বর্তমানে করোনার সময়ে যেখানে জীবন-জীবিকার প্রশ্ন চলে আসে সেখানে ব্যাংকগুলো একটা সেবা হিসেবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জীবন-জীবিকার মাঝখানে ব্যাংকিং সেবাটা একটা রসায়ন তৈরি করে। এ রসায়নের অপারেটর খাতে ব্যাংক। করোনা মেনে নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। এক এক সময় এক এক ভ্যারিয়েন্ট বিভিন্ন রূপে আসবে।
করোনার এই সেনসিটিভ সময়ে ব্যাংকগুলো লাভের দিকে না তাকিয়ে তাদের সেবা ও সার্ভিস, ব্যাংকের বিভিন্ন পণ্য সামনে নিয়ে আসা উচিত। লাভমুখী না হয়ে সেবামুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকা উচিত এ সময়ে।
এ সেবামুখী ব্যাংকিং করতে গেলে ব্যাংকগুলোকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় সক্ষম হতে হবে। কারণ, করোনার সময়ে গ্রাহকদের আসা-যাওয়া সমস্যা। এজন্য ক্যাশ ছাড়া বাকি সব কর্মকাণ্ড অনলাইনে হওয়া উচিত। তাহলে গ্রাহকের সেবা বাসা পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার হবে না।
করোনা সাময়িক বলে মনে হচ্ছে না। এটা দশকের ব্যাপার। ব্যাংকগুলোকে তাদের নতুন নতুন বিনিয়োগ ডিজিটাল খাতে নিয়ে আসা উচিত। যাতে আগামীতে করোনার উত্থান-পতনের সময়ে ব্যাংকগুলো সঠিক সেবা ডিজিটালভাবে দিতে পারে সেটার চিন্তা করা উচিত।
এজন্য প্রত্যেক ব্যাংকের মালিকদের এক্ষেত্রে বিনিয়োগে খেয়াল রাখতে হবে। এটাকে খরচ আকারে চিন্তা না করে বিনিয়োগ মনে করতে হবে।
করোনার সময় ছাড়াও অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা বাজেটের অর্থনীতি সঞ্চালনে ব্যাংকগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সেনসিটিভ খাত বলা হয়।
এ খাত নিয়ে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যারা বিভিন্ন সময়ে কথা বলেন তাদের সম্মুখ জ্ঞান থাকা উচিত। এবং শব্দ চয়ন সঠিকভাবে করা উচিত। যাতে কোনো ব্যাংককে বিড়ম্বনায় না পড়তে হয়। এমন কোনো শব্দ বা এমন কিছু ব্যবহার করা উচিত নয় যেটা মার্কেটে প্যানিক সৃষ্টি করে। অন্তত এ সময়ে। কারণ, করোনার কারণে গ্রাহকেরা এমনিতেই সংকুচিত। তাদের প্যানিক থাকে ব্যাংকের সঞ্চয় নিয়ে। গ্রাহককে যদি আরো প্যানিক করে দেয়া হয়, তাহলে সেটা সঠিক কাজ হবে না।
ইদানিং পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই অনেকে ব্যাংকিং খাত নিয়ে এমন সব মন্তব্য করছেন যা আসলে বাস্তবতার কাছাকাছি নেই। এজন্য এদিকে আরও সতর্ক হতে হবে। যে কোনো সংবাদের হেডলাইনের শব্দচয়নে নজরদারি বাড়ানো উচিত। সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে এ ক্ষেত্রে কথা বলা উচিত বলে আমি মনে করি।
ব্যাংকগুলো সমসময় সরকারের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় প্রচুর অনুদান দিয়ে থাকে। অন্য কোনো করপোরেট খাত সেটা দিতে পারে না। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও অনেক।
জীবনচক্রে ব্যাংক জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো মতামত বা অন্য কোনো ব্যাংক সম্পর্কে লিখতে গেলে এমনকিছু লেখা উচিত না যাতে গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয়।
সম্প্রতি একজন অর্থনীতিবিদ একটি জাতীয় দৈনিকে পদ্মা ব্যাংক ও ইস্টার্ণ ব্যাংক নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এ দুই ব্যাংকের তুলনা করা যায় না। কারণ, ইস্টার্ণ ব্যাংক ৩০ বছর ধরে আছে। আর পদ্মা ব্যাংক তিন বছর। এর আগে পদ্মা ব্যাংককে একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিস্থিতি থেকে সরকার পুর্নগঠন করে। সরকার ৬৮ শতাংশ এখানে বিনিয়োগ করে।
যখন বিসিসিআই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তখন ইস্টার্ণ ব্যাংক সরকারি অনুগ্রহে গঠন হয়। তখন ওই ব্যাংকের ৪৮ দশমিক ৩৩ ভাগ আমানত মূলধনে চলে যায়। অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ আমানত তারা ফেরত দিতে পারেনি এবং তা মূলধনে রূপান্তর করে। বাকি ৫০ শতাংশ আমানত পাঁচ বছরে ব্যাংকের অবস্থা ভালো হলে ফেরত দেবে কিনা বিবেচনা করা হবে বলে জানানো হয়। এমন অবস্থায় ইস্টার্ণ ব্যাংক গঠন করা হয়। আমানতকারীদের টাকা পেতে অনেক দেরি হয়। সরকার এ ব্যাংকের ২০ শতাংশ নিয়েছিল। আর অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩১ দশমিক ৬৭ ভাগ নেয়।
কিন্তু পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ বা ৭১৫ কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক ও ৩২ শতাংশ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়েছে। তিন বছরে ব্যাংক পুনর্গঠন করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে এ ব্যাংকে মাত্র ৩১ হাজার টাকা ছিল। ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকায় ছিল মন্দমানে শ্রেণিকৃত ঋণ। এখান থেকে ব্যাংকের কোনো আয় ছিল না। কিন্তু ইস্টার্ণ ব্যাংকের মন্দ ঋণ কম ছিল। ফলে ঋণ থেকে তাদের ব্যাংকের আয় হতো।
এ সময়ে পদ্মা ব্যাংক গ্রাহকদের একটি টাকাও ধরে রাখা হয়নি। চাহিদামাত্র টাকা দেয়া হয়েছে। গ্রাহকরা সময়মতো আমানতে মুনাফা পেয়েছে।
যে কোনো ব্যাংকের সরকারি আমানত একটা বড় অংশ। সরকার যদি আমানত তুলে নিয়ে যায় সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সাময়িক বিপাকে পড়ে। তারমানে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় না। বড় বড় আমানত তুলে নিলে ব্যাংক বিপাকে পড়ে, কিন্তু এর মানে এটা নয় যে, ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে, টিকবে না। কারণ, সরকারি আমানত তুলে নেয়ার পর সাময়িক সমস্যা সামলে নেয়ার সক্ষমতা পদ্মা ব্যাংক ইতোমধ্যে তৈরি করেছে এবং এই সক্ষমতা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য এসব কথা বলে জনগণের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এজন্য কোনো বক্তব্য না বুঝে প্রচার করা ঠিক না। এতে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরি হয়। আমাদের যারা লেখেন বা কথা বলেন তাদের এটা চিন্তা করা উচিত যে, আমরা কী লিখছি? কথাগুলো সব সত্যি না।
ব্যাংক বিনিয়োগ করতে না পারলে আয় হবে কোথা থেকে? ঋণ বিতরণ ব্যাংকের প্রধান কাজ। কিন্তু এতদিন পদ্মা ব্যাংকের ঋণ দেয়ার অনুমোদনও ছিল না। ২০২০ সালের জুনের পর ঋণ দেয়ার অনুমতি মেলে। আর আগের যে চার হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ ছিল সেখানেও কোনো আয় ছিল না। এটা আরও ভঙ্গুর ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টায় পদ্মা একটি শক্তিশালী ব্যাংকে রূপান্তর হতে যাচ্ছে।
আমাদের আগে ৮০ ভাগ খেলাপি ঋণ ছিল, সেটা কমে ৬৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আমানত-ঋণের রেশিও আগে ছিল ১১৮ শতাংশ। এখন সেটা কমে হয়েছে ৯৩ শতাংশ। এছাড়া মূলধন ৪০০ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ৬ হাজার কোটি টাকার উপরে আমানত রয়েছে। গ্রাহকদের আস্থা রয়েছে বলেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।
এসব কারণে পদ্মা ব্যাংক ভালো উন্নতি করেছে।
বর্তমানে করোনার কারণে ঋণ নেয়ার হার খুব কম। আমাদের ১১ ধরনের আমানত স্কিম আছে। ঋণ বিতরণেও বিভিন্ন স্কিম রয়েছে, কিন্তু করোনার কারণে এসব থমকে আছে।
শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ ছোট ব্যাংকগুলোকে সহযোগিতার জন্য দেয়া উচিত। এক ধরনের গ্যারান্টি স্কিম করা যেতে পারে। এটার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।