বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বৃক্ষনিধনে এত উৎসাহ কেন?

  •    
  • ৮ মে, ২০২১ ১৭:০৫

যে প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন, তার সরকারের আমলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো ঐতিহাসিক জায়গার উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে রেস্তোরাঁ ও রাস্তা (ওয়াকওয়ে) নির্মাণের প্রতিবাদে মুখর সোশ্যাল মিডিয়া। এরইমধ্যে অন্তত ৪০টি গাছ কাটা হয়েছে এবং বিভিন্ন জায়গায় লাল ‘ক্রস’ দিয়ে কাটার জন্য আরও কমপক্ষে ৪০টি গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

যদিও গাছ কাটার পক্ষে যুক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি হবে আন্তর্জাতিকমানের। বিদেশিরাও এখানে ঘুরতে আসবেন। এ জন্য কিছু স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজনে গাছ কাটা হচ্ছে।’

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকেও গাছ কাটার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কিছু গাছ কাটা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে উদ্যানে এক হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।

সরকার বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে দেশের ইতিহাস ও বাঙালি জাতির আবেগের জীবন্ত দলিল। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ যেমন- পাকিস্তানি শাসনবিরোধী ২৩ বছরের মুক্তি-সংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংবলিত ভাস্কর্য স্থাপন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য, ইন্দিরা গান্ধী যেখানে বক্তৃতা করেছিলেন সেখানে ইন্দিরামঞ্চ নির্মাণ, ওয়াটার বডি ও ঝরনা, ভূগর্ভস্থ ৫০০ গাড়ির পার্কিং ও শিশুপার্ক নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ কারণে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো বানাতে জমি কোথাও উঁচু কোথাও নিচু করতে হবে। তা করতে কোথাও মাটি ভরাট করতে হচ্ছে। আবার কোথাও মাটি কেটে গভীর করতে হচ্ছে। এর জন্য ‘না কাটলেই নয়’, এমন কিছু গাছ কাটা পড়ছে।

সরকারের এই ব্যাখ্যা কতটা যৌক্তিক বা কারা এর বিরোধিতা করছেন বা সমর্থন করছেন, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, গাছ কেটে উন্নয়নের এই প্রবণতা আমাদের দেশে নতুন নয়। আমাদের কথিত উন্নয়নের মানেই হলো নদী ও খাল দখল, পুকুর ভরাট, গাছ কাটা এমনকি শতবর্ষী ভবন ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন গড়ে তোলা।

আমাদের উন্নয়ন মানেই ইট, অ্যালুমিনিয়াম ও কাচের চাকচিক্যময় অট্টালিকায় রঙিন আলোর ঝলকানি। অথচ নদী ও খালকে তার মতো বইতে দেয়া, পুকুরের পাড় বাঁধিয়ে সেটিকে দৃষ্টিনন্দন করা এবং শতবর্ষী গাছ ও ভবন রক্ষাই যে প্রকৃত উন্নয়ন, সেটি ভুলে যান আমাদের উন্নয়নের সারথিরা। আমাদের রিভারভিউ প্রকল্প মানেই নদী দখল; সবুজ শহর মানেই শত শত গাছ কেটে ফেলা; প্রবৃদ্ধি মানেই চকচকে ভবন!

আমাদের উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। প্রকল্প মানেই পয়সা। পয়সা মানেই ভাগবাটোয়ারা। সহজ সমীকরণ। সুতরাং কার জন্য কী উন্নয়ন—সেই প্রশ্ন করার সময়ে নেই। যে কারণে বিশাল সেতু কিংবা কালভার্ট নির্মাণ করার পরে বছরের পর বছর সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ওই সেতুতে উঠতে হয় বাঁশের সাঁকো বেয়ে— এমন ছবিও গণমাধ্যমে এসেছে। অপ্রয়োজনীয় স্থানে সেতু নির্মাণ; পুকুর কেটে আবার সেটি ভরাট এমনকি বাস্তবে পুকুর খনন না করেই খননের টাকা তুলে নেয়াও নতুন কোনো খবর নয়।

অস্বীকার করার উপায় নেই, গাছ কাটার পক্ষে সব সময়ই একটি গোষ্ঠী সরব থাকে। সেই গোষ্ঠীর ভেতরে সরকারি লোকজন যেমন আছেন, তেমনি আছেন গাছ ও আসবাব ব্যবসায়ীরা। আছেন মধ্যস্বত্বভোগী ঠিকাদার। ফলে উন্নয়নের নামে যখনই অনেক গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন সেখানে এই গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতায়ও নজর রাখা দরকার। যে কারণে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগে বা লাগানো হয়; বড় বড় বনের ভেতরে গাছ কেটে উজাড় করা হয়— তার সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে গাছ কেটে ফেলার বিষয়টিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সবই পয়সার খেলা।

সুতরাং, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে সেখানে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের খবরে আপনি বিস্মিত হতে পারেন। বিস্মিত হওয়ার অধিকার আপনার রয়েছে। বিস্মিত হলে আপনার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে না— যতক্ষণ না সেই বিস্ময়কে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী কিংবা অতি উৎসাহী কেউ মানহানিকর বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকল্প যখন পাস হয়েছে— তখন সম্ভবত এটা বাস্তবায়িত হবেই।

কিন্তু মানুষের প্রতিবাদ করারও অধিকার রয়েছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এর প্রতিবাদ হচ্ছে। কেউ কেউ সীমিত সাধ্য নিয়ে মানববন্ধনও করেছেন। এসব প্রতিবাদ ও মানববন্ধন রাষ্ট্রের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে তা বলা মুশকিল। কারণ প্রকল্প মানেই যেহেতু সেখানে রাষ্ট্রের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুক্ত এবং তাদের স্বার্থ জড়িত, ফলে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে, বা সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রবণতায় যেটি স্পষ্ট তা হলো, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এসব প্রকল্প থেকে সরে আসা বা প্রকল্প পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা কম।

সুতরাং, যে প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন, তার সরকারের আমলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো ঐতিহাসিক জায়গার উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। নিশ্চয়ই তিনি গাছ বাঁচিয়েই সেখানে ওয়াকওয়ে এবং প্রয়োজনে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের নির্দেশনা দেবেন। কেননা গাছ ও পরিবেশ বাঁচিয়েই যে উন্নয়ন করা সম্ভব, তার হাজারো উদাহরণ রয়েছে।

যশোর রোড। বাংলাদেশ ও ভারতের সংযোগ সড়ক এবং এটিও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাওড়া-বারাসাত পার হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ১২৫ কিলোমিটারের এই সড়কের বাংলাদেশের অংশটুকু যশোর-বেনাপোল সড়ক নামে পরিচিত হলেও পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে কলকাতা এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে নাগের বাজার হয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত রাস্তাটি যশোর রোড নামেই পরিচিত।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকজনের ঠাঁই হয় এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শরণার্থী শিবিরে। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ এই যশোর রোড দেখে ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি। এই সড়কের দুপাশে রয়েছে শত শত শতবর্ষী বৃক্ষ, যারা সেই মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী।

যে গাছগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ও ভারতের কোটি কোটি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা। কিন্তু রাস্তা সংস্কার তথা প্রশস্ত করার জন্য এর দুপাশের গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নেয় দুদেশের সরকার—যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মানুষের সেই আন্দোলন সংগ্রাম গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আসে গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ।

পরিবেশবাদীদের দাবি, গাছ রেখেই যাতে রাস্তার সংস্কার করা হয়। পৃথিবীতে এরকম উদাহরণ অসংখ্য যে, মাঝখানে বড় বড় গাছ রেখে দুপাশে চলে গেছে দিগন্তবিস্তৃত সড়ক। একইভাবে গাছ না কেটেই তার চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে প্রয়োজনীয় স্থাপনা। সুতরাং, যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে মানুষের এত আবেগ ও ভালোবাসা, সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের বাস্তবতা স্বীকার করেই গাছ না কেটে উন্নয়ন করা যায় কি না—সেই দাবিটিই জোরালো হচ্ছে এবং এই প্রকল্পে নিশ্চয়ই অনেক পরিবেশবিদ ও ইতিহাসসচেতন মানুষ রয়েছেন, তারাও আশা করি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর