বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় অন্ধকারে পথ হাতড়াচ্ছি?

  • রণেশ মৈত্র   
  • ৩ মে, ২০২১ ১৫:৪১

রাস্তায় প্রায় শতকরা ৫০ জনকেই মাস্কবিহীন দিব্যি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তেমন একটা বাধাও কেউ দিচ্ছে না। স্যানিটাইজার কার পকেটে আছে আর কার পকেটে নেই- তাতো বোঝার উপায় নেই।

সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘সতর্ক না হলে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে পারে।’ মাত্র নয়টি শব্দের ওই বাক্য তো অপ্রত্যাশিত ছিল, অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর মুখ থেকে।

বললেনই যখন তখন তার সহজবোধ্য ব্যাখ্যা তো দেবেন? সরকার পর পর তিন সপ্তাহ লকডাউন ঘোষণা করল। ছবিতে দেখা যায় রাস্তায় পুলিশের অবস্থান। পুলিশ নাকি সরকারি নিষেধাজ্ঞাগুলো যথাযথভাবে পথচারী, গাড়ির যাত্রী ও চালকেরা মানছেন কি না তা লক্ষ করছেন এবং যারা তা মানছেন না- তাদেরকে তা করতে বাধ্য করবেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং নানা জেলা-উপজেলা শহরে কিছু শাস্তি দেয়ার দৃশ্যও টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখা গেছে।

ফলাফল হিসাব করলে হতাশই হতে হয়। রাস্তায় প্রায় শতকরা ৫০ জনকেই মাস্কবিহীন দিব্যি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তেমন একটা বাধাও কেউ দিচ্ছে না। স্যানিটাইজার কার পকেটে আছে আর কার পকেটে নেই- তাতো বোঝার উপায় নেই।

এমন অবস্থা হলে তৃতীয় কেন পঞ্চম ষষ্ঠ ঢেউ ও অস্বাভাবিক হবে না ২০২২ সালের মধ্যে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে-এগুলো ঠেকানো যাবে কীভাবে? সমাজসচেতনতা করোনা প্রতিরোধে অপরিহার্য। কিন্তু সমাজের বড় একটি অংশ সেটা বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করে চলেছে। সেটা উপলব্ধি করে ওই আচরণ প্রতিরোধে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করার বিকল্প নেই। যেমন- মানুষ যাতে নিজেকে ঘরে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে বিনোদন, তার মানষিক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য ব্যবস্থা কোথায়? সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, নাটক প্রভৃতি নিয়ে বেশ একটা বড় অংশের তরুণ অনেক সময় অতীতে কাটাতে পারলেও করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে সেগুলো বন্ধ। এখন যেটা অবশ্য প্রয়োজন এবং করাও সম্ভব তা হলো, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বারংবার একই খবর দেখানো পরিহার করে খবর প্রচারের সময় নির্দিষ্ট করে বাদ-বাকি সময় দেশ-বিদেশের নানা নির্মল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী চ্যানেল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে অনুকূল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আজও নারীরা গৃহকর্মী। ঘরের যাবতদীয় কাজ অন্তত ৯৮ ভাগ মহিলা করে থাকে। বাচ্চাদের পরিচর্যাও তারাই করেন। ফলে ঘরে থাকা পুরুষদের চাইতে তারা দিনের বেশিরভাগ সময় কাজের মধ্যেই থাকেন। কিন্তু যেটুকু সময় তারা অবসর পান তখন তাদেরও প্রয়োজন বিনোদন।

ভাবতে হবে মানুষ কেন বাইরে যায়? এমনকি যাদের সংগতি আছে তাদেরকেও প্রায় প্রতিদিনই বাইরে যেতে দেখা যায়। এর মধ্যে বড় একটা অংশ যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে যান। গরিবেরা বড় বড় বাজারে রোজ আসে তাদের উৎপাদিত অথবা উৎপাদকদের পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে। এ প্রয়োজনীয়তাকে যেমন অস্বীকার করা যাবে না তেমনই বাজারের হাটের হাজার হাজার ক্রেতা বিক্রেতাকে মাস্ক পরানো বা প্রয়োজনীয় দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনা-বেচা করতে হবে।

হাট-বাজারের বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেই সমস্যাটির সমাধান বহুলাংশে নির্ভর করে এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই করা সম্ভব। যেমন মফঃস্বল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত রিকশা-ভ্যান গাড়ির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। ওই ভ্যান গাড়িগুলোকে সকাল-সন্ধ্যা পাড়া-মহল্লাগুলোয় ঘুরে ঘুরে পণ্য সামগ্রী বেচা-কেনার কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে। এভাবে যদি জিনিষের দাম সামান্য বেশিও পড়ে- বাড়িতে বসে কেনার সুযোগ পাওয়ার ফলে ক্রেতারা সেটুকু বহন করতে প্রস্তুত থাকবেন বলেই ধারণা করা যায়। সরকার এমন ভাবনার সঙ্গে একমত হলে ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসিদেরকে নির্দেশ দিলে তারাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট। এতে বড় বড় বাজার ঝুঁকিপূর্ণভাবে না চলে ধীরে ধীরে অল্প সংখ্যক ক্রেতা-বিক্রেতা নিয়ে চলতে দেখা যাবে।

অনলাইন কেনা-বেচা বড় বড় শহরগুলোতে চালু হলেও ওইসব শহরের শতকরা ২৫ ভাগ ক্রেতাও অনলাইনে কিনতে আগ্রহী হননি। বিষয়টা চালু হতে সময় লাগবে- তাই এই ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে উৎসাহিত করতে হবে। জেলা শহর পর্যন্ত তা প্রসারের উদ্যোগও নিতে হবে।

ওষুধ কিনতে যাওয়া অনেক পরিবারের সদস্যের প্রয়োজন হয়। তাই তাদেরকে অন্তত সপ্তাহে একদিন ওষুধের দোকানে যেতেই হয়। করোনা ও অপরাপর রোগের প্রাদুর্ভাবের ফলে ওষুধের দোকানগুলোতে দিনরাত ভিড় দেখা যায়। সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচা সম্ভব নয়। তাই ভ্রাম্যমাণ ওষুধের দোকান চালু করতে পারলে সমস্যার তীব্রতা কিছুটা কমে আসতে পারে।

এরকম নানা পথ বের করে এবং তা যথাযথভাবে কার্যকর করে সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।

বেশি সমস্যা কল-কারখানা এবং দোকান-বিপণীসমূহ নিয়ে। যদি প্রকৃতই করোনার বিস্তার কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে হয়, তবে প্রকৃত অর্থে কঠোর লকডাউন অন্তত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ রাখতেই হবে। এর জন্যে সরাসরি শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারের। তবে মালিকদের আবদার মানলে শ্রমিক-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আরও সংকটে পড়েছেন বেসরকারি পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা। বাস, ট্রাক, রিকশা, ভ্যান ও অন্যান্য যানবাহনের কিছু সংখ্যক মালিক এবং প্রায় শতভাগ শ্রমিক হোটেল-রেস্তোঁরায় বেকারত্বের সম্মুখীন। এদেরকেও সরাসরি আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে হবে।

বহুল আলোচিত অপর বিষয়টি হলো, দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। এদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু না খেয়ে থাকলেও এরা কারো কাছে হাত পাতবে না। তাদের বাড়িতে নৈমিত্তিক পণ্য সামগ্রী, যথা চাল-ডাল, সবজি, পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলা, তেল, মাছ প্রভৃতি পৌঁছে দিয়ে সহায়তা করা প্রয়োজন। এদের ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা সম্ভবত খুব একটা কার্যকর হবে না।

এগুলি কার্যকর করার পরেও (যদি তা করা হয়) বেশ কিছু সংখ্যক মানুষকে মাস্ক-স্যানিটাইজার বিহীনভাবে ঘুরতে দেখা যাবে। তাদের তৎক্ষণাৎ বড় অংকের জরিমানা অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে টাকা অথবা জেল দণ্ড দিতে হবে। আমার অনুমান, এতে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।

এ তো গেল সামাজিক অঙ্গনের করণীয়। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা?

স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্পষ্টভাষায় খোলামেলা বলেছেন, তৃতীয় ঢেউ এলে আর করোনা রোখা যাবে না। কথাটি যৌক্তিক এবং বছরাধিককালের অভিজ্ঞতাপুষ্ট। তিনি এটি তার অবস্থান থেকে বলতে পারেন কি না, বলা সংগত হয়েছে কি না সে বিষয়টি ভাবতে বলি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং যদি একথা বলেন, তা হলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়বে। আর মানুষ যদি হতাশাগ্রস্ত ও আতঙ্কক্লিষ্ট হয়ে পড়েন তবে তাঁরা যে সহজেই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়বেন তা বুঝতে কোনো গবেষণার দরকার নেই।

তৃতীয় ঢেউ দূরে যাক। দ্বিতীয় ঢেউ যে ঢেউ চলমান তাকে কি তারা প্রতিরোধ করতে পারছেন? প্রতিরোধের যা করণীয় তা তারা করেছেন কি? না করে থাকলে যে কথিত তৃতীয় ঢেউ অপ্রতিরোধ্য হবে তা তো সহজেই বলা যায়।

লেখক: রাজনীতিক, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর