বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কার্বন ডাই-অক্সাইডে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

  • মুনীর সিরাজ   
  • ৫ মে, ২০২১ ১৩:১৭

মুনাফাখোর ইটভাটার মালিকদের ওপর কোনো আইনি কর্তৃত্ব একেবারেই নেই। যতটুকু দেখা যায় তা লোকদেখানোমাত্র। কয়লা ও কাঠের বদলে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো সম্ভব। কিন্তু আইন রক্ষাকারীরা এ ব্যাপারে নির্বিকার। এখানে দুর্নীতি কাজ করছে, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারপরও অবৈধ ইটভাটা যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এর প্রভাব অপরিসীম।

১৩০০ থেকে ১,৬০,০০০ বছর আগে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে ১৮০ থেকে ২০০ ভাগ (Parts per million-PPM)। ১,১৬,০০০ থেকে ১,৪০,০০০ বছর আগে তা বেড়ে ২৭০ PPM হয়ে যায়। কিন্তু উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর শিল্প ও যানবাহন বিপ্লবের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং ১৯৫৮ ও ১৯৯০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫ এবং ৩৫৫ PPM।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৭০ PPM থাকা পর্যন্ত মানুষের স্বস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে থাকে। অক্সিজেনের পরিমাণ ≤ ১৬% হলে প্রবল শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যদি অক্সিজেনের পরিমাণ ≤ ৮% পর্যন্ত কমে যায় তখন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে এবং তার মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। সমাজভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাতাসে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের শরীরে নানা রকম ক্ষতিকারক প্রভাব দেখা দেয়।

উচ্চমাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইড মস্তিষ্কের রক্তনালী প্রসারিত করে। এতে মস্তিষ্কে রক্তের চাপ বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। শিশুদের রক্তনালী প্রসারিত হয়ে যায় এবং তার শরীর থেকে দ্রুত উত্তাপ নির্গত হয়ে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়, মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয় (panic attack) উচ্চমাত্রার কার্বন ডাই-অক্সাইডের কারণে ফুসফুস এবং শরীরের রক্তনালীর রক্তচাপ বেড়ে যায় (pulmonary pressure and systemic hypertension)।

কার্বন নিঃসরণে কমানোর জন্য যদিও পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলোই বার বার একত্রিত হয়েছে, তথাপি দীর্ঘ সময় ধরে নানা রকম বাগবিতণ্ডার মধ্য দিয়েই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছিল- যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাবে। আর আন্তর্জাতিক সহয়তা পেলে কমাবে ১৫ শতাংশ। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন রকম। জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে বাগবিতণ্ডা এতটাই সময়ক্ষেপণ করেছে যে, ২০১৫ সালের ‘অমিশন গ্যাপ’ সভায় এ কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিশ্বের ১১৯টি দেশ কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলেও অতিরিক্ত কালক্ষেপণের কারণে এর পরও পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন ২৩-৪৩ শতাংশ। এর পর যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ এবং তৃতীয় ভারত ৫ শতাংশ।

কার্বন নিঃসরণের ফলে তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি বেড়ে যায় তবে ৩০-৪০ শতাংশ প্রজাতিকুলের বিলুপ্তি ঘটবে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় খরা-বন্যা, সাইক্লোনের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহচ্যুত ও দেশচ্যুত হয়েছে। কোপেনহেগেনে ১৯৯০ সালে গ্রিন কার্বন গ্যাসের পরিমাণ যা ছিল সেই পর্যায়ে ফিরে যেতে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ২০% গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনার কথা হলেও ২০২১ সালেও এর কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। শিল্পোন্নত দেশগুলো Industry, Civilization, Growth and Development ইত্যাদির ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে একই সঙ্গে গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনার যে সমস্ত কথা বলেছেন তার অন্তরালে মুনাফা-লিপ্সাই প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে পৃথিবীর ধ্বংস ত্বারান্বিত হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার বলেই মনে হয়।

বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের দুটি মারাত্মক ঝুঁকি হচ্ছে কয়লা ও লাকড়ি পোড়ানো ইটভাটা এবং বহু ব্যবহৃত সময় অতিক্রান্ত অতিরিক্ত যানবাহন। পৃথিবীতে প্রতিবছর ১৫০০ বিলিয়ন পোড়ানো ইট তৈরি হয়। এশিয়াতেই এই পোড়ানো ইটের ৮৭.৩ শতাংশ তৈরি হয় (১৩০০ বিলিয়ন)। এশিয়াতে পোড়ানো ইটের প্রধান প্রস্তুতকারী চীন ৭৬.৯২ শতাংশ, এর পর ভারত ১৫.৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ বিলিয়ন পোড়ানো ইট প্রস্তুত হয়। (১.৩ শতাংশ)। বাংলাদেশে বাতাসে কার্বন দূষণের প্রধান কারণই হচ্ছে ইটভাটা, অতিব্যবহৃত যানবাহনে এবং যানজট। সরকারি হিসেবে যদিও বাংলাদেশে ৭০০০ ইটভাটা রয়েছে কিন্তু অনুমোদনহীন ইটভাটাসহ মোট সংখ্যা ১১০০০। ঢাকার উত্তরে অসংখ্য পোড়ানো ইটের ইটভাটাই ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের কারণ।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন দূষণের দিক থেকে এবং আবহাওয়া দূষণের দিক থেকে পিকিং ও দিল্লির সঙ্গে ঢাকাও পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ শহরের একটি। ১৯৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মারাত্মকভাবে বেড়ে চলেছে। ১৯৭০সালে বাংলাদেশে মাথা পিছু কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ছিল ০.০৫ টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে মাথাপিছু ০.৬৬ টন।

প্রতিবছর এই বৃদ্ধির হার ৫.৪৮ শতাংশ। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে সর্বমোট কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ছিল ৩.৩ মিলিয়ন টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১১০.২ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ বর্তমানে প্রতি বছর এই বৃদ্ধির পরিমাণ ৭.৫৪ শতাংশ।

এ কথা এখন সর্বজনবিদিত যে, বাতাসে উচ্চ কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকার কারণে বাংলাদেশে বহু জায়গায় ফসলের সমূহ ক্ষতি বেড়ে গেছে। ধানে চিটা ধরে তা অখাদ্য হয়ে পড়ছে। আর ইট ভাটার চারদিকে বসবাসকারী মানুষগুলোর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তো কল্পনাই করা যায় না।

শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুতে কার্বন দূষণের ব্যাপারটি শিশু চিকিৎসক মাত্রেই জানা আছে। শিশুদের কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ এখন আগের চেয়ে বহুগুণে বেশি। শিশু চিকিৎসকরা শিশুদের শ্বাসকষ্ট নিরসনের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্রোংকোডায়লেটর এবং নেবুলাইজার ব্যবহার করেন। এদের অনেকের শ্বাসটান চীরজীবী রোগে পরিণত হয়। শ্বাসতন্ত্রের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই শিশুরা সারা জীবনই হাঁপানিতে ভুগতে থাকে। গনিব শিশুরা ঠিকমতো চিকিৎসাও নিতে পারে না।

মুনাফাখোর ইটভাটার মালিকদের ওপর কোনো আইনি কর্তৃত্ব একেবারেই নেই। যতটুকু দেখা যায় তা লোকদেখানো মাত্র। কয়লা ও কাঠের বদলে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো সম্ভব। কিন্তু আইন রক্ষাকারীরা এ ব্যাপারে নির্বিকার। এখানে দুর্নীতি কাজ করছে তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারপরও অবৈধ ইটভাটা যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশে পরিবেশের এই বিষয়টি নিয়ে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বলি বা জাতীয়ভাবেই বলি রাজনৈতিক নেতারা যে এ যাবত পর্যন্ত প্রবল দায়িতজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে সত্য। এ ব্যাপারে একটা গণপ্রচারণা শুরু করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানভিত্তিক বায়ুদূষণরোধ করার কর্মকাণ্ডের জন্য দেরি করার সময় আমাদের নেই। নইলে শুধু শ্বাসতন্ত্র নয়, শিগগিরই আমাদের গায়ের চামড়াও পুড়তে শুরু করবে।

লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ

এ বিভাগের আরো খবর