তুচ্ছ ঘটনায় বারবার হামলার লক্ষ্যবস্তু হয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যুদ্ধ করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই আওয়ামী লীগের এক যুগের বেশি শাসনামলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার হামলা হচ্ছে, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। মামলা হলেও দুর্বৃত্তরা শাস্তি পায়নি, সবাই জামিনে মুক্ত।
কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হয়েছে আরও ভয়াবহ হামলা। এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধরা এখনও সুবিচারের আশায় রয়েছে। এই হামলার আসামিরাও এখন কারাগারে নেই। নাসিরনগর ও রামুর ঘটনার পর শাল্লার ঘটনায় কী হবে, তা এখনই বলার সময় আসেনি।
এইকভাবে দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, রাজশাহীর চারঘাট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও পিরোজপুরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু কোনো শাস্তি হয় না৷ ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনা৷ অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না৷ প্রত্যেকটি হামলার পেছনেই অপশক্তি কাজ করেছে। ধর্মীয় ইস্যুকে ব্যবহার করা হয়েছে।
দেশের আইন অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন ধারায় শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ। কিন্তু বিভিন্ন সময় ধর্ম অবমাননাকর বিভিন্ন ঘটনার যেসব অভিযোগ শোনা যায়, সেসবের বিচারের কথাও তেমন শোনা যায় না। তবে এসব ঘটনায় দ্রুত ন্যায়বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি করা না গেলে মানুষ ক্রমেই বিচারব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারাতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সবাই একযোগে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও কোনো বৈষম্যমূলক সমাজের জন্য হয়নি। বাঙালি জাতি দ্বিজাতিতত্ত্বের বিস্তারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি। একদিকে ধর্মীয় বৈষম্য, অপরদিকে জাতিগত বৈষম্য। বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
এমন একটি রাষ্ট্রের জন্য এদেশের মানুষ লড়াই করেছে, যুদ্ধ করেছে, যে রাষ্ট্রটির জন্ম হলে সব নাগরিকের জন্য সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থাৎ সমতা এবং সামাজিক মর্যাদাটি সুনিশ্চিত হবে। এটি হবে বাঙালির বাংলাদেশ- সে যে ধর্ম বা বর্ণেরই হোক না কেন। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ মিলেই তো এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। সব বাঙালির ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধানটি গৃহীত হলো, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করা হলো। তার আবর্তেই কিন্তু আসলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগের লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা যা ছিল, সেটারই প্রতিফলন ঘটল।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হয়রানির ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা সেই পুরোনো অপকৌশলেরই আশ্রয় নিয়ে থাকে। আক্রমণকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক সময় থানা-পুলিশে যেতেও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা ভয় পায়। একসময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর গণমাধ্যমের খবরকে অতিরঞ্জিত বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হতো। আওয়ামী লীগ আমলে সে রকমটি হয়নি। সরকার রামু ও নাসিরনগরে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছে। সুনামগঞ্জে ত্রাণসামগ্রীসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। দোষীকে কঠিন শাস্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, প্রায় আগের সব ঘটনায়ই অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা এখনও সম্ভব হয়নি।
অনেক ঘটনা আছে যেগুলো সরকার, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও একটু তৎপর থাকলে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এসব ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আর এসব ঘটনায় যদি অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যেত তাহলে এ পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। দৃষ্কৃতকারীরা এসব অপকর্ম করতে ভয় পেত। সমাজের সব মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং একটি সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানুষের জন্য এখন দরকার তাদের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা।
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসের মূল হোতাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করা। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ব্যর্থ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তপূর্বক আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সকল ধর্ম অবমাননা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রশাসনসহ স্থানীয় নেতাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতি নিরূপণ করে সেই মোতাবেক ক্ষতিপূরণ এবং বাড়িঘর পুনরায় নির্মাণ করে দেয়া। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তারক্ষায় দুর্গম এলাকায় স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রশাসন ও সরকারকে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আরও কাজ করতে হবে এবং নাগরিক সমাজকেও আরও এগিয়ে আসতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান সরকারের পক্ষে বলা হয় বাংলাদেশ ধর্মীয় বহুত্ববাদ বিকাশ ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সবাই সচেষ্ট। যেকোনো ধরনের সহিংসতা, বিভেদ মোকাবিলায় সরকার সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে স্লোগান এনেছেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। এ স্লোগানের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে সব ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন উদ্যোগের প্রতি আস্থাশীল। তার দৃপ্ত পদক্ষেপেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে আরও এগিয়ে যাবে।
আমাদের দায়িত্ব হলো আমাদের গণতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে সাম্য, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের লড়াইটিকে এগিয়ে নেয়া। তাই প্রশাসন ও সরকারকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্প্রীতি রক্ষায় আরও কাজ করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে, যার স্বপ্ন তিনি সারা জীবন দেখেছেন যার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক