আমরা একটা নাট্যদল থেকে গত ৪০ বছর ধরে মে দিবস উদযাপন করে আসছি। গত বছর আর এ বছর তা আর সম্ভব হয়নি। ডিজিটাল মাধ্যমে করতে হচ্ছে। আমরা উদযাপনের দিকে যতই এগিয়েছি লক্ষ করেছি গোড়ার দিকে কিছু সংগঠন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু পরের দিকে তা নিষ্প্রভ হতে শুরু করে।
রাজনৈতিক দলগুলোতেও একই ব্যাপার। ক্ষমতাসীন দলগুলোতে কিছুটা জৌলুস থাকে, সেটা অন্য কারণে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো কোনো রকমে দায়সারাভাবে কাজটা করে থাকে। বিষয়টির সঙ্গে এখন আর ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটি যেহেতু নেই তাই রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বাম চিহ্নিত দলগুলো একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অনেকটা মুক্তিযুদ্ধের মতোই। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি যখন জড়িয়ে যায়, তখন মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহন করার প্রয়োজন তারা কখনই ভাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠান দেখলেই তা ভালোই বোঝা যায়। মে দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধ দুটোই ঐতিহাসিক একটা বিষয়, যা আবার মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। মে দিবস মুক্তি দিয়েছে শ্রমিক শ্রেণিকে অমানবিক শ্রমঘণ্টা থেকে আর মুক্তিযুদ্ধ মুক্তি দিয়েছে বাঙালির ওপর নিষ্ঠুর শোষণ থেকে। এ দুটিই আমাদের জীবনের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুক্ত। শুধু তাই নয়, একটি আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের যুক্ত করে। আরেকটি যুক্ত করে জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে। একটি শতাব্দী প্রাচীন অন্যটি মাত্রই পঞ্চাশ বছর আগের বিষয়। দুটিই আজ বিস্মৃতির কবলে আক্রান্ত। অথচ দুটোই আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মে দিবসের যে আত্মত্যাগ যার ফলে শ্রমিকশ্রেণি আট ঘণ্টার শ্রমের সুযোগ পেয়েছিল তা কি আজও আমাদের দেশে অর্জিত হয়েছে? নারীর গৃহস্থালি শ্রম কি আদৌ শ্রমের স্বীকৃতি পেয়েছে? অনেক কলকারখানায় বিশেষ করে কৃষিশ্রমিকরা মে দিবসের পাওনা আদায় করতে পেরেছে?
আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ কি তার অধিকার সম্পর্কে জানতে পেরেছে? বা জানানো হয়েছে? এ দায়িত্ব শিক্ষিত মানুষের। সেই শিক্ষিত মানুষ কি তাদের সাংস্কৃতিকচর্চায় কর্মসংস্কৃতির বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে? আমাদের জীবনাচরণে আছে উপার্জন, লুণ্ঠন, ভোগ সঞ্চয়, প্রতারণা এবং বঞ্চনা। শত শত বছর ধরে এসব প্রবণতা চলে আসছে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে।
আজকাল পত্রপত্রিকায়, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু লুণ্ঠন, প্রতারণার সংবাদ জনসমক্ষে আসে বটে কিন্তু অজান্তেই তা মিটে যায়। সেখানে আবার কিন্তু আদান-প্রদানও ঘটে। সে আদান-প্রদানের মাধ্যমে যে শুধু টাকা তাই নয়, সামাজিক ক্ষমতা, পেশিশক্তি এসবও আছে। পুঁজিবাদের ধর্মও তাই। যদিও কর আদায়ের কারণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা খুবই কঠিন কিন্তু আবার শিথিলও।
কালো টাকাকে সাদা করার জন্যে মুক্তকণ্ঠে রাষ্ট্র আহ্বান জানায়। সব লুণ্ঠন ধর্মের ভাষায় জায়েজ হয়ে যায়। এই জায়েজের ক্ষেত্রে আইন-আদালতও পাশে এসে দাঁড়ায় বন্ধুর মতো। তারপরও আছে অমানবিক শ্রম শোষণ। যেসব শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নানা ধরনের কারখানায় কাজ করে নিজের আয়ু কমিয়ে ফেলে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা কি আছে? থাকলেও তা একেবারেই কাগজে কলমে। শ্রমিকদের নানা ধরনের সংগঠন রয়েছে, যেহেতু শ্রমিকরা সংখ্যায় বেশি তাই বড় বড় সংগঠনও গড়ে ওঠে। ক্ষমতার রাজনীতি যারা করেন তাদের এটা করতেও হয়।
সংঘবদ্ধ বড় সংগঠন আছে এবং তা সরকারি দলের অধীনে। এর নেতৃত্বেও থাকেন ওই দলেরই কোনো নেতা। তিনিই কালক্রমে হয়ে ওঠেন ওই দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ধর্মঘটের ভয় দেখিয়ে সব অনায্য বিষয় সরকারের কাছ থেকে আদায় করেন এবং জনগণের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে চাপিয়ে দেন ভাড়ার বোঝা। কিন্তু অতি যত্নে শ্রমিকদের রেখে দেন অন্ধকারে। ন্যূনতম মানবিক ও যৌক্তিক জ্ঞানচর্চার কোনো সুযোগ তিনি সৃষ্টি করেন না। এমনি করেই অনেক শ্রমিক আবার দাসবদ্ধ হয়ে ওঠে। কেউ কেউ অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভয়ংকর সব অপরাধ করে থাকে।
শ্রমিকের কাজের কোনো বয়ঃসীমাও নেই। এমনকি ৭০ বছরের একজন শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্রও নেই। তাই যেদিন সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হবে সেদিন একজন নিঃস্ব ভিখারির সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য নেই। আমরা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলেছি।
মুক্তিযুদ্ধ এই জন্য বলা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধটি হবে এক চলমান প্রক্রিয়া। সশস্ত্র যুদ্ধ সব সময় নয় শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তি অর্জন করা। সেক্ষেত্রে শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষ, কর্মজীবী সবাই যুক্ত হবে সে যুদ্ধে। কিন্তু মে দিবসের মতো মুক্তিযুদ্ধও ইতিহাস হয়ে গেল।
করোনার ভয়াবহ সংকটে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত শ্রমজীবী মানুষ। কাজ নেই, খাদ্য নেই। অথচ গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন-আমিষ খেতে হবে, আরও খেতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল। তবে একটি কাজই করতে পারে কৃষক-শ্রমিকসহ সকল শ্রমজীবী মানুষ তা হলো খালি গায়ে রোদে বসে থাকা। এই কাজটি সব ঋতুতেই করে থাকে এসব মানুষ, অনাদিকাল থেকেই করে আসছে। ক্ষুধা নিয়ে সাশ্রয়হীন হয়ে আকাশের নিচে রোদ বৃষ্টি নিয়ে বসে থাকতে থাকতেই একদিন পরপারে যাত্রাটা শুরু হবে। অপূর্ণই থেকে যায় মৌলিক চাহিদা।
এই জন্যই হয়তো শ্রমজীবী মানুষের দুয়ারে করোনা হানা দিচ্ছে কম। চিকিৎসাও হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক। কিন্তু এ ব্যবস্থাও চিরকালের নয়। মে দিবস একসময় মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেবে।
লেখক: নাট্যকার-অভিনেতা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।