১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় সেটা যে ভুল সিন্ধান্ত ছিল তার প্রমাণ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালিরা হাজার বছর ধরে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে একে অপরের ভাই ভাই হয়ে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে।
সাম্প্রদায়িকতার থেকে বড় ছিল মানবতাবাদ। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হলেও পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মনেপ্রাণে কখনও সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ তাদের আকৃষ্ট করেনি। আর এটাই পাকিস্তানি শাসকদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে ওঠে। এর প্রথম আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর। তাদের ধারণা ছিল বাংলা ভাষাটি নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানি ভাবধারাকে মনোজগতে ঢুকিয়ে দিলে হয়তো বাঙালিদের পালটে দেয়া যাবে। কিন্তু বাঙালিরা পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মেনে নেয়নি; বরং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিতে শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়েই বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়।
বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের নামে বাঙালিকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। বাঙালিদের নিজেরই একটি আত্মপরিচয় দরকার। ধীরে ধীরে তিনি সে লক্ষ্যেই এগিয়েছেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে যে রাজনৈতিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু মুজিব সংগঠনটির দায়িত্বে আসার পরই ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে অসাম্প্রদায়িক গণমানুষের দলে পরিণত করেন।
আওয়ামী লীগ সংগঠনটিকে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই সিন্ধান্তটি মোটেও সহজ সাধ্য ছিল না। কিন্তু সিন্ধান্তটি যে শতভাগ সঠিক ছিল সেটিই প্রমাণিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, আদিবাসী সকলেই অংশগ্রহণ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। এই চেতনাকে ধারণ করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। যে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবন’তে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখছেন-
“আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি এটি নিজে বিশ্বাস করতেন এবং ধারণ ও লালন করতেন। এই আদর্শকে ভিত্তি করেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানেও জাতীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দিয়েছেন।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান পাস করার প্রাক্কালে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন-“ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব- ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”
১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে আরও বলেছিলেন, উপমহাদেশের গত কয়েক যুগের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের মূল কারণ সাম্প্রদায়িকতা। আবার দলীয় নেতাকর্মীদেরকেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাবধান থাকতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। সেজন্যই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আরেক মুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। যারা এ বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন না করতে পারে।”
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে গিয়েছিলেন জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে। সেখানে বৈঠক হয় কিউবার জাতীয়তাবাদী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি, সৌদি বাদশা ফয়সলের সঙ্গে। মুয়াম্মার গাদ্দাফি বঙ্গবন্ধুকে শর্ত দিয়েছিলেন যে, যদি বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় তাহলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন।
সেদিন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, এটি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সবার। সৌদির বাদশা ফয়সলকেও বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, ইন্দোনেশিয়ার পর সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাংলাদেশে তারপরও কেন আমাদের স্বীকৃতি দিচ্ছেন না?। সৌদি আরবও শর্ত দিল বাংলাদেশকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ করতে হবে। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এখানে এক কোটিরও বেশি অমুসলিম রয়েছে। সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, নির্যাতিত হয়েছে। এদের বাদ দিয়ে এটা সম্ভব নয়। এত প্রবল চাপ থাকা সত্ত্বেও তিনি তার দর্শন থেকে সরে আসেননি। এটাই বঙ্গবন্ধুর দর্শন। নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে কখনও আপস করতেন না। এই দুটি দেশই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয় দুই সাবেক সেনা শাসকের শাসনকালে। তারা তাদের অবৈধ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানপন্থি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি চালু করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে নানামুখী অপতৎপরতা চালায়। আরও এককদম এগিয়ে এরশাদ তো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অসাম্প্রদায়িকতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকিয়ে দেয়। তারা কেউ নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস থেকে এসব করেনি, ক্ষমতায় থাকার জন্য সবই ছিল ভণ্ডামি। যা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
ক্ষমতালোভীদের ভণ্ডামির দায় আজও বাংলার মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে একশ্রেণির মৌলবাদী কখনও রাষ্ট্রীয় মদতে আবার কখনও তাদের দেশি-বিদেশি প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মের নামে অস্থিরতা তৈরি করে বার বার বাংলাদেশকে অশান্ত করছে।
আমরা যদি কিছুটা পেছনে ফিরে দেখি ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের ৩৫২টি মন্দির পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে এসেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধে সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন হয়। এসব হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদদে। আবার বর্তমানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহক দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারকে বিপদে ফেলতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার বারংবার চেষ্টা করা হয়েছে।
২০১২ সালে রামু, উখিয়া, টেকনাফের বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। সেদিন ১৯টি বৌদ্ধবিহার ৪১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা সাঈদীর মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড ঘোষণার পরই ব্যাপক সংহিসতা চালানো হয়।
২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি হিন্দু মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা, ২০১৯ সালে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সহিংসতার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়। এ ঘটনার জের ধরে ভাঙচুর হয় হিন্দু বাড়ি ও মন্দির। তথাকথিত ধর্মের অবমাননার নামে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া, লুটতরাজ এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধও ঘটছে। গত ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হেফাজতের এক নেতাকে সমালোচনা করে একটি ভুয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ৮৮টি হিন্দু বাড়ি ও পাঁচটি মন্দিরে হামলা চালানো হয়। এর আগেও ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা খোলস পালটিয়ে সময় সুযোগ বুঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত বসিয়ে দেয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে হয়তো কখনও তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষধর সাপগুলো যে নেই, সেটা এখনও বলা যাবে না।
আমাদের আশার বাতিঘর হলো বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি তার পিতার মতোই যেমন ধর্মপ্রাণ, তেমনই অসাস্প্রদায়িক। তিনি বরাবরই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে থাকেন। গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন-
“বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মাদ্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মাকদুম, খান জাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এদেশ সকলের। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোনো বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেব না।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছিলেন, আজ তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
যখনই বাংলাদেশ কোনো সংকটে পড়ে তখনই বঙ্গবন্ধুর দর্শন আমাদের আলোর পথ দেখায়। বঙ্গবন্ধুর দর্শনই বাংলাদেশের একমাত্র রক্ষাকবচ। বাংলাদেশ কখনও মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য হবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক পথেই সকল বাধা অতিক্রম করে দুর্বার দুরন্ত গতিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
haldertapas80@gmail.com