বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় প্রসূতির চিকিৎসাসেবা

  • শাহনাজ পলি   
  • ৬ মে, ২০২১ ১৩:২৬

গর্ভবতী মা করোনা আক্রান্ত হলেও তা শিশুর মধ্যে ট্রান্সমিশনের সম্ভাবনা থাকে না। করোনায় আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। তবে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে অবশ্যই হাত ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার পোশাক ও মুখে মাস্ক পরতে হবে।

সন্তান লালনপালন নিয়ে মা-বাবার উদ্বেগের শেষ নেই। কতক্ষণ পর পর খাবার দেবেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন এসব নানা বিষয় নিয়ে ডাক্তার, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, বন্ধুবান্ধব, বইপুস্তক আর ইন্টারনেট থেকে নানা রকম প্রচলিত ও আধুনিক পরামর্শ নিয়ে শিশুকে যত্নআত্তি ও উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেন প্রথমত একজন মা। কিন্তু এই করোনাকালে অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।

প্রথমবার ছেলেকে কোলে নিয়ে কী করবেন, কী দেখবেন তাই ভেবে দিশেহারা রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা সদ্যপ্রসূত সন্তানের মা তাহসিন আজাদ নদী। গত ৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের ডা. হাফিজার তত্ত্বাবধানে ছেলে আরিয়ানের জন্ম। এই করোনাকালে গর্ভবতী নারীর চিকিৎসাসেবা যেমন ঝুঁকি ছিল, তেমনি ছিল তার শারীরিক অন্যান্য জটিলতা। তবে করোনা মহামারি কতদিন বিশ্বে স্থায়ী হবে তা কারোরই জানা নেই। তাই সময় সুযোগ বুঝে তারা সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন পারিবারিকভাবে পরিকল্পনা করেই। নদী বলেন, গর্ভাবস্থায় প্রথমদিকে শারীরিকভাবে কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু পরবর্তী সময়ে করোনায় আক্রান্ত হন।

ডাক্তার এ ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে প্রেসক্রিপশন ও পরামর্শ দিয়ে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। এই করোনাকালীন সময়ে সন্তানের ঝুঁকি এড়াতে ডাক্তার পরামর্শ দেন, মা মুখে মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে এবং একটি পরিষ্কার কাপড় পরে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। বুকের দুধের মাধ্যমে নবজাতকের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিয়ম কানুন মেনে নদী শিশুসহ সুস্থ আছেন এবং ভাবছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুর ৪৫ দিন বয়সে টিকা দিতে নিয়ে যাবেন টিকা সেন্টারে।

নদীর মতো আরও একজন সদ্য মা হয়েছেন রাজশাহীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মুসবাহ আলীম তিন্নি। আবেগ-আদর, ভালোবাসা ও আদর্শ দিয়ে শিশু সন্তান ‘গল্প’কে বড় করে তোলার সাধ্যের সবটুকুই রয়েছে এই নতুন মাকে ঘিরে। এই করোনার সময়ে গর্ভাবস্থায় প্রথমদিকে আতঙ্কিত হলেও ডাক্তারদের সহযোগিতায় সে ভয় কাটিয়ে ওঠেন। সরাসরি বা টেলিফোনে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ পেয়েছেন। এখন মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছেন। করোনা মহামারি ও লকডাউনের কারণে নিজের ও গর্ভের শিশু নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন রাজধানীর মিরপুরের মিসেস রাবেয়া খাতুন। ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাবেয়ার প্রথম সন্তানের বয়স আড়াই বছর। এবারে করোনাকালে গর্ভধারণ করায় বেশ কটি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে রেখেছেন, তবে এখনও ডাক্তারের কাছে যেতে পারেননি। করোনার কারণে সবকিছুই এখন অনিশ্চিত মনে করছেন রাবেয়া। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি, হাসপাতালগুলোয় রোগীদের চাপ, নিজের গর্ভকালীন জটিলতা সবকিছু মিলিয়ে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ২৮ বছর বয়সি রাবেয়া।

দেশে করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে গর্ভবতী নারী বা অন্তঃসত্ত্বাদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে রাবেয়ার মতো অনেকের মধ্যে হাসপাতালের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও প্রসবকালীন সেবা কীভাবে পাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, দুশ্চিন্তা না করে সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে মহামারিতেও সংক্রমণ এড়িয়ে সুস্থ সন্তান জন্মদান সম্ভব।

এ বিষয়ে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ ও হসপিটালের বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ) এবং করোনার অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, করোনার প্রথমদিকে সন্তান না নেয়ার পরামর্শ দিলেও এখন আর তেমনটি ভাবছেন না, কারণ করোনা নির্মূলের কোনো সময়সীমা বোঝা যাচ্ছে না। তাই বিশেষ প্রয়োজন হলে সন্তান নিতে পারবেন। তিনি জানান, গর্ভবতী মায়েরা যেন ঠিকমতো চিকিৎসা পান সেজন্য রাজধানীসহ জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্দেশনা দেয়া আছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে কোনো গর্ভবতী নারীর চিকিৎসা ব্যহত না হয়। তবে গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ৮টি ভিজিটের কথা থাকলেও এখন করোনাকালে ৪টা ভিজিটে কমিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট ডাক্তারের সঙ্গে টেলিফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।

কোভিড ডেডিকেডেট হাসপাতালে গর্ভবতীদের জন্য নির্দিষ্ট একটা ইউনিট রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন যে, গর্ভবতী মা করোনা আক্রান্ত হলেও তা শিশুর মধ্যে ট্রান্সমিশনের সম্ভাবনা থাকে না। করোনায় আক্রান্ত মা নিশ্চিন্তে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। তবে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে অবশ্যই হাত ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার পোশাক ও মুখে মাস্ক পরতে হবে।

ডা. রওশন বলেন, প্রসূতি করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা কোথায় হবে, তা পরিবারকে জেনে রাখতে হবে। অর্থাৎ যেখানে গর্ভবতী মা ও শিশুর করোনা দু’টোরই চিকিৎসা হয়, সেরকম হাসপাতালগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে করোনা চিকিৎসা হচ্ছে এবং গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। দেশের সব হাসপাতালে নির্দেশনা দেয়া আছে, যদি গর্ভবতী নারীদের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হবে।

মহামারির সময়ে একজন গর্ভবতী নারী অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলবেন এবং হাসপাতালে সন্তান প্রসব করাবেন, এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান (স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ) থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এবং পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. ফাতেমা আশরাফ। তিনি বলেন, এখন অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেকের মধ্যেই করোনার সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে। তাই যেসব দম্পতি সন্তান নেয়ার কথা ভাবছেন, যারা এখনও গর্ভবতী হননি, তাদের এ সময় গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকাই ভালো। এমনকি প্রত্যেক নারীকে প্রয়োজনবোধে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির ফ্যামিলি প্লানিং সার্ভিসকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। কারণ করোনা মহামারিতে বাড়ির বাইরে যেতে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনই ঝুঁকি নিয়েই গর্ভবতীকে নিয়মিত চেক আপের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে একজন গর্ভবতী নারীর চেক আপও যেমন জরুরি আবার মা ও সন্তানের সুস্থতার জন্য ঘরে থাকাও জরুরি।

এ সময়ে গর্ভবতীর পরিবারকেও খুব বেশি সচেতন থাকতে হবে। বাড়ির কাছাকাছি হাসপাতালের ইমার্জেন্সির নাম্বার জেনে রাখা উচিত কারণ হঠাৎ করে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন ব্লিডিং বা শিশুর নড়াচড়া বন্ধ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, গর্ভের সন্তান ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না বা রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন বা হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। আর এজন্য পরিবারের উচিত ঘরে টাকা পয়সার জোগাড় ও প্রসূতির রক্তের গ্রুপ জেনে রাখা। মহামারির এই সময়ে গর্ভবতী নারীর জন্য আলাদা সুরক্ষাপ্রাচীর গড়ে তোলার দায়িত্ব তার পরিবারের।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গর্ভবতী অবস্থায় যদি কারো কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়, তাদের জন্য সরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে এবং সন্তানসম্ভবাদের অগ্রাধিকারও দেয়া হচ্ছে।

করোনানকালে দুর্ঘটনাও ঘটছে, যেমন করোনায় আক্রান্ত একাত্তর টেলিভিশনের সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা ১৬ এপ্রিল নবজাতক শিশুকন্যাকে জন্ম দিয়েই মারা যান।

যদিও গত বছর জাতিসংঘ শিশু তহবিল থেকে জানানো হয়, গত বছর ১১ মার্চ কোভিড-১৯ মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ৪০ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হবে। এই মহামারির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা চাপের মুখে এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহপ্রবাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইউনিসেফ আশঙ্কা করেছে, প্রসূতি মা ও নবজাতকদের রূঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর