বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঘুষ: সমাজের ক্ষয় ও ক্ষরণ

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ৪ মে, ২০২১ ১৫:৫৯

বাস্তবতা হলো জনগণকে একটি ঘুষনির্ভর সমাজে বাস করতে হচ্ছে। এ ধরনের সমাজে বাস করতে নাগরিকের বিশেষ কিছু দক্ষতা লাগে। এমন দক্ষতা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না। যারা এসব দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না তারা পিছিয়ে পড়েন, কখনও কখনও হতাশায়ও ভোগেন। বিরক্ত হয়ে চলে যেতে চান দেশ ভূগোলের বাইরে।

ঘুষ দেয়া বা নেয়া বর্তমান সমাজে যেন এক অনিবার্য পরিণতির নাম। ঘুষহীনতা মানেই স্থবিরতা। সেবা বা কাজ না পাওয়ার আশঙ্কা। ঘুষ কেবল ঘুষ গ্রহীতার শ্রী বাড়ায় না, একই সঙ্গে বাড়ায় তার অফিসের পরিপাটি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে- এটি মানসম্মত কর্মপরিবেশ। নীতিহীন কিছু নেই। অফিসের আবহ ও এর দৃশ্যমানতা প্রশ্ন করার সক্ষমতা হারিয়ে দেবে। উত্তর-আধুনিকতার তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো যাকে চিহ্নিত করেছেন- ভিজিবিলিটি ইজ এ ট্রাপ হিসেবে। অর্থাৎ দেখানদারিটাই একটা ফাঁদ।

এ প্রসঙ্গে গত ২৭ আগস্ট ২০১৯ একটি দৈনিক পত্রিকায় ড. সলিমুল্লাহ খান ‘আহমদ ছফার গব্যপুরাণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন “ঘুষ ফারসি শব্দ, আদি অর্থ ‘কান’। কানে ফিসফিস করিয়া যে টাকা গছাইয়া দেওয়া হয় তাহাকেই ‘ঘুষ’ বলে। এইক্রমে শব্দ কিংবা বাক্য যাহা ঘুষ পর্যন্ত পৌঁছায় তাহার নাম ‘ঘোষণা’। এমনকি ঘুষ অর্থাৎ কান বরাবর যে আঘাত তাহার নাম ‘ঘুষি’।”

কি সরকারি কি বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই ঘুষ জীবন্ত সত্তা। উন্নয়নের যজ্ঞের বৃহৎ ক্যানভাসের পেছনে রয়েছে ঘুষকেন্দ্রিক নেক্সাস। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে রেন্ট সিকিং ইকোনমি। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থেকেও যারা নানাভাবে লাভ তুলে নেন তারা হলো রেন্ট সিকার। ঘুষ একক ব্যাপার নয়, এর রয়েছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎদলীয় তৎপরতা। ঘুষ অনেক পক্ষের পারস্পরিক সমঝোতামূলক অপতৎপরতা।

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দেশের এক বৃহৎ উন্নয়ন সংস্থার ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছে, সেখানে ঠিকাদারকে কাজের মোট টাকার ওপর শতকরা ৮-১০ ভাগ ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ এখন সিস্টেমেটিক ব্যাপার, সহনশীল ও গ্রহণযোগ্য প্রবণতা।

ঘুষ ফাইলের গতিশীলতা বাড়ায়। দেশ যে অর্থনৈতিকভাবে এগোচ্ছে তার পেছনে ঘুষের ব্যবহার উপযোগিতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, যেখানে ঘুষ নেই সেখানে নেই কর্মস্পৃহা, উদ্যোম। ঘুষ মানেই গতি।

ঘুষের হিসাব কষতে ঘুষজীবীরা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। অর্থাৎ একটি কাজ পেতে বিভিন্ন স্তরে কতভাগ ঘুষ দিতে হবে তার সুনিপুণ হিসাব কষা হচ্ছে। বালিশ ক্রয়, সরকারি অফিসে বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ে দুর্নীতির প্রতিবেদন দেখে পাঠক আহত হন, উদ্বিগ্ন হন। এ আহত বা উদ্বিগ্নতা যত না ঘুষের কারণে তার চেয়েও ঘুষের পরিমাণগত অস্বাভাবিকতার কারণে। এ অস্বাভাবিকতাই হলো ‘ঘুষ শক’। ঘুষের পরিমাণ সহনশীল মাত্রায় থাকলে তা সংবাদ হতো না বা পাঠক আহত হতেন না। বিভিন্ন ধরনের কাজ ও সেবা পেতে ঘুষের পরিমাণ নিয়ে মোটামুটি একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়ে গেছে। সেবা গ্রহীতা ঘুষ প্রদানে এক সহনশীল অভ্যাসের আওতায় চলে এসেছেন। কারণ, তারা বুঝে গেছেন কাজ উদ্ধারে এছাড়া আর ‘উন্নত’ কোনো বিকল্প নেই।

যাদের ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়, তারা ঘুষের পরিমাণ পূর্বানুমান করতে পারেন, ঘুষ বরাদ্দ রাখেন। কোনো কারণে কর্তৃপক্ষ ঘুষ না নিতে চাইলে বা কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশানুসারে ঘুষ দিতে না পারলে তাদের মন খারাপ হয়। ঘুষ দিতে পারাটা অনেকের কাছে আনন্দ ও বিশেষ দক্ষতার বিষয়। যারা ঘুষ দেন তারাও একে বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন। একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অনুসরণ করে তা কয়েকগুণ সুদে আসলে তা তুলে নেন। ঘুষের চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয় জনগণকে। কারণ, সরকারি টাকার মালিক জনগণ।

গ্রামের একজন কৃষক যিনি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলেছেন তিনিও চারটি গরু লালন-পালন করেন সন্তানের চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হবে এ আশঙ্কায়। ঘুষ ছাড়া যে কিছু হবে না, সবাই তা জেনে গেছে। মানুষ একবার যা জেনে যায় বা দেখে ফেলে, তা আর অদেখা বানানো যায় না। নিজের কাজ উদ্ধারে চাহিদামাফিক ঘুষ সরবরাহ কমবেশি সবার রয়েছে মানসিক প্রস্তুতি। অর্থাৎ, মানুষ সিস্টেমটা বুঝে গেছে। কিছু উপরি খরচ না করলে কাজ হবে না।

ঘুষ বাস্তবতায় সৎ থাকা ব্যয়বহুল ও পরিশ্রমসাধ্য। ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে না পারলে আপনি এ যুগের উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হবেন না। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ফ্ল্যাটের মিউটেশনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে কমপক্ষে দশবার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ঘুরেছি। দুজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারকে ফোন করিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি।

কত রকমের কাগজের চাহিদা অফিস তৈরি করল। কাগজ দিয়ে শেষ হয় না। আমাকে বার বার অফিসে দেখে এক অফিস পিয়ন বলল-এভাবে হবে না। আমাদের অফিসের সঙ্গে কিছু লোক কাজ করেন তাদের ধরেন। তিনি সদয় হয়ে একজনের মোবাইল নম্বর দিলেন। যোগাযোগ করলাম। মধ্যস্থতাকারীর চাহিদামতো অর্থ দিলাম যা-সরকারি নির্ধারিত ফিয়ের চেয়ে কয়েক শতগুণ বেশি। তিন দিনের মাথায় কাজ হয়ে গেল। বুঝতে অবশিষ্ট থাকলো না সৎ থাকাটা নৈতিকতার দিক থেকে উন্নত চয়েস হলেও সার্বিক বিবেচনায় তা স্বাস্থ্যকর নয়।

নৈতিকতার গুরুত্ব ছোট করে দেখছি না। কিন্তু এর মূল্য আজ অনেক বেশি। নৈতিকতা ধরে রাখতে গিয়ে জরুরি প্রয়োজনে আপনি সেবাটি না-ও পেতে পারেন। যেমন, জরুরি পাসপোর্টের কথা ভাবুন। সুন্দর সুন্দর কথাগুলো কাগজে থাকে, থাকে নীতি-পরিকল্পনা ও বিজ্ঞাপনে। কিন্তু তা প্রকৃত বাস্তবতা নয়।

বাস্তবতা হলো জনগণকে একটি ঘুষনির্ভর সমাজে বাস করতে হচ্ছে। এ ধরনের সমাজে বাস করতে নাগরিকের বিশেষ কিছু দক্ষতা লাগে। এমন দক্ষতা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না। যারা এসব দক্ষতা অর্জন করতে পারেন না তারা পিছিয়ে পড়েন, কখনও কখনও হতাশায়ও ভোগেন। বিরক্ত হয়ে চলে যেতে চান দেশ ভূগোলের বাইরে।

ঘুষ রোধে যে গবেষণা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আলোচনা, পরিপাটি পোশাক আর চোস্ত ইংরেজিতে উপস্থাপনা এবং বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের খাবার প্যাকেট- এগুলোও যে সম্পন্ন দুর্নীতিহীন কর্মপ্রয়াস এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে এখানে চলছে একধরনের গণমাধ্যম সহায়ক প্রদর্শনবাদ, যা গুটিকয়েককে দুর্নীতিবিরোধী মুখপত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। এটি চলছে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রই। এসব কর্মতৎপরতা বিশেষ কোনো সুফল দিতে পারছে না। দুর্নীতিও বন্ধ হচ্ছে না। ইংরেজি কনিভিয়েন্স শব্দের অর্থ হলো অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলার সময় যদি বাধা না দেয়া হয়, চুপচাপ থাকা হয় বা মৌনসম্মতি দেয়া হয়- এমন পরিস্থিতি ঘুষ সংস্কৃতিকে তরতাজা করতে সহায়তা করছে। দেশে কনিভিয়েন্স কালচার তৈরি হয়েছে পোক্তভাবেই।

অফিসগুলোতে যে পরিসরে প্রবেশগম্যতা ঠিক ততটুকু পরিসরে আপনি ঘুষ দেখতে পাবেন। কিন্তু এটি শেষ কথা নয়। এর বাইরেও রয়েছে ঘুষের বিস্তৃত পরিধি। যেমন, ২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয় যে, অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে লেগেছে ২,২৭০ কোটি টাকা ঘুষ।

আকবর আলি খানের বিখ্যাত বই পরার্থপরতার অর্থনীতি-এর একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। মূলত এ অংশে ঘুষ ও দুর্নীতি নিয়ে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক এ অংশে মাইকেল ক্যারিট যিনি ১৯২৯ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং চাকরি ছাড়ার পঞ্চাশ বছর পর যে স্মৃতিকথা লেখেন তা থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন-

‘‘ইতোমধ্যে পাঞ্জাবি লোকটি কপট বিনয়ের সঙ্গে মাফ চাইল। তারপর সে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে তার মুখস্থ বক্তৃতা ঝাড়লো: হুজুর হচ্ছেন মহানুভব ব্যক্তি। এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যাঁরা ঘুষ খান না, যেমন আপনি। আছে বদলোক যারা ঘুষ খায় এবং (আমার চোখের দিকে চেয়ে) আছে শুয়রের বাচ্চারা যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো সাহায্য করে না। সালাম। (হুজুর সালাম)।” স্মৃতিকথার উপসংহারে মাইকেল ক্যারিট লিখেছেন যে, তিনি তার দীর্ঘ জীবনে সজ্জন, বজ্জাত ও শুয়রের বাচ্চা-তিন কিসিমের লোকই দেখেছেন।

অনলাইনভিত্তিক ‘বিশ শব্দের গল্প গ্রুপে’ একটি গল্প বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গল্পটি হলো- অফিসে ঘুষের টাকা ভাগবাটোয়ারা চলছে। একজন ফাঁকিবাজ কর্মচারীকে ঘুষের টাকার ভাগ দেয়া হচ্ছে না। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ঘুষের টাকার ওপর কী তার নায্য হক নেই? গল্প তো সমাজ বাস্তবতার প্রতীকী উপস্থাপন যে সমাজে ঘুষের টাকার ওপর নায্য হক প্রতিষ্ঠিত হয় সে সমাজের ক্ষয় ও ক্ষরণ কত গভীর তা সহজেই অনুমেয়।

ঘুষের টাকায় গড়ে উঠছে এক নতুন শ্রেণি। এ শ্রেণিভুক্ত সকলে যে বড় পদের চাকরি করেন এমন নয়। ঘুষের অর্থবিনিয়োগ করে তারা আপন অর্থনৈতিক গড়ে তুলছেন, নির্মাণ করছেন নিজের কপাল। একধরনের গভীর অপরাধবোধ থেকে ধর্মীয় কাজ ও সহায়-সম্বলহীনদের সহায়তায় কখনও কখনও এগিয়ে আসছেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে দেশ-বিদেশে পড়াশুনা করাচ্ছেন। ঘুষের এসব উৎপাদক আগামী দিনে বাংলাদেশের সকল সেক্টরে নেতৃত্ব দেবে। মন্দ কী!

সরকারি ও উন্নয়ন সংযোগীদের ঘুষ বা দুর্নীতি প্রতিরোধে নীতি, আইন ও কাঠামোর অভাব নেই। কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা সবার জানা। ঘুষ বন্ধে কার্যকর রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। হ্যাঁ, অঙ্গীকার তো আছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। অঙ্গীকার করলে তো হবে না তার বাস্তবায়ন জরুরি। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- a promise is a cloud, fulfillment is rain অর্থাৎ অঙ্গীকার হলো মেঘ আর এর পূর্ণতা হলো বৃষ্টি। বাংলাদেশ হলো অঙ্গীকারের মেঘমালা, যেখানে সামান্যই বৃষ্টি ঝরে, অঙ্গীকারগুলো পূর্ণতা পায়। ঘুষ বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের চেয়ে উন্নত কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর