এমনিতে ঢাকা শহর দিনে দিনে বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। নানা ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমের নামে সাবাড় করা হচ্ছে গাছ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির ঋতুতে ঘোষিত লকডাইনে মানুষের ঘরে থাকার কালে আবারও ঢাকা শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ হত্যা করা হচ্ছে। সর্বশেষ রেস্টুরেন্ট স্থাপনের নামে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্বিচারে একের পর এক গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে খোদ রাজধানীর বুকে বৃক্ষ হত্যার এই আয়োজন সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কেননা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর রমনা পার্ক ইট-কাঠ-কংক্রিটের এই দূষিত শহরের ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত। এখানকার গাছকাটা তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের কাছে অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কথা হলো, গাছ কেটেই কেন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে? বিশ্বের বহু দেশে এখন প্রাণীর অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে গাছ না কেটে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন তা করছি না? এই শহরে যেখানে দিন দিন প্রকৃতিক অক্সিজেনের উৎস হারিয়ে যাচ্ছে, তখন কিছু মানুষের অবহেলা, অজ্ঞতা আর অপরিকল্পিত নির্মাণে আরও হুমকিতে পড়েছে আমাদের পরিবেশ।
সোহরাওয়ার্দী, রমনা, ওসমানী উদ্যানের গাছ কাটা নিয়ে গত দুই দশকে প্রতিবাদ-আন্দোলন কম হয়নি। যখনই নাগরিকরা সোচ্চার হন, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে, কিছু দিন গাছ কাটা বন্ধ থাকে। কিন্তু নাগরিকরা একটু চুপচাপ হলেই আবার নানা ফিকিরে, নানা কৌশলে গাছ কাটা অভিযান শুরু হয়ে যায়। কেন এই প্রবণতা? গাছ কাটার কুফল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল কি ওয়াকিবহাল নন? নাকি ক্ষমতার জোরে আর দশটা অন্যায়ের মতো গাছ কাটাকেও তারা জায়েজ হিসেবে দেখতে চান?
এমন ঘটনা যে শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ঘটছে তা নয়; পুরো দেশেই গাছ কেটে চলছে নির্মাণকাজ। এ নিয়ে সরকারের নানান নির্দেশনা আছে; আছে পরিবেশ আইন। কিন্তু তারপরও থেমে নেই কিছু। বৃক্ষনিধন চলছেই। আর আমরা আছি চোখ বন্ধ করে। যদিও এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধ হয়নি। নতুন করে আরও অনেক গাছের গায়ে ‘লাল চিহ্ন’ দেয়া হয়েছে; যেগুলোও কাটা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন; সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেআইপি) এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে রেস্টুরেন্টের মতো অপ্রয়োজনীয় নির্মাণের জন্য এত এত প্রাচীন গাছ কেন কাটতে হবে? কেন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে হবে? গাছ কেটে খাবারের দোকান বা অন্যান্য স্থাপনা তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নগরবিদদের দেয়া হিসাব বলছে, প্রতিটি বড় শহরে ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু কাগজে-কলমে নতুন ঢাকায় আছে ১২ আর পুরান ঢাকায় ৫ শতাংশ। বাস্তবে এর পরিমাণ আরও কম।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার ব্যাপারে আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এই উদ্যানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ উদ্যান সংরক্ষণে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনায় বলা হয়, রমনা তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকেই এ পর্যন্ত একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং এর একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য আছে। শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা।
এই পরিপ্রেক্ষিতেও সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। এখানে এমন কোনো স্থাপনা থাকা উচিত নয়, যা এই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারে। পরিবেশগত দিক থেকে তা আরও বিধেয় নয়। কারণ রমনা উদ্যান বা রমনা রেসকোর্স ময়দান ঢাকা শহরের দেহে ফুসফুসের মতো অবস্থান করছে। কোনোভাবেই একে রোগাক্রান্ত করা যায় না। যেহেতু স্মরণকাল থেকে এটা উদ্যান হিসেবে পরিচিত সেহেতু ২০০০ সালের ৩৬ নং আইন অনুসারে সোহরাওয়ার্দী ‘উদ্যান’ সংজ্ঞার আওতাধীন এবং এই জায়গার শ্রেণি সাধারণভাবে অপরিবর্তনীয়। এটা অনাবশ্যক স্থাপনা দিয়ে ভারাক্রান্ত করা অবৈধ হবে।
অথচ আদালতের নিষেধাজ্ঞা, প্রচলিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থে রেস্টুরেন্ট বা দোকান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমাদের দেশের বৃক্ষ সংরক্ষণ বিধিতে বলা হয়েছে, সরকার যদি সংরক্ষণযোগ্য কোনো গাছ কাটার অনুমতি দেয় তবে শর্ত হিসেবে প্রতি একটি গাছ কাটার বিপরীতে তিনটি গাছ লাগানোর শর্ত দিতে হবে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি দপ্তর বা বিভাগের কেউ এ আইন লঙ্ঘন করে, তবে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ও ওই বিভাগের প্রধানকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এক্ষেত্রে যদি দোষী সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী প্রমাণ দিতে পারেন যে- এ আইনের লঙ্ঘন তাদের অজ্ঞাতসারে হয়েছে এবং তিনি গাছ কাটার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন, তবে তাকে দোষী করা হবে না। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের গাছ কাটার ক্ষেত্রে এসব আইন ও বিধির কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
মনে রাখতে হবে যে, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছ আমাদের শুধু অক্সিজেনই দান করে না, তারা বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণ ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইডও শুষে নেয়। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড হলো সেই গ্রিন হাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম যেগুলো পৃথিবীর উষ্ণায়ণ এবং তার ফলস্বরূপ জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা তাই গাছকে কার্বনের শোষক বলেন।
জাতীয় বননীতি অনুযায়ী দেশের মোট স্থলভাগের অন্তত ৩৩% গাছ এবং অরণ্যবেষ্টিত রাখতেই হবে, নাহলে জলবায়ুর পরিবর্তনের এই ভয়ংকর প্রভাব থেকে এ দেশকে বাঁচানো যাবে না। আমাদের দেশে বর্তমানে সংরক্ষিত অরণ্যের পরিমাণ মাত্র ১০% তে এসে ঠেকেছে।
এর পরিমাণ আর বাড়ানোর পরিস্থিতিও নেই। এই অবস্থায় অরণ্য পরিধি বাড়িয়ে নেবার সব থেকে সহজ এবং প্রয়োজনীয় উপায় হবে যেটুকু অরণ্য আছে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা, জাতীয় সড়ক এবং অন্যান্য রাস্তার ধারে গাছগুলোকে বাঁচানো। একইসঙ্গে মানুষের বসবাসের জায়গাতে নতুন গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
রাস্তার পাশে ছায়া দেয়া মাতৃতুল্য সবুজ গাছগুলোর বেড়ে উঠতে সময় লাগে বছরের পর বছর। এর মধ্যে রয়েছে কিছু বিলুপ্তপ্রায়, ঔষধি, ফলদ, বনজ ইত্যাদি। একটি গাছ মানে একটি জীবন নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাণিকুলের জীবন। সাধারণত অধিকাংশ বড় গাছেই থাকে কোনো না কোনো পাখির বাস। গাছ কাটার ফলে তারাও হয় আশ্রয়হীন।
একটি পরিপূর্ণ গাছ বছরে ৪৮ পাউন্ড হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং যে পরিমাণ অক্সিজেন প্রদান করে তাতে অন্তত দুজন মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারে। অর্থাৎ যে বৃক্ষটি দুজন মানুষকে জীবিত রাখার দায়িত্ব পালন করছে, আমরা তাদের নির্বিচারে কেটে ফেলছি চোখের নিমেষেই। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে এ কাজটি মানুষ হত্যার থেকেও ভয়াবহ।
কারণ একজন মানুষ বছরে সাধারণত ২ দশমিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে গ্রিনহাউস ইফেক্টকে ত্বরান্বিত করে। সবুজ বৃক্ষ পরম মমতায় সেই বিষাক্ত গ্যাস শোষণ করে প্রাণিকুলকে দেয় বাঁচার রসদ অক্সিজেন। একবারও কি আমাদের বিবেক এগুলো ভাবায় না?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ২১২ হেক্টরের একটি আরবান পার্ক প্রতিদিন ৪৮ পাউন্ড ধুলোবালি, ৯ পাউন্ড নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ৬ পাউন্ড সালফার ডাই-অক্সাইড, ২১ পাউন্ড কার্বন মনো-অক্সাইড এবং ১০০ পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণে সহায়তা করে। অথচ আমরা এসব তথ্যকে উপেক্ষা করে কত তুচ্ছ কারণেই না বৃক্ষকে হত্যা করি। আর বৃক্ষ হত্যার বিরুদ্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। গাছ কাটার জন্য কারো শাস্তি হয়েছে, কেউ দণ্ড ভোগ করেছে, এমন উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না।
কেবল অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে পার্কে, উদ্যানে, রাস্তার পাশের ছায়াদাতা সবুজ গাছগুলোকে নির্দ্বিধায় হত্যা বন্ধ করতে হবে। কী দোষ করেছিল এই শান্তিপ্রিয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো? মানুষ হত্যার বিচারে যদি মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে, তাহলে যে গাছ আমাদের মতো অকৃতজ্ঞদের বছরের পর বছর স্বার্থহীনভাবে বাঁচিয়ে রাখছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন দিয়ে, সেই পরম বন্ধুটির হত্যার বিচার কী হবে? তারও তো প্রাণ আছে। সেও তো বিচার পাওয়ার যোগ্য। কোনো আইন দিয়ে কি আমরা পারব আমাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে? নিত্যকার শহরায়ন ও উন্নয়নের আগ্রাসন থেকে যদি আমরা গাছকে বাঁচাতে না পারি তাহলে আমরা নিজেরা বাঁচব কীভাবে?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক