মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ্যে কাজ করে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের। এমনকি, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অসম্মান করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে তারা।
জামায়াতে ইসলামীর এই কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে মার্কিন সরকারি সংস্থার নাম। ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য গঠিত মার্কিন কমিশনেও জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের প্রভাব ধরা পড়েছে ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ডিসইনফোল্যাব-এর প্রকাশনায়।
১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনবলে আমেরিকা গঠন করে ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ বা ইউএসসিআরআইএফ। পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করাই হচ্ছে এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ডিসইনফোল্যাব-এর রিপোর্টে ধরা পড়েছে, জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের হাত ধরে জঙ্গিবাদীরাও অনুপ্রবেশ করেছে এই ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় গঠিত কমিশনে। জাস্টিস ফর অল, আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল, সাউন্ড ভিশন প্রভৃতি সংস্থারও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে ইউএসসিআরআইএফ-এ। ‘ইসলামিক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা’ বা আইসিএনএ-এর কর্মকাণ্ডেও এই সংগঠনগুলোর প্রভাব সর্বজনবিদিত।
মানবাধিকার-সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতেও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় গঠিত মার্কিন কমিশনের সদস্যরা অংশ নিয়েছেন। কমিশনের পদাধিকারীদেরও দেখা গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। অথচ তাদের নিজেদের সদস্য অনেকেই জড়িত গণহত্যায়।
আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ইসলামীক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা বা আইসিএনএ-র ভূমিকা নিয়েই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ এই সংস্থাটির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ড. মহসিন আনসারিসহ একাধিক জামায়াতের নেতা আইসিএন-এর সভাপতিও হয়েছেন। আবার আইসিএনএ-র নিউ ইয়র্ক ক্যুইন চ্যাপ্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান।
উল্লেখ্য, আদালতের বিচারে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘ-এর নেতা আশরাফুজ্জামান ১৯৭১ সালের বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপরাধী।
আইসিএনএ-র সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগের বহু প্রমাণ রয়েছে। আসলে এই মার্কিন সংগঠনটি জামায়াত দ্বারাই প্রভাবিত। তাই ২০১৬ সালে মতিউর রহমান নিজামীর মতো ঘাতককে তারা সম্মাননা প্রদান করে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও আল-বদর নেতা নিজামী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যার দায়ে ফাঁসির সাজা পায়। ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৬ সালের ১০ মে। এর কিছুদিন পরেই আইসিএনএ তাকে মরণোত্তর সম্মাননা দিয়েছে ইসলাম ধর্ম ও ১৯৭১ সালে তার ‘অসামান্য অবদান’-এর জন্য!
আইএনসিএ ও তাদের আরেক সহযোগী ‘জাস্টিস ফর অল’ নিজামীর মতো যুদ্ধাপরাধীকে সংবর্ধনা দিয়েছে। আবার তারাই ধর্মীয় স্বাধীনতা বা মানবাধিকার নিয়ে মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছেন! একদিকে, বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যায় প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীকে সম্মান জানাচ্ছে। অপরদিকে, মুখে বলছে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার কথা! দ্বিমুখী আচরণের চরম নিদর্শন এগুলো। জাস্টিস ফর অল-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল মালিক মুজাহিদ গণহত্যা নিয়ে এখন সভা-সমিতিতে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অথচ তাদের প্রধান সংগঠন আইসিএনএ-র সভাপতিই ছিল গণহত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে, এ ধরনের মানবাধিকারবিরোধী লোকজন আমেরিকাতে বসে সরকারি সংগঠনেও কী করে প্রভাব খাটায়? তাও আবার গণহত্যাবিরোধী ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় গঠিত কমিশনে গণহত্যাকারীদের অনুপ্রবেশ! তাই প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের গণহত্যায় মদতদাতাকে আমেরিকায় বসে সম্মান প্রদর্শন এবং গণহত্যায় অংশ নেয়া সংগঠনের সক্রিয়তা মার্কিন প্রশাসনকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত। কিন্তু পাকিস্তানভিত্তিক জামায়াতে ইসলামী ঠিকই দেশটিতে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের সাহচর্যে নিজেদের সকল জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী।
সম্প্রতি বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া হেফাজতে ইসলামের মৌলবাদী তাণ্ডবেও জড়িত ছিল এই জামায়াতে ইসলামী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে দেশকে অশান্ত করতে পাকিস্তানভিত্তিক মৌলবাদীরা অর্থ সরবরাহ করেছে। এর সঙ্গে বিদেশে বসবাসরত বেশকিছু বাংলাদেশি জড়িত। পাকিস্তানের এই অর্থ বিদেশি রেমিটেন্স আকারে দেশে প্রবেশ করে যার মাধ্যমে বাংলাদেশে সংগঠিত হয়েছে মোদিবিরোধী আন্দোলন। আর বিদেশে পাকিস্তানের এই কার্যক্রমের পেছনে ছিল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এখানে হওয়া সকল জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে এই জামায়াতে ইসলামী।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।