বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শ্রমজীবীর সংহতি প্রকাশের দিন মে দিবস

  •    
  • ১ মে, ২০২১ ১২:১৮

দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা অসুস্থ প্রবণতা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে গ্রাস করেছে। সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলন দেশে আছে তবে সেই ধারাটা দুর্বল।

১ মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের জন্য এক ঐতিহাসিক গৌরবময় দিন। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কর্ম-সময়ের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারান ১০ শ্রমিক। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কনভেনশনে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে তারিখকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে মেহনতি মানুষকে সম্মান জানাতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মে দিবস। শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন মহান মে দিবস।

আমাদের দেশেও প্রতিবছর ঘটা করে মে দিবস পালন করা হয়। পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন কিন্তু সকাল-সন্ধ্যার অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদের দেশের শ্রমিকরা যে মজুরি পান, তা নিয়ে কি তারা সন্তুষ্ট? তারা কি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারছেন?

বাস্তবে আমাদের শ্রমিকদের জীবন নানা দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিয়ে কাটছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার হলেও এর অভাবে দেশের, বিশেষত গার্মেন্টস কারখানাগুলো, শ্রমিকের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডসহ একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা হতাহত হলেও এ-সংক্রান্ত আইনের কোনো প্রয়োগ হয় না। এ প্রসঙ্গে তাজরীন গার্মেন্টস এবং রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

আমাদের দেশে সংগঠিত খাতের চেয়ে অসংগঠিত খাতের শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নানা ধরনের কাজে অংশ নিচ্ছেন। গার্মেন্টস ছাড়াও কৃষি, নির্মাণ, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, চা-বাগান, ওষুধশিল্প, কোমল পানীয়, খাদ্য-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, হস্তশিল্প ইত্যাদি খাতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বেশি। নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মজুরি-বৈষম্যের শিকার। দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও এখন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা অসুস্থ প্রবণতা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে গ্রাস করেছে। সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলন দেশে আছে তবে সেই ধারাটা দুর্বল।

প্রবীণ শ্রমিকনেতা মঞ্জুরুল আহসান খান একবার বলেছিলেন, ‘শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকস্বার্থ রক্ষা না করে শ্রমিকের ক্ষতি করে। নেতাগিরি একটা ব্যবসা, প্রচুর টাকাপয়সা পাওয়া যায় এতে।’ বাংলাদেশের এখনকার ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে মঞ্জুরুল আহসানের অভিযোগটি নির্মম সত্য। শ্রমিকস্বার্থের কথা বলে, শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে, শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তির ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন সেক্টরে বা শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব যা করছে তার নাম স্রেফ ব্যবসা, বিনা পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা। সে জন্য আমাদের দেশে শ্রমিকরা ভালো না থাকলেও ভালো থাকেন অধিকাংশ শ্রমিক নেতা এবং মালিক।

কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষের মুখেই শোনা যাক তাদের জীবন-সংগ্রামের কথা :

দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলায় প্রায় দুই দশক ধরে লেদ মেশিনে কাজ করেন কাজল নামের এক শ্রমিক। এত বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত হওয়ার কারণে প্রাত্যহিক অল্পবিস্তর ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারলেও সকাল ৯টা থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত কাজ করতে করতে কখনও কখনও ঝিমঝিম করে তার হাত-পা। মাসে যে টাকা মাইনে পান তা দিয়ে মাসের ১৫-২০ দিন চলে গেলেও বাকি দিনগুলো আর চলতে চায় না। শ্রমিক হিসেবে তার অধিকারের কথা জানতে চাইলে বিস্মিত হয়ে বলেন, একজন শ্রমিক হিসেবে আমার কী অধিকার তা আমি কেমনে জানব? এসব আমার মালিক আমাকে কখনও বলেননি। তিনি আরও বলেন, মে দিবস কী জানি না। ওই দিন শ্রমিকগো হইলে আমরা ছুটি পাইতাম। মালিক এসব জানতে পারে। জীবন নিয়ে আলাদা কোনো ভাবনা নেই কাজলের। ২ ছেলে ১ মেয়ের সংসারে তার একটাই চাওয়া— ছেলেমেয়েকে মানুষ করা। আর যত দিন তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম আছেন, তত দিন কাজ করতে চান লেদ মেশিনে। কারণ, এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ তার জানা নেই।

রাবেয়া খাতুন একটি স্পিনিং মিলের শ্রমিক। কয়েক বছর ধরে একটি স্পিনিং মিলে কাজ করছেন। প্রতিদিনের কাজ শেষ করতে হিমশিম খেতে হয় রাবেয়াকে। আবার একটু এদিক-ওদিক হলেই শুনতে হয় কটু কথা। তিনি বলেন, এভাবে বকার চেয়ে মারা ভালো। সারা দিন দাঁড়িয়ে কাজ, বসার উপায় নাই। মাঝে মাঝে পা চিনচিন করে ওঠে। তবে অন্যান্য কারখানা থেকে তাদের সুযোগসুবিধা কিছুটা ভালো বলে তিনি জানান। এখানে তাদের কারখানার কাজে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সে জন্য চিকিৎসা-খরচ দেয়া হয়। রোজার সময় ইফতারি দেয়া হয়। এসব সুযোগসুবিধা পেলেও মজুরির ব্যাপারে রাবেয়া বেশ হতাশ।

সারা দিন কাজ করে তিনি যে সামান্য টাকা পান অভাবের সংসারে এই অল্প টাকায় চলতে চায় না। বেতনের বড় একটা অংশ ঘর ভাড়াতেই চলে যায়। তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও এই প্রতিকূল সময়ে তার পক্ষে বেঁচে থাকাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগ দেবার কোনো মানসিকতা যেন আর তার নেই। তাই তো মে দিবসের কথা উঠলেই তাকে বলতে শোনা যায় ‘ও’ আমি জানি না। সে আবার কী?

উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা শহরের আবদুর রহিম একজন ওয়েল্ডিং শ্রমিক। বেঁচে থাকার জন্য তার কাছে কাজের কোনো বিকল্প নেই। রাত পোহালেই তাকে বের হতে হয় কাজের উদ্দেশ্যে। তার মতে, কাজ নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন। জীবনের জন্য কাজ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সকাল ৯ থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত স্বাভাবিক কাজের সময় থাকলেও তাকে প্রায় প্রতিদিনই বাড়তি দৈনিক ১-২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেত হয়।

ঘণ্টা হিসেবে দৈনিক মজুরি পান তিনি। প্রতি ঘণ্টা ১০ টাকা, সেই হিসেবে দৈনিক গড়ে ৯-১০ ঘণ্টা কাজের মজুরি পেয়ে থাকেন। রহিম বলেন, মালিকের সুবিধামতো কাজ করলে কাজের যথেষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে। ইলেকট্রিক ও লোহা দিয়ে কাজ করতে হয় বলে প্রত্যেকটি কাজের ঝুঁকি বেশি। বর্তমান বাজার হিসেবে আমাদের মজুরি বৃদ্ধি হয় না। কাজ শেখার সময় নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে হয়। যার ভিত্তিতে জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কাজে দক্ষতা অর্জন করায় এখন হেডমিস্ত্রি হয়েছি, যা বর্তমানে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করছে।

আমজাদ হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর। ট্রাকে, ঠেলাগাড়িতে বিভিন্ন মাল ওঠানামা করান তিনি। সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছেন তাও অনেক বছর হয়ে গেছে। শুরু থেকে কাজ করছেন ঢাকার নয়াবাজারে। মাল টানার কাজে কোনো স্থিরতা না থাকায় আমজাদ হোসেনের নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা তার সংসারে। শ্রমিক বলে সমাজে কোনো মর্যাদা পান না আমজাদ হোসেন। এ ছাড়া তার কাজের পরিবেশও স্বাস্থ্যকর না। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ঘিঞ্জি এলাকায় কাজ করতে হয় তাকে। নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্যের প্রশ্নে তিনি বলেন, কাজ যদি একই রকম হয়, তবে নারী পুরুষ উভয়কেই সমান টাকা দেয়া উচিত। তবে নারীদের পক্ষে অনেক কষ্টের কাজ করা সম্ভব নয় বলে তার বিশ্বাস। মে দিবস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমজাদ হোসেনের। তবে বছরের একটা দিন শ্রমিকদের তিনি গুলিস্তান ও পল্টন এলাকায় মিছিল করতে দেখেন বলে জানান।

গত বছর এবং এ বছর করোনা মহামারির কারণে এসব শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্যোগ। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। কেউ কেউ কিছু সরকারি ত্রাণ সাহায্য পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। যারা কোনো সাহায্য পাননি তাদের অবস্থা সঙ্গীন। কবে এই দুর্যোগকাল শেষ হবে, কবে আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম, আয়-উপার্জন শুরু হবে তা জানা না থাকায় চরম অনিশ্চয়তায় জীবন কাটছে যেসব শ্রমজীবী মানুষের, তাদের কাছে মে দিবস কোনো আলাদা বার্তা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয় না।

তবে এটা ঠিক যে, কোনো কালে, কোনো দেশেই শ্রমিকদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, ন্যায্যমজুরি কেউ আপনা-আপনি দিয়ে দেন না, লড়াই করেই তা আদায় করতে হয়, হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্প প্রয়োজন। আবার শিল্পবিকাশের জন্য শিল্পক্ষেত্রে শিল্পবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। অসুস্থ ও সুবিধাবাদী ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শিল্পের বিকাশ ও স্থিতির জন্য ক্ষতিকর। সেজন্যই শিল্পবিকাশের স্বার্থে, জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতির স্বার্থে দেশে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের যে অভাব এখন দেশে তৈরি হয়েছে তা দূর করতে হবে।

অসংগঠিত খাতের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবনের সমস্যাগুলো দূর করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবার জন্য বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। সব খাতেই শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে। শ্রম আইন যাতে বাস্তবায়িত হয় তার প্রতি কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। প্রতি বছর মে দিবস এ অঙ্গীকারই সামনে নিয়ে আসে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর