বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাংবাদিক কি প্রতিপক্ষ?

  •    
  • ৫ মে, ২০২১ ১১:৫০

কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে? উত্তর সহজ, যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ, একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করে, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ, একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন দেশের সাংবাদিকরা, তথা পুরো গণমাধ্যম। সমালোচনার তিরবিদ্ধ করছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত এই খাতকে। যে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, তাদের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। যে গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় ও অনিয়ম অনুসন্ধান করে বের করে আনেন, তাদের কর্মকাণ্ডই এখন প্রশ্নের মুখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে মনে হবে, রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষই বুঝি এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। আসলে কি তাই? সাংবাদিকরা কি সবার প্রতিপক্ষ?

ঘটনার সূত্রপাত দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ‘বান্ধবী’র মৃত্যু নিয়ে। বলা হচ্ছে, এটি আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু সমালোচনার সূত্রপাত এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার নিয়ে।

সাংবাদিকতার প্রাথমিক পাঠেই বলা আছে যে, ভিকটিমের ছবি প্রকাশ করা যাবে না। প্রয়োজন হলে ছবি ব্লার বা ঝাপসা করে দিতে হবে। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা গেল উলটো কাণ্ড। দেশের দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিকটিম তরুণীর ছবিটা স্পষ্ট থাকলেও অভিযুক্তর ছবিটা ব্লার। যা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে পুরো সাংবাদিকতাকে। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাকে। এরপর শুরু হয় ওই এমডির বান্ধবীর বিরুদ্ধে কথিত অসুন্ধানী সাংবাদিকতা। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ চ্যানেলের অনলাইনের কয়েকটি শিরোনাম এরকম: ১. মুনিয়ার চার প্রেমিক! ২. লাখ টাকার ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তরুণী, ৩. অভিনেতা বাপ্পীর সঙ্গে গভীর প্রেম ছিল মুনিয়ার, ৪. মুনিয়ার ডায়েরিতে কী আছে? ৫. উনি আমাকে ভোগ করেছেন, বিয়ে করবেন না, ৬. মুনিয়ার মৃত্যু, অডিও ক্লিপ ভাইরাল। কদিন পরে এই দৌড়ে নামে কয়েকটি সংবাদপত্রও— যার মধ্যে দুয়েকটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রও রয়েছে।

গণমাধ্যমের একরকম আচরণের তীব্র সমালোচনা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। শুধু অ্যাকাডেমিক সমালোচনা নয়, অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং সামগ্রিকভাবে পুরো সাংবাদিকতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। সাংবাদিকদের প্রতি যারা নানা কারণে বিরূপ, তারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষোদ্গারের এই সুযোগটি কাজে লাগান।

করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা কতটা জিম্মি— এই ঘটনায় সেটি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এটা বোঝানো সম্ভব নয় যে, সাংবাদিকদের কতগুলো পক্ষের সঙ্গে আপস বা লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। এসব পক্ষের মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক, বিজ্ঞাপনদাতা বড় বড় প্রতিষ্ঠান, সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, উগ্রবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত সাংবাদিকদেরই বিভিন্ন সংগঠন। ফলে যখনই কোনো একটি সংবাদ কোনো গোষ্ঠীর বিপক্ষে যায়, তারাই গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করে এবং ব্যবস্থা নিতে উদ্যত হয়।

সেটি কখনও বিজ্ঞাপন বন্ধ করে; কখনও সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে; কখনও রিপোর্টারকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করে; কখনও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে দিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে; কখনও মোটা অংকের পয়সা দিয়ে সাংবাদিকদের কিনে নিয়ে; এমনকি কখনও নিবন্ধন বাতিল বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে।

পৃথিবীর আর কোনো পেশার মানুষকে এতগুলো পক্ষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় না। অথচ এই পক্ষগুলোই গণমাধ্যমের মূল অংশীজন বা স্টেকহোল্ডার। কিন্তু অনেক সময়ই এসব অংশীজন প্রতিপক্ষে পরিণত হয় এবং গণমাধ্যমকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। তার ওপর সাংবাদিকদের বিরাট অংশেরই চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পেশাদারত্ব গড়ে ওঠেনি। সুতরাং, এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় যে গোষ্ঠীকে, তাদের কাছ থেকে সব সময় নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা কতটুকু সমীচীন—তাও ভেবে দেখা দরকার।

এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যম সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই পরিবেশন করবে, মানুষের এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু গণমাধ্যম সব সময় সেটি পারে না। আবার সব সংবাদেরই যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষ আছে, ফলে একটি খবর যখন কারও পক্ষে যায়, সেটি কারও বিপক্ষেও যেতে পারে। যখনই কারও বিপক্ষে যায়, তখনই তিনি গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিও মুহূর্তেই গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবা শুরু করতে পারেন, যদি তার স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ পরিবেশিত হয়।

ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে নারায়ণগঞ্জের মৌচাক, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় বেশ কজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন। টেলিভিশনের গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, একজন রিপোর্টারের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে ‘কলেমা’ পাঠ করানো হয়েছে বলেও গণমাধ্যমের খবর বেরিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের দাবি, গণমাধ্যম ‘সঠিক সংবাদ’ প্রচার করে না, তাই এই আক্রমণ।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত সাংবাদিকরা বলেছেন, ‘ছবি তুলবি না’ বলেই তাদের ওপর হামলা করা হয়। তবে শুধু হেফাজতে ইসলামই নয়, সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও। তার মানে হলো, কোনো একটি পক্ষ যখন সাংবাদিকদের কারণে নিজেদের অন্যায় কাজটি অবাধে করতে পারে না বা করলেও সেটি সাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, তখনই তারা সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ ভাবে। এখানে লড়াইটা তখন আর সাংবাদিক বনাম হামলাকারী নয়- বরং লড়াইটা যখন সাদা-কালোর, লড়াইটা তখন শুভ-অশুভর।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালে সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে বেশ কজন সাংবাদিক নির্মম মারধরের শিকার হন। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় হেলমেটপরা একদল লোক। তাদের কারো কারো পরিচয়ও তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ, ধানমন্ডি ২ নম্বর ও জিগাতলা এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। কারো কারো ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। হুমকি-ধমকি দিয়ে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার পাশাপাশি ছবি তুললে পেটানো হবে বলে শাসানো হয়।

সবশেষ নোয়াখালীতে এক সাংবাদিক খুন হয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কাদের মির্জার ‘মিথ্যাচারের’ প্রতিবাদে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি বিকেল পাঁচটায় বাজারসংলগ্ন তার বাড়ি থেকে বের হয়ে চাপরাশিরহাট মধ্যম বাজারে গেলে কাদের মির্জার অনুসারীরা মিছিলে হামলা চালায়। এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলি চলাকালে কর্তব্যরত দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার নোয়াখালী প্রতিনিধি বুরহান উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। পরের দিন রাত পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এখানে সাংবাদিক কারও প্রতিপক্ষ ছিলেন না। কিন্তু দুপক্ষের রেষারেষিতে প্রাণ গেছে। অর্থাৎ সাংবাদিকরা একদিকে নানা গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ, অন্যদিকে বিবদমান গোষ্ঠীর ক্রসফায়ারেও পড়েন। কিন্তু এ যাবত যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তার বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।

যে সাংবাদিকরা সব অন্যায়ের বিচারের কথা লেখেন, সেই সাংবাদিকদের নিহত হওয়া বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও তাদের পাশে কেউ থাকে না। বরং সুযোগ পেলেই গালাগালি আর বিষোদ্গারের ডালি খুলে বসে। যে সাংবাদিকরা পোশাক ও পরিবহন শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষের বেতন বৈষম্য ও মানবাধিকারের কথা লেখেন, প্রচার করেন, সেই সাংবাদিকদের নিজেদের বেতনের দাবিতেই রাজপথে দাঁড়াতে হয়। তাদের পাশে অন্য পেশার মানুষ এসে দাঁড়ায় না। যার সবশেষ উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ। নিয়মিত বিরতিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সবশেষ মাসের বেতনও অনেকে পান না। কিন্তু এসব বঞ্চনার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়।

সাংবাদিকরা যুগে যুগেই ক্ষমতাসীন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের প্রতিপক্ষ হিসেবে আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটা সময় পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সর্বহারা পার্টির লোকদের বড় টার্গেট ছিলেন সাংবাদিকরা। সেই আতঙ্ক কেটে গেলেও এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবে অন্যান্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, যেমন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিকরা মাঝেমধ্যেই আন্দোলনে নামেন।

সাংবাদিকরা তাদের সেই আন্দোলনের খবর দেন। টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। পাটশ্রমিকদের প্রতি সাংবাদিকরা বরাবরই সংবেদনশীল। অথচ এই শ্রমিকরাই সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন বলে অভিযোগ আছে। অপরদিকে শ্রমিকদের অভিযোগ, সাংবাদিকরা তাদের খবর যথাযথভাবে পরিবেশন করেন না। বাস্তবতা হলো, শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় বন্ধু এই সাংবাদিকরাই। কিন্তু শ্রমিকরা তাদেরকেই প্রতিপক্ষ ভাবেন। পরিবহন শ্রমিকরাও মাঝেমধ্যে নানা দাবিতে রাস্তায় নামেন। সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সেই খবর প্রকাশ ও প্রচার করলেও সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে পরিবহন শ্রমিকদের হামলার শিকার হন।

কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে? উত্তর সহজ, যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করেন, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ফলে তিনি অন্যায়টি প্রকাশ ও প্রচার করবেন। অপরাধীদের ভয় এখানেই।

এটা ওপেন সিক্রেট যে, পুলিশ বা অন্য যেকোনো পেশার অসৎ লোকেরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না বা তোয়াজ করে না। ফলে সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়। ক্ষমতাবানরা জানে, তাদের অন্যায় কাজগুলো দেশের মানুষ শুধু এই সাংবাদিকদের কারণেই জানতে পারে। না হলে দেশ বহু আগেই লুটপাট করে খেয়ে ফেলত তারা। কিন্তু যেহেতু তারা এই অবাধ লুটপাট করতে পারে না শুধু গণমাধ্যমের ভয়ে, তাই গণমাধ্যমই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ; শত্রু।

নির্মম বাস্তবতা হলো, একজন রাজনৈতিক নেতা যখন বিপদে পড়েন, তিনি প্রথম ফোনটা করেন তার ঘনিষ্ঠ কোনো সাংবাদিককে। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী- প্রত্যেকেই বিপদে পড়লে প্রথম ফোনটা সাংবাদিককে করেন। তাদের ধারণা বা বিশ্বাস, সাংবাদিকরা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে না পারলেও অন্তত উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন। অথচ এই লোকগুলোই সুযোগ পেলে সকাল-সন্ধ্যায় সাংবাদিকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। কিন্তু সাংবাদিক যখন রাস্তায় মার খান, সাংবাদিককে যখন রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা পেটায়, সাংবাদিককে যখন পুলিশ পেটায়, সাংবাদিককে যখন আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনবিরোধীরা পেটায়—তখন সাংবাদিক কাকে ফোন করবে? সাংবাদিক কার কাছে বিচার চাইবে?

মুদ্রার অন্যপিঠও আছে। সাংবাদিকতার নামে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া, করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ভুইফোঁড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা, কথিত অনলাইন টিভি ইত্যাদি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সাংবাদিকতার নামে নানারকম ধান্দাবাজির কারণে পুরো গণমাধ্যমই এখন প্রশ্নের মুখে। যে কারণে যখনই গণমাধ্যমের নেতিবাচক কোনো খবর গণমাধ্যমে আসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়, মানুষের রাগ-ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। যে গণমাধ্যম তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, সেবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়। অনেকে সাংবাদিকদের প্রতি অতীতের কোনো ঘটনায় ক্ষুব্ধ বা ঈর্ষান্বিত থাকলে তিনিও সেই বিষোদ্গার ও গালাগালির মিছিলে শামিল হন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করবেন না যে, এই সীমিত স্বাধীনতা ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমই দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কারণ চারপাশে এত বেশি খারাপ লোকের আধিপত্য যে, তারা কেবল ক্যামেরাগুলোকেই ভয় পায়। না হলে বহু আগেই সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে যেত। যেহেতু সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে হজম করার পথে প্রধান অন্তরায় গণমাধ্যম, অতএব তারাই শত্রু, তারাই প্রতিপক্ষ।

রাষ্ট্রও জানে তার সব কার্যক্রমে নজর রাখে গণমাধ্যম। ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের মতো গণমাধ্যমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে বা মামলা দিয়ে শায়েস্তা করা না গেলেও রাষ্ট্র এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখতে চায়, যাতে গণমাধ্যম নিজেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে এবং সেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে গিয়ে অন্যদিকে নজর দেয়ার সুযোগ না পায়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর