১৮৮৬ থেকে ২০২১ সাল। বছরের হিসেবে ১৩৫ বছর। মে দিবসের রক্তাক্ত সংগ্রামের ১৩৫ বছর পালন করছে শ্রমিকশ্রেণি। কিন্তু ইতিহাস কি শুধু অতীতের কথা বলে? যে ইতিহাস বর্তমানকে প্রভাবিত করে, পরিচালিত করে ভবিষ্যতের দিকে; সেই ইতিহাস জীবন্ত। সেই ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজকে, ব্যক্তির যুক্তিকে শাণিত করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহস জোগায় এবং স্থবিরতা দূর করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় উন্নততর স্তরে। মে দিবসের ইতিহাস তেমনি এক গতিময় ও সংগ্রামের ইতিহাস।
ফরাসি বিপ্লব ভেঙেছিল দীর্ঘদিনের সামন্তবাদী সমাজের স্থবিরতা। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার স্লোগান তুলে মানুষের চিন্তাকে উন্নত মানবিক স্তরে উন্নত করেছিল । সে কারণে লক্ষ কোটি মানুষের সংগ্রামে সামন্ত স্বেচ্ছাচারী সমাজ ভেঙে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু জনগণের মনে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শ্রম শোষণের তীব্রতা তো কমলই না বরং বহুগুণ বেড়ে গেল। শিল্পবিপ্লব উৎপাদন বৃদ্ধির নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, গ্রাম থেকে লাখ লাখ কৃষক শিল্প কারখানায় এসেছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের। একদিকে বেড়েছে উৎপাদন অপরদিকে বেড়েছে শ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ।
একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎপাদনের বহুমুখী বিকাশ ঘটিয়েছে। ফলে সমাজের সমৃদ্ধি, ধনীদের বিলাসিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বেড়েছে, বেড়েছে দারিদ্র্য। জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ১৬/১৮ ঘণ্টা কাজ করা শুধু নয়, নারী ও শিশুদেরকে কারখানায় পাঠাতে বাধ্য হতে লাগল শ্রমজীবী মানুষেরা। মালিকরা মুনাফা বাড়াতে শ্রমঘণ্টা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের ওপর যে চাপ প্রয়োগ করত তা শ্রমিকদের জীবন একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সর্বত্রই তাই কর্মঘণ্টা কমানোর দাবি জোরদার হয়ে উঠছিল। ১৮৩২, ১৮৩৯, ১৮৪৮, ১৮৫৭, ১৮৭৫ সালে বড় বড় শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকরা তাদের দাবিতে যেমন রাজপথে নেমে এসেছিল, মালিকরাও তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেসব আন্দোলনকে দমন করেছে । ১৮৮৬ সালে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি তাই কোনো তাৎক্ষণিক দাবিতে গড়ে ওঠা আকস্মিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশায় শ্রমিকশ্রেণির লড়াইয়ের অংশ। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবির অন্তরালে ছিল ন্যায্যমজুরির আকাঙ্ক্ষা।
প্রকৃতিতে যা আছে তা দিয়ে অন্য প্রাণীর চললেও মানুষের চলে না। তাই প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বস্তুর ওপর মানুষ শ্রম প্রয়োগ করেই তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করে। শ্রমশক্তি প্রয়োগ করা থেকেই শ্রমিক নামের উৎপত্তি। শ্রমিক কাজ করে একই সঙ্গে নিজের ও সমাজের জন্য। মানুষ যা খায়, যা পরে, তার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি মানুষের ভাষাও শ্রমের মাধ্যমে এবং শ্রমের প্রয়োজনে সৃষ্ট। শ্রমের ফলে মানুষ শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করে না উদ্বৃত্তও সৃষ্টি করে।
আজকের সমাজের যা কিছু সমৃদ্ধি তা উদ্বৃত্ত সৃষ্টির ফলেই সম্ভব হয়েছে। এই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করার ফলেই একদল সম্পদশালী হয় আর বাকিরা নিঃস্ব হয়। অর্থনীতিবিদরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে কেন এই ঘটনা ঘটে? উইলিয়াম পেটি, অ্যাডাম স্মিথ, রিকারডো তারা দেখিয়েছেন শ্রমের ফলে মূল্য তৈরি হয়, পরবর্তী সময়ে কার্ল মাক্স দেখালেন কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়।
১৮৪৮ সালে মার্ক্স- এঙ্গেলস কম্যুনিস্ট মেনিফেস্ত আর পরবর্তী সময়ে মার্ক্স ক্যাপিটাল লিখে দেখালেন এ যাবতকালের লিখিত ইতিহাস একদিকে যেমন শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস, অপরদিকে মানুষের বিকাশের ইতিহাস। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ যা মানুষের শ্রমের ফল, তা থেকে কি বঞ্চিত হবে শ্রমজীবী মানুষ? জীবিকার জন্য দিনের ১২/১৪/১৬ ঘণ্টা যদি হাড় ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় তাহলে শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে?
বিপুলসংখ্যক মানুষকে বঞ্চিত রেখে সমাজের সুষম বিকাশ কি সম্ভব হবে? যন্ত্রের বিকাশ কি মানুষের শ্রম সময় লাঘব করবে না? কতক্ষণ কাজ করলে একজন মানুষ তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল আট ঘণ্টা কাজ, এটাই হবে কর্মসময়। কিন্তু মজুরি যদি ন্যায্য না হয় তাহলে জীবন যাপনের জন্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হতেই হবে। তাই আট ঘণ্টা কর্মসময়ের সঙ্গে ন্যায্যমজুরির দাবি যে কত যৌক্তিক তা ১৩৫ বছর পরেও বর্তমান শ্রমিকশ্রেণি অনুভব করছে। শ্রমিকশ্রেণি এটাও দেখছে যে যত গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে আট ঘণ্টা কর্ম সময় এবং ন্যায্যমজুরি আদায় করা সম্ভব নয়।
এত উৎপাদন বৃদ্ধি তবুও শ্রমিকের জীবনে তার ছোঁয়া লাগে না কেন? শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত হয় দ্রব্যসামগ্রী কিন্তু তা ভোগ করার অধিকার শ্রমিকের কতটুকু? অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের উন্নতি ঘটানোর পিছনেই থাকে শ্রমিকের ঘাম। কিন্তু সবচেয়ে কম পুষ্টি, কম শিক্ষা, কম স্বাস্থ্য-সুবিধা, কম বিশ্রাম, কম নিরাপত্তা যেন শ্রমিকদের জন্যই বরাদ্দ। অথচ সারা বিশ্বেই খাদ্য উৎপাদনসহ ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে।
বাংলাদেশেও জিডিপি বৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পরিমাণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ উন্নয়ন যত বাড়ছে, তার সঙ্গে এ কথাটাও যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশ সস্তা শ্রমিকের দেশ। বলা হয় এর কারণ বাংলাদেশের শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম। কিন্তু উৎপাদনশীলতা শুধু শ্রমিকের শ্রমশক্তির ওপর নির্ভর করে না। মেশিন, ম্যানেজমেন্ট এবং ম্যানপাওয়ার এই তিন ‘এম’ যুক্ত আছে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে। একটি সহজ উদাহরণ থেকেও বিষয়টা বোঝা যাবে। রিকশাচালক অনেক পরিশ্রমী কিন্তু তার চেয়ে কম পরিশ্রম করেও সিএনজি চালকের উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি।
শিক্ষিত শ্রমিক, প্রশিক্ষিত শ্রমিক, দক্ষ শ্রমিক যা-ই বলি না কেন তা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন শ্রমিকের আয় এবং অবসর। আয় বাড়লে খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ বাড়বে এবং অবসর সময় পেলেই তো শ্রমিক তার দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাবে। তা যেমন সমাজের অগ্রগতি সৃষ্টি করবে তেমনি বৈষম্য কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। কিন্তু শোষণ থাকলে তা তো সম্ভব নয়। এর ফলে একদল মানুষ যারা উৎপাদন যন্ত্র যেমন কারখানা ও পুঁজির মালিক তারা দিন দিন ফুলে ফেঁপে ওঠে আর শ্রমশক্তির মালিক শ্রমিক হারায় তার কর্মশক্তি। শোষণমূলক সমাজ যেমন বঞ্চিত করে শ্রমজীবীকে, তেমনি জন্ম দেয় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের ।
মে দিবসের সংগ্রাম ছিল তেমনি এক বিদ্রোহ যা শুধু শ্রমিকদের দাবিতে নয়, সমাজের বিকাশের প্রয়োজনে সংঘটিত হয়েছিল। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগাস্ট স্পাইস যে ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন, তা আজও আমাদেরকে আলোড়িত করে। তিনি বলেছিলেন-
“The time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today.”
আট ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে ও ৪ মে আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির ঘটনায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মৃত্যুতে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে শ্রমিকরা আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আট ঘণ্টা কর্মদিবস ও ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়।
শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমশোষণ যে বন্ধ হয় না, বরং নতুন পদ্ধতিতে শ্রমিককে শোষণ করতে থাকে- তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাজার-সংকট, বাজার দখল করতে বিশ্বযুদ্ধ ও আঞ্চলিক যুদ্ধ, আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো সবই তো বিশ্ববাসী দেখছে। ফলাফল হিসেবে দেখছে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদের পাহাড় জমতে।
আটজন অতি ধনীর হাতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান সম্পদ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, শোষণ কত আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। আফ্রিকার কয়লা, লোহা, মধ্যপ্রাচ্যের তেল, ল্যাতিন আমেরিকার কফি আর এশিয়ার শ্রমিক সবই তো শোষণ লুণ্ঠনের জালে আবদ্ধ। করোনা মহামারির সংক্রমণ আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নামে রোবটনির্ভর শিল্প সবই বৈষম্যকে প্রকট করে তুলছে। শ্রমিক ছাড়া উৎপাদন হবে না, শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে পণ্য বিক্রি হবে না আর শ্রমিক রুখে না দাঁড়ালে শোষণ বৈষম্য দূর হবে না। মে দিবস এই সত্য তুলে ধরেছিল, আজ তা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
দুনিয়াব্যাপী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে দুনিয়ার মজদুর এক হও, স্লোগান আজ আরও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। আট ঘণ্টা কর্মদিবস আন্দোলনের নেতা অগাস্ট স্পাইস, এঙ্গেলস, ফিশার ও পারসন জীবন দিয়ে আন্দোলনের যে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন তাকে বুকে ধারণ করে তাই আজও বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।