‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সুন্দর ভুবনের প্রতি মায়ার প্রকাশ এভাবেই করেছিলেন ‘প্রাণ’ কবিতায় (কাব্যগ্রন্থ: কড়ি ও কোমল)। কিন্তু কিছু মানুষের কাছে এই দুনিয়া তো সুন্দর মনে হয়ই না এমনকি দুনিয়ার প্রতি এত বিরক্ত হয়ে যান যে, নিজেকে আর দুনিয়াতে রাখতে চান না– দুনিয়া ছাড়লে যেন বাঁচেন। তারা মনে করেন তার জন্য এ দুনিয়া নয়। ব্রিটিশ কবি থমাস শ্যাটারটন আত্মহত্যা করেছিলেন এই বলে যে, ‘আমার মতো কোমল হৃদয়ের জন্য এই নির্মম পৃথিবী যোগ্য নয়।’
এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এর অর্থ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। যারা আত্মহত্যা করেন তাদের বেশিরভাগই অল্প বয়সি এবং নারী।
পারিবারিক বিপর্যয়, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি কারণে ‘মানসিক অশান্তি’ থেকে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ। কিন্তু কোনো ধর্মীয় বিধান এবং দেশীয় আইনে কোনো মানুষকে নিজের আত্মহননের অধিকার দেয়া হয়নি। আইন অনুসারে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০৯ ধারায় বলা আছে- যদি কোনো লোক আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে এবং অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে, তবে উক্ত লোক এক বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলামে আত্মহত্যা হারাম। সুরা নিসা ২৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর (হে মুমিনগণ!) তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’
আইনি এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সম্প্রতি আত্মহত্যার প্রবণতা আরও বেশি দেখা যাছে। প্রযুক্তির যুগে আত্মহননের পদ্ধতি পরিবর্তন এসেছে। কেউ আত্মহত্যা করার আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলছেন, ‘এটাই তার শেষ ফেসবুক পোস্ট’, কেউবা লিখছেন ‘এটাই তার শেষ সকাল’। কেউ আবার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে রেখে যাচ্ছে এবং বলছে ‘এই আসীম নদীর সঙ্গে মিশে যেতে চাই’। এগুলো দেখে আবার অনেকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ৫ জন আত্মহত্যা তরুণদের মাঝে ৪ জনই আত্মহত্যা করার আগে ইঙ্গিত প্রদান করে; যেমন, খুব বেশি মরার কথা বলে, নিজের অসহায়ত্ব, কষ্ট, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা নিয়ে কথা বলে, অন্যের ওপর নিজেকে বোঝা মনে করে এবং সাধারণ জীবন থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ইত্যাদি।
মানুষ কেন এই ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নেয় তার কারণ হিসেবে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলে এরকম লক্ষণগুলো একটা মানসিক ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ। বংশগতি, শৈশবের পরিবেশ, নিউরোবায়োলজি এবং মানসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াসমূহ এ রোগের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত হয়। উপযুক্ত চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একসময় মনে করতেন, গভীর বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাই-পোলার, মুড ডিজর্ডার ইত্যাদির সঙ্গেই শুধু আত্মহত্যা জড়িত। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ১০ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কোনো রকমের মানসিক রোগ জড়িত থাকে।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের উচ্চাভিলাষ কিশোর- কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। এ বিষয়ে এক সমাজবিজ্ঞানী বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানিং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পড়ালেখা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মা-বাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। অভিভাবকদের এই অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাভিলাষের কারণেই বোর্ড পরীক্ষায় পাস না করায় কিশোর-কিশোরীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
এক্ষেত্রে ফলাফল প্রত্যাশিত না হলেই অনেকে মনে করেন সমাজে তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই – সমাজে আর মুখ দেখানো যাবে না। কোনো নারী যৌনহেনস্থার শিকার হলে এখনও অনেক নারী মনে করে তার আর এ সমাজে মুখ দেখানোর সুযোগ নেই; দুনিয়া ত্যাগেই তার ইজ্জত রক্ষা হবে– যা খুবই নেতিবাচক মনোভাব এবং পরিত্যাজ্য।
মানষিক ব্যাধি বা সামাজিক– যে কারণেই হোক বেশিরভাগ আত্মহত্যার পিছনে মূল কারণ নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, মানুষের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকা। দুনিয়া কারো প্রতি নিষ্ঠুর কারো প্রতি কোমল – এই ধারণা সঠিক নয়। তবে দুনিয়া তো স্বর্গ নয়; এখানে জীবন ধারণের পথ কঠিন হবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখা উচিত সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কষ্টসহিষ্ণু করেই সৃষ্টি করেছেন। এটা সৃষ্টিকর্তারই বিধান তিনি মানুষকে ভয়, অভাব, ধন-সম্পদের ক্ষতি এবং বিপদ দ্বারা পরীক্ষা করবেন। একই সঙ্গে কাউকেই তার সাধ্যের চেয়ে বেশি দায়িত্ব বা কষ্ট দেন না– এটাও বিধাতার নিয়ম।
সকল বাধা বিপত্তি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি নিজের ওপর আপনার আস্থা, বিশ্বাস। কেউ যদি নিজের ওপর বিশ্বাস না রাখতে পারেন, তাহলে দুনিয়ায় টিকে থাকা তার খুব কঠিনই হবে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো যোগ্যতা থাকে; যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। কিন্তু নিজের খারাপ দিন বা সময়ের প্রতি অতি মনযোগী না হয়ে নিজের মধ্যে যে ভালো দিক বা যোগ্যতা আছে তার প্রতি নজর দিলে জীবন-যাপন অনেক সহজ হয়।
যে কোমলমতিরা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন, তারা যদি নিজের জীবনের অর্জনগুলো স্মরণ করেন, ইতিবাচক চিন্তা করেন, মনীষীদের জীবনী পড়াশোনা করেন তাহলে তাদের মানষিক পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ পৃথিবীতে যারা শ্রেষ্ঠ হয়েছেন তাদের অনেকেই কঠিন সময় এবং বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন; তারা নিজেদের ওপর বিশ্বাসী ছিলেন বলেই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন।
নিজের হারানো বিশ্বাস ফিরে পেতে মনীষীদের উক্তিগুলো সাহায্য করতে পারে– কারণ আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। যেমন পিথাগোরাস বলেছেন, “যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, সে কখনো স্বাধীন নয়।” তিনি আরও বলেছেন, “সবার আগে নিজেকে সম্মান করো”। জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রুমিও “আমরা জন্মাই ডানা নিয়ে, কিন্তু কেন সারাজীবন হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চাই?” অপরাহ উইনফ্রে বলেছেন, “আঘাতকে জ্ঞানে রূপান্তরিত কর।”
এছাড়াও, ধর্মীয় অনুশাসন আত্মহননের মতো ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত থেকে ফিরাতে পারে। ইসলাম ধর্মে আত্মরক্ষার চেষ্টা করা ফরজ। কোনো বিপদ থেকে বাঁচার সময়, সুযোগ এবং সাধ্য থাকার পরও কেউ যদি বাঁচার চেষ্টা না করে ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে নিজেকে মৃত্যুর সামনে ঠেলে দেয় তাহলে সেটা আত্মহত্যার শামিল। আর আত্মহত্যা হারাম।
চলন্ত ট্রেনের সামনে বসে কেউ যদি বলে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করবে তাহলে তাকে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা বলে না। সরে যাওয়ার চেষ্টা করে সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করলে তিনি হয়তো আপনাকে রক্ষা করবেন যদি হায়াত থাকে। ভরসার সঙ্গে নিজের চেষ্টা লাগবে।
বিপদে অবিচল থাকার জন্য মানষিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকা এবং নিজের সামর্থ্যের প্রতি আস্থা রাখা জরুরি। সর্বোপরি কোনো একটা ব্যর্থতা মানেই জীবন শেষ হয়ে যায় না। জীবনে যেকোনো বিপদে বা কঠিন সময়ে মনে রাখা উচিত জীবন এখানেই শেষ নয়; আঁধারের পর নিশ্চয়ই আলো আসবে– বিপদ বা কঠিন সময় নিশ্চয়ই একসময় কেটে যাবে। উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, ‘সাফল্য স্থায়ী নয়, ব্যর্থতা মানেই মৃত্যু নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে সাহস ধরে রাখা’।
পরিবারের কেউ কিংবা কোনো বন্ধু-বান্ধবী কারো সঙ্গে আত্মহত্যার কথা শেয়ার করলে বা হুমকি দিলে তা কখনই হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। দেরি না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর সঙ্গে মন খুলে কথা বলার পরামর্শ দেয়া উচিত। সর্বোপরি, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো আরও শক্তিশালী করলে মানসিকভাবে ভালো থাকা সহজ হয়।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক