেকটি সাফল্য যুক্ত হলো পশ্চিমবঙ্গে জোড়াফুলের সুনামির মাধ্যমে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে কিশোর টুইট করে বলেছিলেন যে, বিজেপি আসনের দিক থেকে তিন অঙ্কে পৌঁছাতে পারবে না। অনেকে একে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সেসময় উড়িয়ে দিলেও এবং বিজেপি একে একদমই পাত্তা না দিলেও শেষ হাসি কিন্তু প্রশান্ত কিশোরই হেসেছেন।

কিশোর তৃণমূলের নির্বাচনি প্রচারণা, স্লোগান থেকে শুরু করে দলের পুনর্কাঠামো তৈরি করা এবং মনোনয়নের জন্য প্রার্থী নির্বাচন-সবকিছুতেই এক ধরনের নির্ধারক ভূমিকা রেখেছেন। এতে তৃণমূলেরই অনেকে নাখোশ হয়েছেন এবং প্রকাশ্যে বেশ কজন তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু মমতা তার প্রতি আস্থা রাখায় কভিড এবং আম্পানের ব্যর্থতা সত্ত্বেও তৃণমূলের পক্ষে জনমত অব্যাহত রাখতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। প্রশান্ত কিশোরের সাফল্যের মাধ্যমে বিশ্বায়িত দুনিয়ায় সনাতনি কায়দায় নির্বাচন করার কৌশলগুলো সম্পর্কে নতুনভাবে ভাববার বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে আবার উপস্থাপিত হয়েছে।

বামপন্থীদের ব্যর্থতা

৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীরা এবার একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি। কংগ্রেস এবং আইএসএফের সঙ্গে জোট করেও তাদের জোটের ভাগ্যে জুটেছে একটিমাত্র আসন। গত লোকসভার নির্বাচনেই একসময়কার ক্ষমতাসীন বামপন্থী এবং কংগ্রেসের অবস্থা যে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। তারা মূলত তৃণমূলের দুর্নীতি এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রকৃত ধারাবাহিক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের ঠিক অল্প কিছু দিন আগে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিলেও তা দিয়ে হালে বেশি পানি জমাতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা। পুরনো ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হওয়ার প্রচেষ্টায় তারা শ্রেণি গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার মূল বামপন্থী কৌশলটিকে ভুলতে বসায় তাদের এই ভরাডুবি হয়েছে। একইসঙ্গে দুটি শক্তিকে প্রধান শত্রু করার কৌশলটিও এ ব্যর্থতার জন্য দায়ী হতে পারে। আর জনগণও বিজেপিকে ঠেকানোর মূল শক্তি হিসেবে তৃণমূলকেই বেছে নিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তারা তাদের শাসনামলে প্রাদেশিক উন্নয়নের চাইতে নিজেদের ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের শ্রীবৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। যেখানে কেরালার বামপন্থীরা সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে এবং তার ফল এখনও লাভ করছে, সেখানে প্রথমদিকে বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা তা পরবর্তী সময়ে ধরে রাখতে পারেনি। যেজন্য তাদের জায়গা নিয়েছে তৃণমূলের মতো জনতুষ্টিমূলক দল। পাশাপাশি, সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে বিকল্প হওয়া বিজেপির উত্থানও বামপন্থীদের ক্ষমতায় থাকার সময় অব্যাহত মতাদর্শিক সংগ্রামের অনুপস্থিতির ফলাফল। আর এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, যেটা পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতের জন্য একটি অশনিসংকেত হিসেবে রয়ে গেল।

শেষকথা

পশ্চিমবঙ্গে জোড়াফুলের সুনামি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে ভারতের বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ধর্মনিরেপক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং উদারনৈতিক বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে আশা জাগাচ্ছে। এমনিতেই বহুজাতিকের স্বার্থ রক্ষাকারী কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন এবং ভয়ংকর কভিড পরিস্থিতি বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলেছে।

এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের কাছে পরাজয়, তাদের অগ্রযাত্রাকে অনেকটাই রুখে দেয়ার ইঙ্গিত বহন করছে। ভারতের এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান ফেডারেল ব্যবস্থা সুসংহতকরণের জমিন আরও শক্ত করলেও, আঞ্চলিক জাতীয়তায়তাবাদ আবার বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিতে পারে কি না, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। তাহলে কিন্তু ভারতের বহুত্ববাদ আবার বিপন্ন হতে পারে। তবে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ভুমিধস জয় একভাবে যেমন ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য বিপদ সংকেত, তেমনি এই শক্তির পিছুহটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বার্তাবাহ হিসেবে কাজ করছে। হয়তবা তৃণমূলের জয়ে আমাদের তিস্তা চুক্তির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা আবারও দেখা দিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদের পরাজয় আমাদের মৌলবাদী উত্থানের এক ধরনের রসদ জোগানোকে আপাত বিরত রাখতে পারে বলে মনে হয়।লেখক: সাংবাদিক

anindyaarif1981@gmail.com

এ বিভাগের আরো খবর