বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লড়াকু শেখ হাসিনা

  • মোহাম্মদ শাহজাহান    
  • ৭ মে, ২০২১ ১১:১৭

২০০৭-এর ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রেসনোটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দু-দু’বার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘোষণা করে তার দেশে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর পরেও শেখ হাসিনা দমে গেলেন না। চাঁদাবাজির মামলা, খুনের মামলায় চার্জশিট, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি ঘোষণা’ কোনো কিছুকেই পরোয়া করলেন না অসম সাহসী মুজিবের দুঃসাহসী কন্যা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের এটাই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যে, জাতীয় স্বার্থে দেশের জনগণের জন্য পিতার মতোই যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এমনকি মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বার বার লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে বন্দি গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছেন। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের নিষেধাজ্ঞা, মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা, খুনের মামলায় চার্জশিট, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা উপেক্ষা করে ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে না এলে বাংলাদেশে আজও হয়তো অসাংবিধানিক শাসন কায়েম থাকত। অসম সাহসী মুজিবের দুঃসাহসী কন্যা কীভাবে সেই অসাধ্য সাধন করেছেন, সে এক মস্ত ইতিহাস।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস একটি। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস দুটি। পিতা-কন্যার এই তিনটি প্রত্যাবর্তন দিবসই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।

৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তির পর লন্ডন ও ভারত হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে আসেন। এর পর সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে লড়াই করে ২০০৭ সালের ৭ মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। তবে দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে যেভাবে লড়াই করে দেশে আসেন, এর কোনো তুলনা হয় না। ৩ কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা, খুনের মামলায় চার্জশিট, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, সর্বশেষ ‘রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘোষণা করেও শেখ হাসিনাকে ফখরুদ্দীন সরকার বিদেশের মাটিতে আটকে রাখতে পারেনি। একটি ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে একজন মানুষের এমনিভাবে লড়াই করার অনন্য নজির বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও সরে আসেননি। তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে যখন যা ভালো মনে করেছেন, তা বাস্তবায়িত করেছেন।

বিএনপি আমলে মাগুরা-বগুড়া উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলেন এবং দাবি মানতে খালেদা জিয়াকে বাধ্য করেন। আবার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে বঙ্গবন্ধুকন্যা এই পদ্ধতি বাতিল করেন। আরও এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যে, জননেত্রী তার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে দেশ ও জাতির স্বার্থে যা যথার্থ মনে করেছেন, তা বাস্তবায়িত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে। নবজাত রাষ্ট্রের জনকের অবর্তমানে জনগণের কাছে স্বাধীনতা এবং বিজয়কে তখন অপূর্ণ মনে হচ্ছিল। মুক্ত স্বদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে বাংলার অপূর্ণ স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশ ফিরে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে খুঁজে পাননি। বীর উত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়া তার ৬ বছরের উর্দি-শাসনে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ‘মিনি পাকিস্তানে’ পরিণত করেন। জিয়া-এরশাদ-খালেদার বাংলাদেশ আর মোনায়েম খানের পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ঘাতক সর্দার জিয়া তার ৬ বছরের শাসনামলে মুক্তির মহানায়ক, স্বাধীনতার জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মুজিবের নাম প্রায় মুছে ফেলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জিয়াকে তার সাঙ্গপাঙ্গরা স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রচার করতে থাকে। সেই পাকিস্তান মার্কা বাংলাদেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা ২০০৭-এর ৭ মে স্বদেশে ফিরে আসেন সেনাসমর্থিত তিন উদ্দিনের (ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দীন ও ইয়াজউদ্দিন) এর সরকারের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করে। কী কঠিন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা ৭ মে দেশে ফিরে আসেন তা জানতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৯ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে খুবই ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করেন শেখ হাসিনা।

২০০১ সালে ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান দেশে সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম করেন।

মেয়াদ শেষে সংবিধান লঙ্ঘন করে খালেদা জিয়া দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহাম্মদকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করে কারচুপির নির্বাচনে আবারও খালেদা-নিজামীকে ক্ষমতায় বসানোর নীল নকশা প্রণয়ন করেন। শেখ হাসিনা আন্দোলনের কঠিন কর্মসূচি প্রদান করেন। খালেদা গংয়ের প্ররোচনায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে সেনাপ্রধানের সমর্থনে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ। ওয়ান-ইলেভেনের আগেই খালেদা জিয়া সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে সরাসরি ক্ষমতা নিতে অনুরোধ করেছিলেন।

সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতা দখল করলে আওয়ামী লীগ উল্লসিত না হলেও অখুশি হয়নি। সবার ধারণা ছিল, ফখরুদ্দীন সরকার অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। আওয়ামী লীগসহ সবাই জানত, নির্বাচনে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে। দেশের মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল, দুই বড় দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে সেনাসমর্থিত সরকার ৫/৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ওই সময় নোবেল পুরস্কার জয়ী ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যও চেষ্টা করা হয়। ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় দল গঠন সম্ভব হয়নি।

সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার পদে বসাতে চেয়েছিলেন। ১১ জানুয়ারি রাতে সেনা কর্মকর্তারা বাসায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করতে ড. ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানান। ড. ইউনূস ওই পদ গ্রহণ করতে বিনয়ের সঙ্গে অস্বীকার করেন। সেনাকর্মকর্তারা তার পছন্দের অন্য কোনো নাম দিতে ড. ইউনূসকে অনুরোধ করেন।

যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীনের নাম ড. ইউনূসই সিলেক্ট করে দেন। ১২ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ। অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ২০০৭-এর ১৫ মার্চ ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার তখন শেখ হাসিনাকে বিদেশে রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠানোরও পরিকল্পনা নেয়।

এ সময় সেনাসমর্থিত সরকার নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হঠাৎ করে ঘোষণা করেন ‘দেড় বছরের আগে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’ শেখ হাসিনা বুঝে গেলেন আলামত সুবিধার নয়। ক্ষমতা দখলকারীরা ক্ষমতাকাল দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র করছে। চুপ করে থাকতে পারলেন না বিদেশ সফররত শেখ হাসিনা। ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে সিইসির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব করলে জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে।’ শেখ হাসিনার প্রতিবাদী বক্তব্য ক্ষমতাসীনরা সহজভাবে গ্রহণ করেনি। মাত্র ৩ দিনের মাথায় ৯ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়।

জনৈক তাজুল ইসলাম তেজগাঁও থানায় এই মামলা করেন। মামলার কথা শুনে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধুকন্যা ব্যক্তিগত সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুততার সঙ্গে দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। সরকার এবং তাদের মুরব্বিদের ধারণা ছিল, মামলার কথা শুনে শেখ হাসিনা ধীরে-সুস্থে পদক্ষেপ নেবেন এবং তার সফর কিছুটা হলেও বিলম্বিত হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল এর বিপরীত। এদিকে সরকারের লেজ গোটানোরও সুযোগ নেই। চাঁদাবাজির মামলার ২ দিন পর ৬ মাস আগের ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে সহিংসতার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৪২ জন দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিটের কথা শুনে ১১ এপ্রিল ২০০৭ ওয়াশিংটনে এক সভায় শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, হয়রানি ও ভয় দেখাতেই তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের এবং খুনের মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

সাহসী মুজিবের দুঃসাহসী কন্যা জোরের সঙ্গে বলেন, ‘প্রয়োজনে জীবন দেব কিন্তু কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করব না। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করায় ক্ষমতাসীনরা জনসমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ওই দিনই বার্তা সংস্থা এপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জননেত্রী বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আনা হত্যা ও চাঁদাবাজির মামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আইনি পথেই মামলার মোকাবিলা করা হবে। হেয় করতেই এই মামলা দেয়া হয়েছে। আমি নির্ধারিত তারিখের আগেই আমার দেশে ফিরে যাব। বিমানের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে।’

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেশে আসার কথা ছিল ২৩ এপ্রিল। আরও ৯ দিন এগিয়ে তিনি ১৪ এপ্রিল দেশে ফেরার ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড এবং দেশে ফেরার তারিখ এগিয়ে আনায় সেনাসমর্থিত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হতভম্ভ হয়ে পড়ে। এ সময় সরকার কিছুটা পিছু হটে। সরকারের পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত তারিখে দেশে ফিরতে শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।

১১ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সরকারের একজন উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের নেত্রী এবং ঢাকায় আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তা নেত্রীর দেশে আসার তারিখ পরিবর্তন না করে পূর্বনির্ধারিত ২৩ এপ্রিল আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।’ (দৈনিক সংবাদ, ১২.৪.২০০৭)

সরকার চেয়েছিল শেখ হাসিনা দেশে না এলে বেগম জিয়াকে এই সুযোগে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। দুই পুত্রের বিরুদ্ধে পর্বতসমান দুর্নীতির অভিযোগ থাকার কারণে বেগম জিয়ার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন জোরালো আপত্তি করার কথা নয়। শেখ হাসিনাকে আমেরিকায় রেখে ওই সময়ের মধ্যে বেগম জিয়াকে বিদেশ প্রেরণের প্রস্তুতি চলে। ফখরুদ্দীন গং মনে করেছিলেন বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর পর শেখ হাসিনাকে হয়তো বুঝিয়ে সুঝিয়ে হলেও আরও কিছুদিন বাইরে রাখা যাবে।

বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে বেগম জিয়া তার দুই পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু গ্রেপ্তার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ হরেকরকমের বড় অভিযোগ থাকায় তাকে কোনোভাবেই ওই সময় বাইরে যেতে দেয়া হবে না বলে বেগম জিয়াকে জানানো হয়। অগত্যা বেগম জিয়া কনিষ্ঠপুত্র কোকো এবং দুই পুত্রবধূকে নিয়েই বিদেশে পাড়ি জমাতে সম্মত হন। ওই সময় জানাজানি হয়ে যায়, বেগম জিয়া যেকোনো সময় বিদেশের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করবেন।

২১ এপ্রিল ২০০৭ বেগম জিয়া কারাগারের বাইরে বিশেষ ব্যবস্থায় অতি গোপনে বন্দি পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। তখন বিএনপি নেত্রীর বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে সবাই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যান। বেগম জিয়া বিদেশে চলে গেলে শেখ হাসিনাকে যে সরকার কোনোভাবেই দেশে ফিরতে দেবে না, এই চিন্তায় অস্থির শেখ হাসিনা যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরতে একরকম মরিয়া হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনা হয়ত তখন এই বিষয়টি ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, দুই বড় দলের শীর্ষনেত্রী বিদেশে থাকলে সেনাসমর্থিত সরকার আবার ৫/৭ বছরের জন্য ক্ষমতায় জেঁকে বসবে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হবে। ওই অবস্থায় বেগম জিয়ার দেশত্যাগের আগেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তখন সরকার দেখল, খালেদা কোনো সমস্যা নয়। প্রধান সমস্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যদি দেশে চলেই আসেন, তাহলে খালেদাকে বিদেশে পাঠিয়ে লাভ কী? তাছাড়া ওরা জানত, হাসিনাকে যে কোনোভাবে বাইরে আটকাতে পারলে, খালেদাকে বিদেশে পাঠাতে তাদের জন্য কোনো সমস্যাই হবে না।

শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই জনগণের নেত্রী মামলা, হামলাসহ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই স্বদেশে ফেরার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু কোনোভাবেই যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিদেশে থাকতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখনই সরকার তার দেশে ফেরার ব্যাপারে এক অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে। ২০০৭-এর ১৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রেসনোটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দু-দু’বার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘোষণা করে তার দেশে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর পরেও শেখ হাসিনা দমে গেলেন না।

চাঁদাবাজির মামলা, খুনের মামলায় চার্জশিট, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি ঘোষণা’ কোনো কিছুকেই পরোয়া করলেন না অসম সাহসী মুজিবের দুঃসাহসী কন্যা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের এটাই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যে, জাতীয় স্বার্থে দেশের জনগণের জন্য পিতার মতোই যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এমনকি মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।

এভাবে পর্বতসমান বাধার মুখে ২৩ এপ্রিল (২০০৭) ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে ঢাকা ফেরার ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা ওয়াশিংটন থেকে ১৯ এপ্রিল লন্ডন পৌঁছেন। ২২ এপ্রিল সিএমএম আদালত পল্টন সহিংসতা মামলার চার্জশিট গ্রহণ করে শেখ হাসিনা, মোহাম্মদ নাসিমসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ শেখ হাসিনাকে বিমানে ওঠার অনুমতি দেয়নি। সেনাসমর্থিত সরকারের দমননীতির মুখে শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরার আকুলতা ও ব্যাকুলতায় শুধু দেশের মানুষ নন, বিদেশের মানুষও খুশি হন।

সাহস, দেশপ্রেম এবং মাতৃভূমি ও পিতৃভূমিতে ফিরে আসার অদম্য আকাঙ্ক্ষার জন্য শেখ হাসিনা রাতারাতি বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হন। ২৩ এপ্রিল বিশ্বের ৪১টি দেশের ১৫১টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় শেখ হাসিনা বিষয়ক খবর ছাপা হয়েছিল বলে একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়।

শেষ পর্যন্ত ফখরুদ্দীন সরকার পিছু হটল। দেশ-বিদেশের সমালোচনার মুখে সরকার ২৫ এপ্রিল ২০০৭ বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ওই বৈঠকের পর আরও বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে প্রেরণের ব্যাপারেও সরকার কোনো চাপ দেয়নি বা এখনও দিচ্ছে না।

এর পর ৭ মে ২০০৭ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে জরুরি অবস্থার মধ্যেও হাজার হাজার লোক ঢাকা বিমানবন্দরে নেত্রীকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে মিছিল সহকারে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসে। সেদিন যদি প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দেশে না আসতেন, তাহলে কী ঘটত? ব্যাগেজ নিয়ে তৈরি বেগম জিয়াপুত্র কোকোকে নিয়ে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হতেন। জিয়া-এরশাদের মতো একতরফা নির্বাচনে সুবিধাবাদীদের নিয়ে সরকার গঠন করা হতো। হয়তো ৫/১০ বছর এমনিভাবে অপশাসন কায়েম থাকত দেশে।

লড়াই করে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে আসাতেই বেগম জিয়াকেও বিদেশে যেতে হয়নি। আর এ জন্যই বেগম জিয়ারও শেখ হাসিনার কাছে ঋণী থাকা উচিত। ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সিংহভাগ কৃতিত্ব অবশ্যই শেখ হাসিনার। জিয়া, এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে আনার বেশিরভাগ কৃতিত্বও বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দিতেই হবে।

২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিনের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটই লড়াই-সংগ্রাম করেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচনে বেগম জিয়া ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন। শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফলেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বর্জন ও সন্ত্রাসী আন্দোলনের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার জন্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাস একদিন লিখবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশে বার বার বন্দি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও বেসরকারি টেলিভিশন সত্য প্রকাশের ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে।

সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের জনগণই হচ্ছে প্রকৃত নায়ক। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনা ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ নেত্রী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করবেন। আর এ জন্যই গত চার দশকে গণতন্ত্রবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বার বার হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। পরম করুণাময় বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সকল বিপদ-আপদে রক্ষা করেছেন।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর