৩ মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলমের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, আরেকটি ‘বদর যুদ্ধের’ ডাক দিয়েছিল হেফাজত। রমজান মাসে বদরের যুদ্ধ হয়েছিল। তাই গত ২৬ মার্চ শুরু হওয়া হেফাজতের সহিংসতা রমজান পর্যন্ত টেনে আনার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানান তিনি। রমজানে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ছিল হেফাজতের। কাগজে-কলমে অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও হেফাজতের কজন নেতা ছিলেন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী। হেফাজত ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন তারা। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর পাশাপাশি সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন হেফাজত নেতারা এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তাণ্ডব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ভয়ংকর সহিংসতায় এর ইঙ্গিত মেলে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে দেশের বাইরে থেকে কোটি কোটি টাকাও সংগ্রহ করা হয়। পরিকল্পনা এখানেই থেমে ছিল না। ক্ষমতা দখলের কৌশল রপ্ত করতে কেউ কেউ পাকিস্তানে দীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের উগ্র রাজনৈতিক সংগঠন তেহরিক-ই লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)-কে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দীক্ষা নেন তারা। হেফাজতের খিলাফত প্রতিষ্ঠার অভিলাষে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সম্পৃক্ততার তথ্যও মিলেছে।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)-এর আদেশ-নির্দেশ ও বিধান প্রতিষ্ঠায় কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধাচরণ করার কথা নয়। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ও মডেল অনুসরণ করে হেফাজতে ইসলাম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা ইসলামসম্মত কি? রাসুল (সাঃ) শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। আরবে তখন জাহিলিয়াতের সময় তথা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ ছিল। তাগুতের তথা পথভ্রষ্টদের শাসন ছিল। তিনি কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইসলাম প্রাতিষ্ঠা করেছিলেন? বদর যুদ্ধ হয়েছিলে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে। হেফাজতের আরেকটি ‘বদর যুদ্ধে’ কাফের প্রতিপক্ষ কে? বদর যুদ্ধ তো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যুদ্ধ ছিল না। মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আবু সুফিয়ান ও তার দল শাম থেকে অস্ত্র নিয়ে মক্কা ফিরছিল।
মুসলমানরা কাফেরদের ভবিষ্যৎ আক্রমণের কথা ভেবে আত্মরক্ষার্থে আবু সুফিয়ানকে আটকিয়ে অস্ত্র জব্দ করতে চেয়েছিল। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠান। মক্কায় প্রচার হয় মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এখানেই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে এটি বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ যা মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরিতে সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের সোনালি দিনের সূচনা করেন। বদরের যুদ্ধ ছিল সত্য মিথ্যা তথা হক্ক ও বাতিলের মধ্যে যুদ্ধ। আরেকটি বদর যুদ্ধে কে হক্ক আর কে বাতিলপন্থি? রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার ওপর ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন-
“তোমরা নির্দেশ পালন কর আল্লাহ, রাসুল ও তোমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবানদের।” (সুরা নিসা: ৪৯)।
রাষ্ট্রে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন-
“পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না”। (সুরা কাসাস: ৭৭)।
ইসলাম শাসকশ্রেণির আনুগত্যের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিলেও অন্ধভাবে সব অন্যায়কে মাথা পেতে নিতে নির্দেশ করে না। ইসলাম বিভিন্ন অন্যায় কাজে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অবকাশ রেখেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অনুমতি দেয় না। রাসুল (সা.) বলেছেন-
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো, অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলা।” (তিরমিজি, ২১৭৪)। তবে স্মরণ রাখতে হবে, শাসকের অবাধ্যতা কেবল ধর্ম ও আল্লাহর নাফরমানির কারণেই বৈধ। অন্য ক্ষেত্রে নয়। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন-
“মনে রেখো, যে ব্যক্তি কোনো শাসককে আল্লাহর নাফরমানিমূলক কাজ করতে দেখে, সে ওই কাজকে মন্দ বলবে। তবুও তার আনুগত্য ত্যাগ করা যাবে না।” (বোখারি, ৪৭৬৮)।
রাসুল (সাঃ) অন্য এক হাদিসে বলেছেন-
“রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত অপরিহার্য, যতক্ষণ সে আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ না করে।” (বোখারি, ২৯৫৫)
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) আরও বলেন-
“আমার পরে এমন শাসক আসবে, যে আমার দিকনির্দেশনার ওপর চলবে না। আমার আদর্শ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করবে না। তাদের মধ্যে এমন লোকও হবে, যাদের অন্তর হবে শয়তানের অন্তর। তখনও শাসকের কথা শুনবে, মানবে। যদিও সে তোমাকে প্রহার করে, তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়। তখনও তার আনুগত্য করবে। বিদ্রোহ করবে না।” (মুসলিম, ৪৭৪৮)
প্রশ্ন হলো, কতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারবে না? রাসুল (সা.) বলেন-
“নিশ্চয়ই তোমাদের ওপর এমন শাসক নিযুক্ত করা হবে, যার কিছু কাজকে তোমরা ভালো বলবে, কিছু কাজকে মন্দ বলবে। যে ব্যক্তি অন্যায়কে অপছন্দ করবে, সে (গুনাহ থেকে) দায়মুক্ত থাকবে। তবে যে অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থেকে তাকে অনুসরণ করবে সে গুনাহগার হবে। সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামাজ পড়ে’। (মুসলিম, ৪৭৬৪)
হজরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুসলমানদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তাতে সাহাবায়ে কেরাম কেউ কেউ নিজ ইজতেহাদ অনুসারে কোনো একপক্ষে যোগ দিলেও অন্যরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করেননি। হজরত উসামা (রা.) হজরত আলী (রা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি যদি কোনো বাঘের উদ্ধত থাবার সম্মুখেও হতেন, আমি আপনার সঙ্গ দিতাম। কিন্তু গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকে আমি বৈধ মনে করি না’। (বোখারি, ৭১১৩)।
ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করা ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, সামনে অনেক মন্দ বিষয়াবলি ঘটবে। কাজেই যে ব্যক্তি জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় অনৈক্য সৃষ্টি করবে, তরবারি দ্বারা তার মাথা উড়িয়ে দাও। সে যেই হোক না কেন।” (মুসলিম, ৪৭৫৯)
নাগরিকের দায়িত্ব হলো, ভালো কাজে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা ও মন্দ কাজে বাধা দেয়া। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-
“তোমরা শুভ কাজ ও খোদাভীরুতার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা কর, আর পাপ ও খোদাদ্র্রোহিতার কাজে সহযোগিতা করবে না”। (সুরা মায়েদা: ২)
মন্দ কাজে বাধা দেয়া মানে রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নয়। রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য করার জন্য ইসলাম যেমন আদেশ দিয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করার জন্য এবং রাষ্ট্রে অরাজকতা সৃষ্টি না করার জন্য কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। কুরআন, হাদিসের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ‘আরেকটি বদর যুদ্ধের’ ডাক দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে ভয়ংকর ফিতনা সৃষ্টি কি হক্কপন্থির কাজ হবে? হেফাজত যে পাকিস্তানকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছেন সে পাকিস্তান তো প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রসমূহের কাতারে। পাকিস্তান খেলাফতের মডেল হতে পারে না। ‘পাকিস্তান খেলাফত’কে অস্বীকার করে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেলুচিস্তান ও সিন্ধু পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে বহু বছর ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করছে। অর্থনৈতিকভাবে ও উগ্রবাদে ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংসদে।
এই প্রস্তাবটির পক্ষে ৬৮১ এবং বিপক্ষে মাত্র ৬টি ভোট পড়ে। ইইউর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে দেয়া বিশেষ ব্যবসায়িক অধিকার (জিএসপি স্ট্যাটাস) অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাতিল করা হবে। এর কারণ হিসেবে পাকিস্তানে মৌলবাদীদের আধিপত্য ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে কঠোর আইন ব্যবহারের অভিযোগকে তুলে ধরা হয়েছে। এমনিতেই পাকিস্তানের অর্থনীতির ভয়ংকর রকম খারাপ অবস্থা, এর মধ্যে ইইউর এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরপরও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে কেন পাকিস্তানি দীক্ষা?
হেফাজতের কিছু নেতা পাকিস্তানের যে দলকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেই তেহরিক-ই লাব্বাইক পাকিস্তান তথা টিএলপিকে উগ্রপন্থি আচরণের দায়ে পাকিস্তান সরকার দুই সপ্তাহ আগে নিষিদ্ধ করেছে। ফ্রান্সে মহানবী (সাঃ)-এর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশের ঘটনার জেরে পাকিস্তানে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামে টিএলপি। টিএলপি-প্রধান সাদ রিজভীকে গ্রেপ্তার করে সরকার। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশটির প্রধান প্রধান শহরে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করে টিএলপি কর্মী-সমর্থকরা। টিএলপির সন্ত্রাসী হামলায় দুজন পুলিশ নিহত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও ৩৪০ সদস্য গুরুতর আহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা এবং জনসাধারণের জানমালের ক্ষতি করার অভিযোগে পাকিস্তান টিএলপিকে নিষিদ্ধ করেছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া পাকিস্তান যদি টিএলপিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়, তাহলে হেফাজত কেন পাকিস্তান থেকে টিএলপি মডেল আমদানি করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়? হেফাজতে ইসলাম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে যুদ্ধ শুরু করলে প্রতিপক্ষ নিঃসন্দেহে বসে থাকবে না। কেউ রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে উঠলে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পালটা জবাব দেবে এটাই স্বাভাবিক। শুরু হবে গৃহযুদ্ধ, যুক্ত হবে নানা পক্ষ। এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলাফল আমাদের চোখের সামনে।
এরপরও হেফাজত বাংলাদেশকে কেন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, সোমালিয়া বানাতে চায়? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই হেফাজত খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলো, টিকিয়ে রাখতে পারবে কি? কাদের সমর্থন নিয়ে খেলাফত চালাবে হেফাজত? মুসলিম উম্মাহর চোখের সামনে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র কেড়ে নিলো ইহুদিরা। চার দশক ধরে মিয়ানমারের মুসলমানরা গণহত্যা, ধর্ষণ, রাষ্ট্র থেকে বিতাড়নসহ নানা জুলুমের শিকার হলো মুসলিম উম্মাহ কতটুকু কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে? আর উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ তো মুখে কুলুপ এটেছে। হেফাজতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল জরুরি কেন? হেফাজতের বিবেচনায় বাংলাদেশে তাগুতের শাসন পরিচালিত হচ্ছে।
যদি ধরে নিই তাদের বক্তব্য সত্য, তাহলে প্রশ্ন হলো রাসুল (সাঃ) যখন পৃথিবীতে আসেন তখন জাহেলি তথা অন্ধকারের যুগ ছিল, তাগুতের শাসন ছিল। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কি তাগুতের শাসন পরিবর্তনের জন্য জোর করে, নেতিবাচক পন্থায়, নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করেছিলেন? রাসুল (সাঃ) তার সাহাবিদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে উগ্র বক্তব্য দিতেন, না সুন্দর ব্যবহার, উত্তম চরিত্র, আল্লাহর পথে আহ্বান, আত্মগঠন ও সমাজ-সংস্কারের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন? আপনারা তাহলে কার অনুসরণ করছেন? আল্লাহর আইন বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হলে তা শুধু আল্লাহর কুরআন ও রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথেই করতে হবে। ইসলামের নামে কোনো শায়খের খামখেয়ালিপনা কিংবা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শবিরোধী পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন-
“হে নবী, লোকদের বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অসীম দয়াবান। তাদের বলুন আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য প্রকাশ কর। এরপর বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না”। (সুরা আল ইমরান:৩১-৩২)।
কুরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন-
“নিঃসন্দেহে রাসুলের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। অবশ্য তাদের জন্য, যারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের ও পরকালীন মুক্তির ব্যাপারে আশা রাখে এবং যারা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে”। (সুরা আহযাব: ২১)
জিহাদের আহ্বান কে করতে পারে? যদি যে কেউ জিহাদের আহ্বান ও নেতৃত্ব দিতে পারত, তাহলে মুসলমানরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে জিহাদের ডাক দিত, আর সেক্ষেত্রে নিশ্চিত বিশৃঙ্খলা, নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যেত। ইসলামে বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয় সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই, বরং বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়কে কুরআনে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামে একমাত্র মনোনীত নেতাই জিহাদের আহ্বান ও নেতৃত্ব দিতে পারেন। রাসুল (সাঃ) বলেন-
“রাষ্ট্রপ্রধান হলেন ঢাল, যাকে সামনে রেখে কিতাল বা যুদ্ধ পরিচালিত হবে।” (বুখারী, ৫৫৩, ১০২৬; মুসলিম ১৪৭১)
সাহাবীগণ কখনই রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে যুদ্ধ বা কিতালে লিপ্ত হননি। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ইসলামি জ্ঞান শিক্ষার কথা বলে ভর্তি করে তাদেরকে ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে, জিহাদের ভুল মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, অরাজকতার জন্য রাস্তায় নামিয়ে দেয়া, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকের শিকারে পরিণত করা শিক্ষার্থীদের আভিভাবকের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার বরখেলাপ নয় কি? ধর্মের জন্য যদি সন্ত্রাস হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হেদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে (সীমালঙ্ঘনকারী, আল্লাহদ্রোহী, বিপথগামী) অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হওয়ার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (সুরা বাকারা:২৫৬)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আরও বলেছেন-
“আর যদি আপনার প্রভু ইচ্ছা করতেন তাহলে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী সব মানুষকেই একসঙ্গে বিশ্বাসী বানিয়ে ফেলতে পারতেন। সুতরাং (হে মুহাম্মদ) আপনি কি তাহলে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য লোকদের জবরদস্তি করতে চান?” (সুরা ইউনুস : ৯৯)।
ইসলামে জিহাদ বা কিতাল তথা যুদ্ধের বৈধতার সর্বপ্রথম শর্ত হলো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। কিতাল বা জিহাদ কখনই ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়।
ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম দাওয়াত বা প্রচার। কিতাল বা যুদ্ধ হলো প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সংরক্ষণ, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তার মাধ্যম। রাসুল (সাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। দাওয়াতের ভিত্তিতে মদিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামি জীবনব্যবস্থা মেনে নেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করেন। যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিতাল বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসলাম অনেক শর্ত আরোপ করেছে। সেগুলোর অন্যতম হলো- রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা ও রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি, রাষ্ট্র বা মুসলিমদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া, সন্ধি ও শান্তির সুযোগকে প্রাধান্য দেয়া ও কেবলমাত্র যোদ্ধা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা। অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল কখনই ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ বা কিতাল নয়। তাই আরেকটি বদর যুদ্ধের ডাক কোনোভাবেই ইসলামসম্মত নয়।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।