বলছি ‘মহারাজ’ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর কথা। যিনি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতীক। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিযুগে যে কজন মানুষ ভারতবর্ষে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, ব্রিটিশ শাসকদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাদের অন্যতম। ৫ মে তার ১৩২তম জন্মবার্ষিকী। বরাবরের মতোই কোথাও কোনো আয়োজন ছাড়াই নীরবে, নিভৃতে এই দিনটিও চলে যাচ্ছে। আমরা হয়ত ভুলেই থাকব বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য এই দিনে বাংলার মাটিতে জন্মেছিলেন এক মহান বিপ্লবী। বাংলার নির্যাতিত-নীপিড়িত, মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় মহারাজের জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ মে, বঙ্গাব্দ ২২ বৈশাখ ১২৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে। এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয় তার। মহারাজের বাবার নাম দুর্গাচরণ চক্রবর্তী, মাতা প্রসন্নময়ী দেবী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম।
এক পাতানো যুদ্ধে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে ক্ষমতায়িত হয়, চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা হারায় ভারতবাসী। ছিনিয়ে নেয়া সেই স্বাধীনতা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে জীবনের সবটুকু সময় বিসর্জন দিয়েছেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। শুধু কি সময়! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, জেলে বন্দি থেকে শুরু করে অসহনীয়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। তবু তিনি দমে যাননি, দমে যাওয়ার মানুষ তিনি নন। ভয়-ডর বলতে কোনো বিষয় তার জীবনে ছিল না। জেল-পুলিশের নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কিন্তু কখনও আর্দশিক অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেননি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার বিপুল উদ্যমে ‘অনুশীলন সমিতি’র হয়ে কাজ করে গেছেন অকুতোভয় মহারাজ।
মহান এই বিপ্লবীকে সবাই পছন্দ করতেন। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত তাকে সমীহ করতেন। উদ্দেশ্য এক হলেও অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধ ছিল। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে কারো বিরোধ ছিল না। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বগুণে তিনি তা অর্জন করেছিলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বরেণ্য নেতারা তাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। মহারাজকে শ্রদ্ধা করতেন বাংলার আরেক স্বাধীনতাকামী নেতা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী শুধু একজন বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি একাধারে লেখক, কবি, চিন্তাবিদ, একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকও। তিনি যেমন কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন গীতার ভাষ্য। লিখেছেন জেলখানার অভ্যন্তরের সমস্যা ও সংকট নিয়ে। স্কুলের জন্য পাঠ্য বইও রচনা করেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে ‘জেলে ত্রিশ বছর’ ও ‘পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইটির জন্য তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কালের বিবর্তনে গ্রন্থটি অগ্নিযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস জানতে হলে বইটির পাঠ আবশ্যিক। অন্যথায় তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
অসামান্য দেশপ্রেমিক এই মানুষটি ব্রিটিশ শাসনের সময় ত্রিশ বছর জেল খেটেছেন। আত্মগোপনেও থেকেছেন পাঁচ-ছয় বছর। এরপর স্বাধীন দেশেও তাকে অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকারও তাকে কারান্তরীণ করেছে। আজীবন অকৃতদার মহারাজ মানুষের জন্য একটি গণতান্ত্রিক, উন্নত সমাজ নির্মাণের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। আরও ব্যাপকভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
দেশভাগের পরও মহারাজ কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন কংগ্রেসের নাম ছিল পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস। কিন্তু এক সময় দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এটি অবশ্য নীতি ও আদর্শগত কোনো বিরোধ ছিল না। বিরোধ তৈরি হয়েছিল দলের রণনীতি নিয়ে। দলের মধ্যে দুটি বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুই পক্ষের এক অংশে ছিলেন মনোরঞ্জন ধর, নেলি সেনগুপ্তা ও বসন্ত কুমার দাস। তারা পাকিস্তানে কংগ্রেস দল টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এর বিরোধিতা করেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রভাস লাহিড়ি প্রমুখ। মহারাজ অংশের মত ছিল, পাকিস্তানের কংগ্রেস যেহেতু হিন্দুদের সংগঠনে রূপ নিয়েছে, তাই এর আর প্রয়োজন নেই। এই কংগ্রেস পার্টিকে দিয়ে আর বৃহত্তর জাতীয় উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে তারা একমত হতে না পেরে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে তারা এক হতে না পারায় বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ‘সংযুক্ত প্রগতিশীল দল (ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তার নির্বাচনি এলাকা ছিল পূর্ব ময়মনসিংহ। নেত্রকোনা মহকুমার ১২ ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার ৮টি থানা নিয়ে এই আসন গঠিত হয়।
নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পেয়ে জয়ী হন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ। দ্বিতীয় হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী নগেন সরকার। নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্টের সময়ে সরকার পক্ষের এমপিএ হয়েছিলেন মহারাজ। তবে এই জয় পেয়েও শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। কারণ যে ভোটাররা ভালোবেসে ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছে, তাদের জন্য কয়েকটা টিউবওয়েল বসানো ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেননি তিনি। এজন্য দুঃখ প্রকাশও করেছেন। এখানেই শেষ নয়, এমপিএ নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আরও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।
জীবনসায়াহ্নে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যান ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। প্রথমে অসম্মতি জানালেও ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ তদারকিতে ভিসা দিতে সম্মত হয় পাকিস্তান সরকার। প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতে যাবার প্রাক্কালে বিবৃতি দেন তিনি। জীবদ্দশায় এটিই তার শেষ বিবৃতি।
১১ জুন বিবৃতিটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। সে সময় পাকিস্তানে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল। ’৭০ সালের এই নির্বাচনটি ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহারাজের বিবৃতিটিও ছিল এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি দেশবাসীকে সৎ ও দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের নির্বাচিত করার আহবান জানান।
১৯৭০ সালের ২৪ জুন বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে মহারাজ ভারতে প্রবেশ করেন। এসময় সীমান্তে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অশ্রুসজল নয়নে তাকে বিদায় জানান। ভারতে পৌঁছে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। পুরানো বন্ধু, সহযোদ্ধা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন। সফরে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে। সেখানে পাকিস্তানি শাসক দ্বারা নির্যাতিত পূর্ব বাংলার মানুষের পাশে থাকার জন্য ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে সে আহ্বান প্রকাশ্যে ছিল না। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের পক্ষে তিনি আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তার পাশে থাকার জন্য তাদের পরামর্শ দেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আর সময় নেই, তাই সবকিছু দ্রুত চালিয়ে যান। প্রায় ৪৭ দিনের ভারত সফরের একদিনও বিশ্রাম নেননি তিনি। প্রতিটি দিন পার করেছেন অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে। ভারতের পার্লামেন্টেও ভাষণ দিয়েছেন। এটি তার জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। মৃত্যুর তিনদিন আগে ১৯৭০ সালের ৬ আগস্ট দিল্লির পার্লামেন্টে এমপিদের সংবর্ধনার উত্তরে তিনি এই ভাষণ প্রদান করেন। মহারাজ সেদিন বাংলা ভাষাতেই ভাষণ রেখেছিলেন।
এর ঠিক দুই দিন পর ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ৯ আগস্ট রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমান মহারাজ। তার প্রায়াণের সংবাদ পেয়ে শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের বাসভবনে মহারাজকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।
ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি প্রয়াত ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকবার্তায় বলেন- মহান বিল্পবী নেতা মহারাজের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে আমি গভীরভাবে শোকাহত। দু-তিন দিন আগে তিনি যখন আমার সঙ্গে দেখা করেন, তখন আমি তাকে ভাল স্বাস্থ্যে দেখেছি। তার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। তার বক্তব্য যেভাবে তিনি উপস্থাপিত করেন তা সত্যিই শোনার মতো এবং চিন্তার যথেষ্ট খোরাক জোগায়। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীও কর্মময় ও ত্যাগপুত জীবন ভবিষ্যৎ বংশদরদের মনে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল, ভারত থেকে মহারাজের শতাধিক অনুসারী তার চিতাভস্ম নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে চিতাভস্ম বিসর্জন দেয়া হবে। কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে ড. কুদরাত-এ-খুদার সভাপতিত্বে মহারাজ ত্রৈলক্যনাথ স্মৃতি কমিটির উদ্যোগে মিন্টো রোডে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার। মহারাজের চিতাভস্ম যথাযোগ্য মর্যাদায় বিসর্জন দেয়ার দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপনের জন বেশকিছু কর্মসূচিও নেয়া হয়। ১৪ এপ্রিল, শুক্রবার মহারাজের চিতাভস্ম যথাযোগ্য মর্যাদায় ঢাকার বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হয়।
চিতাভস্ম বিসর্জন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, ভূমি রাজস্ব বিভাগীয়মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত, অধ্যাপক পুলিন দে, শ্রী দীনেশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ। হাজার হাজার মানুষ সেদিন বুড়িগঙ্গার তীরে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের প্রিয় মহারাজকে হৃদয়ের গভীর থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে চিরদিনের মতো বিদায় জানাতে।
১৩২তম জন্মবার্ষিকীর এই দিনে মহারাজের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সম্পাদক-গবেষক।