৭ মে ২০০৭ সাল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেসন কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনের উদ্দেশে রওনা হবার সময় হাতে-গোনা কয়েকজন নেতা তাকে স্বাগত জানান। তখন ছিল জরুরি আইন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশাল জমায়েত করে দলের সভাপতিকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর সুযোগ আওয়ামী লীগের নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে বাংলাদেশে ফিরতে না দিতে বিশেষভাবে তৎপর ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের ভেতরের সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিয়ে গাড়িটি প্রধান সড়কে পড়তে না পড়তেই দেখা গেল অভূতপূর্ব দৃশ্য- দলে দলে আওয়ামী-ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা প্রশস্ত রাজপথ ভরে ফেলল। এ যেন ম্যাজিক! কেবল একটি স্থানে নয়, বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত ১৫-১৬ কিলোমিটার পথজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। কণ্ঠে তাদের স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার আগমন স্বাগতম স্বাগতম। উই পোকার হঠাৎ আবির্ভাব- এ দৃশ্য আমাদের দেশে অপরিচিত নয়। একটা-দুইটা উই পোকা হঠাৎ করেই ঢিবি থেকে বের হয়ে আসে, মুহূর্ত যেতে না যেতেই অনেকটা এলাকাজুড়ে কেবল উই আর উই। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে।
৭ মে তেমনটিই ঘটেছিল- জনে জনে মিলে জনস্রোত। সাধারণত আওয়ামী লীগ কিংবা এ ধরনের দলের বড় সমাবেশে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মী আসেন বাস-ট্রাকে। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমনটি ঘটতে পারেনি। দেশে জারি রয়েছে জরুরি আইন। তারা আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রবল আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো বিএনপির অনেক নেতাও তখন কারাগারে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এমন অবস্থায় কী করে সম্ভব হলো এ ধরনের জমায়েত?
গোয়েন্দারা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তারা ধরেই নিয়েছিল বিমানবন্দরে কয়েকজন নেতা হাজির থাকবেন, তারপর শেখ হাসিনা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে অদূরে সুধা সদনে ফিরে যাবেন নিজের ঘরে। ব্যস, তারপর সবকিছু আগের মতো-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
শেখ হাসিনা আরও দুই সপ্তাহ আগে স্বদেশে ফেরার জন্য লন্ডন বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসার জন্য প্রথমে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়ংকর গ্রেনেড হামলার দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে প্রণীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল সেই অভিশপ্ত দিনে। অন্তত ২৪ জন সেই হামলায় নিহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমান। আহেত অন্তত ৫ শ’। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকে আহতের দলে। ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ আরও অনেক নেতা ছিলেন মঞ্চে।
সমাবেশ ও মঞ্চ লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। চারদিকে মৃত্যুপথযাত্রীদের আর্তচিৎকার। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখেন একদল নেতাকর্মী। ভয়ংকর গ্রেনেড হামলায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রচণ্ড শব্দ ও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে শ্রবণশক্তি কমে যায় এবং তা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়। এ ব্যাধি নিয়েই তিনি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন ব্যর্থ করার সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জরুরি আইন জারির পর তিনি কানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ফিরে আসবেন লন্ডন হয়ে। সেখান থেকেই বিমানে ওঠার তারিখ নির্ধারিত হয় ২৩ এপ্রিল (২০০৭)। কিন্তু ততদিনে ঢাকায় নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। অপ্রচারও চলতে থাকে। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই অদম্য।
মামলার কথা জানতে পেরে ঘোষণা দেন- আদালতে গিয়ে তিনি প্রমাণ করে দেবেন যে, এ মামলা হয়রানিমূলক। রাজনৈতিকভাবে তাকে দমিয়ে রাখার জন্যই এটা করা হচ্ছে। ততদিনে ঢাকায় ‘মাইনাস টু’ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠানো হবে। তবে রাজনৈতিক হালচাল যাদের জানা, তারা বলছিল- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘মাইনাস টু’ নয়, প্রকতপক্ষে চাইছিল শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘মাইনাস ওয়ান’। সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে যে সরকার চালাচ্ছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে তারা। কিন্তু আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ একই কথা বলেছিলেন। জনগণ দেখেছে- এদের কেউ গণতন্ত্র দিতে চায় না। আর তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ভণ্ডুল করে দিতে বার বার যে দলটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সেটির নাম আওয়ামী লীগ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং একই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহকর্মীকে হত্যা করেও এ দলকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব এ দলটির। জরুরি আইনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা রুখে দাঁড়াবেন, এ নিয়ে শাসকদের সন্দেহ ছিল না। এ কারণে তারা চেয়েছিল রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে তাকে সরিয়ে দিতে। তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল বাংলাদেশের বাইরে লন্ডন কিংবা অন্য কোনো স্থানে তাকে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করা। প্রয়োজনে আরাম-আয়েশে জীবন কাটানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এখন তারেক রহমান যেমন লন্ডনে জীবন কাটাচ্ছেন, অনেকটা সে ধরনের ব্যবস্থাই প্রায় করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সে অপচেষ্টা বানচাল করে দেয়। শেখ হাসিনা লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন- মিথ্যা মামলা টিকবে না। তিনি আদালতে হাজির হবেন। বিচারে যদি দণ্ড হয়, সেটা মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের পথ ছাড়বেন না।
বঙ্গবন্ধু কোনোদিন জেল জীবনকে ভয় পাননি। তাকে ক্যান্টনমেন্টেও বন্দি রাখা হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে। শেখ হাসিনার মা মহিয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে বার বার পিতার বন্দিজীবন দেখেছেন। কী করে কঠিন সময়েও মাথা উঁচু করে থাকতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। এইচএম এরশাদের শাসনামলে তাকে একাধিকবার গৃহবন্দি রাখা হয়। কিন্তু তাকে দমন করা যায়নি। এখনও যাবে না। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাধ্য করেন তার স্বদেশ ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। এরপর ফিরে আসেন ৭ মে।
তিনি জানতেন, তাকে বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিংবা সুধা সদনে গৃহবন্দি করে রাখা হতে পারে। কিন্তু নাথিং উইল গো আনচ্যালেঞ্জড। তিনি দলকে জানিয়ে দেন- রাজপথে থাকতে হবে। নেতাকর্মীরা বার্তা বুঝে যায়। দলে দলে তারা অবস্থান নেয় ১৫-১৬ কিলোমিটার পথজুড়ে। গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে পারে তারা। হয়ত তাদের কেউ কেউ ফুটপাতে কিংবা রাস্তার মোড়গুলোতে বাড়তি লোকের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।
সড়কের আশাপাশের গাছের ছায়ায় কিংবা বিভিন্ন দোকান ও বাসভবনের সামনে ভিড় লক্ষ করা গেছে। তবে কেউ বিশেষভাবে খতিয়ে দেখেনি কেন এত দীর্ঘ পথজুড়ে বাড়তি লোকের সমাবেশ। ওই রাতে টেলিভিশন সংবাদ থেকে এবং পরদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে সবাই জেনে যায় বঙ্গবন্ধুকন্যা অভাবনীয় সংবর্ধনা পেয়েছেন। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় রাখতে পেরেছে।
শেখ হাসিনা বেশি দিন মুক্ত জীবনে থাকতে পারেননি। তাকে ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। ওই দিনই আদালতে নেয়া হলে দলের নেতা-কর্মীরা ফের স্লোগানমুখর হয়- শেখ হাসিনার মুক্তি চাই। তিনি যতদিন কারাগারে ছিলেন, একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক। কর্মীরাও ছিলেন রাজপথের সাহসী সৈনিক। ১১ মাসের বন্দিজীবন শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। সাড়ে ৬ মাস পর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়। যে নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন তাদের পরিশ্রম সার্থক হয়। শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন যাত্রা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক