বেশ কবছর থেকে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার বিষয়টি বেশ আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তবে দেশে আগে থেকেই আলিয়াধারার মাদ্রাসার শিক্ষার সঙ্গে মানুষ অনেক বেশি পরিচিত ছিল। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন গ্রামগঞ্জে ততটা ছিল না, তখন অনেকেই আলিয়া মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে শহরের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া করেছিলেন। অনেকে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, আমলা, রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন পেশায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
আলিয়া মাদ্রাসায় যারা পড়াশোনা করেন তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ নানা ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে আলিয়া মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও সামাজিক-মানবিক বিভাগের পড়াশোনা করার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা মেধা, যোগ্যতা এবং নিজেদের উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করার প্রস্তুতি মাদ্রাসার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে লাভ করে থাকেন। সেকারণে আলিয়াধারার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অনেকেই আপন যোগ্যতায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থান লাভ করার সুযোগ পেয়ে থাকে।
অপরদিকে কওমি এবং আরও বেশ কিছু উপধারার মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা কোরআন-হাদিস ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত না হওয়ার কারণে উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা ও পেশাগত দক্ষতা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ কওমি শিক্ষার্থীগণ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অবদান রাখার সুযোগ পায় না। তাদের মধ্যে একটি অংশ বেঁচে থাকার জন্য মসজিদ ও মাদ্রাসায় কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মসংস্থান নতুন করে সৃষ্টি হওয়ার কারণ থাকে না। সে ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে অনেকেই যেসব অভিভাবকের একাধিক সন্তান রয়েছে তাদেরকে অন্তত একটি সন্তান মাদ্রাসায় পড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সন্তান মাদ্রাসায় শিক্ষিত হলে পিতামাতাকে পরকালে বেহেশতে নেয়ার দাবিও করে থাকেন। এভাবে ছাত্র সংগ্রহ করে অনেকেই নতুন কওমি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। দেশে কওমি মাদ্রাসা বেড়ে যাওয়ার এটি অন্যতম একটি কারণ।
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ নামক স্থানে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা নামে যে মাদ্রাসাটি স্থাপিত হয় এটিই তৎকালীন ভারতবর্ষের কওমিধারার প্রথম মাদ্রাসা। আরবি ‘কওমুন’ শব্দ থেকে ‘কওমি’ শব্দের উৎপত্তি। কওমি শব্দের অর্থ জাতি, সম্প্রদায়। মূলত কোরআন হাদিস শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামকে ভালোভাবে শেখাই এই শিক্ষার প্রবর্তকদের উদ্দেশ্য ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই দেওবন্দ পড়তে আসেন। নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তারা দেওবন্দ আদর্শের মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
১৮৯৯ সালে চট্টগ্রামে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা নামক কওমি মাদ্রাসা প্রথম স্থাপিত হয়। এরপর পাকিস্তান আমল পর্যন্ত কওমি মাদ্রাসা সংখ্যায় তেমন বেশি প্রসার করেনি। তবে আলিয়া মাদ্রাসা ব্যক্তি ও সমাজের কাছে অপেক্ষাকৃত পরিচিত থাকায় একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এসব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন।
১৯৭৮ সালে প্রথম বেসরকারি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক ভিত্তিতে কওমি মাদ্রাসাকে পরিচালিত করার জন্য ১১টি কওমি মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে ২০৪৩টি মাদ্রাসা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে নিবন্ধিত হয়। এই সময় থেকে কওমি মাদ্রাসা খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ১০ হাজারের অধিক উন্নীত হয়। এর মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা আড়াই শ’র অধিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কওমি মহিলা মাদ্রাসার সংখ্যাও শতকের কাছাকাছি রয়েছে। বর্তমানে দেশব্যাপী কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা বলা হয়। সংখ্যার ভিন্নতার অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্রাম এবং শহরে অনুমোদনহীনভাবে অনেক কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যেগুলোর পরিসংখ্যান কওমি শিক্ষাবোর্ডের হাতেও নেই। কোনো কোনো সূত্র দেশে ৫০ হাজারের মতো কওমি মাদ্রাসা রয়েছে বলে দাবি করে।
সম্প্রতি পুলিশের আইজিপি বেনজির আহমেদ ৫০০-এর অধিক কওমি মাদ্রাসা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে বলে গণমাধ্যমের সম্মুখে জানিয়েছেন। এগুলোতে ১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে বলে তিনি জানান। বোঝা যাচ্ছে যে, দেশে যদি কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ৫০ হাজার হয় তাহলে কওমি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটির কাছাকাছি হবে। কওমি মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগই আবাসিক। এগুলোতে অনাথ শিক্ষার্থী ছাড়াও নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তানরাও লেখাপড়া করে। বেশিরভাগ মাদ্রাসার আয়ের উৎস সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজনের দেয়া অর্থ, অনুদান, কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ এবং সচ্ছল শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেয়া মাসিক বেতন। এছাড়া বেশকিছু বড় বড় কওমি মাদ্রাসা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে নানা ধরনের অনুদান পেয়ে থাকে বলে গণমাধ্যমের তথ্য থেকে জানা যায়। কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার সঙ্গে স্থানীয় কিছু বিত্তশালী ব্যক্তিও যুক্ত থাকেন।
কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কেও সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের তদারকি করার বিধি-বিধান নেই। কওমি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব স্বাধীনতায় চালিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় সম্পর্কে শুধু সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা পরিচালনার কমিটি অবহিত। কওমি শিক্ষা বোর্ড কোরআন হাদিস শিক্ষার বাইরে দেশীয় সাধারণ শিক্ষায় পঠিত সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান কিংবা ব্যবসায় শিক্ষার কোনো পঠন-পাঠন অনুমোদন দেয় না।
মাদ্রাসাগুলোতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, জাতীয় পতাকাও উত্তোলিত হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া, সংগীতচর্চা, বিনোদন, চিত্রাঙ্কন সহ-শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই নিষিদ্ধ। শিক্ষার্থীদের জীবনযাপনে কঠোর অনুশাসন জারি থাকে। ছাত্রাবাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর কঠোর নজরদারিত্ব থাকে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ নেই। যেকোনো অন্যায় অথবা অপরাধের শাস্তি অনেক সময় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরের অনিয়ম, দুর্ঘটনা কিংবা অপরাধমূলক কোনো ঘটনার খবর বাইরে খুব সামান্যই আসে। শিশুদের ওপর নিপীড়নের কিছু খবর গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা, ভেতরের শিক্ষার পরিবেশ, থাকা খাওয়া ও জীবনযাপন সম্পর্কে অভিভাবকদের বিরাট অংশ কতটা ওয়াকিবহাল থাকেন কিংবা এই শিক্ষাব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ সে সম্পর্কেও তাদের খুব একটা ধারণা নেই। কওমি মাদ্রাসাকে তারা ধর্মীয় আবেগ, অনুভূতি ও বিশ্বাস থেকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেন। শিক্ষকদেরও তারা সেভাবেই বিশ্বাস করে থাকেন।
কওমি মাদ্রাসায় যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তারা কোরআন ও হাদিস সম্পর্কেই লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আরবি ভাষা যারা ভালোভাবে শিখতে পারেন; তারা ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারেন। কিন্তু সব শিক্ষার্থী আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তেমন পরিবেশ পঠন-পাঠনের সুযোগ-সুবিধা, ভাষাশিক্ষার সুযোগ সব মাদ্রাসায় সমানভাবে থাকার কথা নয়। যেখানে এই সুযোগ আছে সেখানকার শিক্ষার্থীরা তুনলামূলকভাবে ভালো করেন। কিন্তু সবাই করতে পারে না।
বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশ বা বিদেশে কর্মসংস্থান করার কোনো নিশ্চয়তা পান না। অথচ কওমি মাদ্রাসাগুলোর প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধর্মশিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান, ব্যবসা, মানবিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য ইত্যাদি শিক্ষালাভের সুযোগ থাকলে অসংখ্য শিক্ষার্থী নিজের পছন্দ অনুযায়ী পেশাভিত্তিক উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করতে পারত। তেমনটি ঘটলে আমরা হয়তো ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা লাভের পাশাপাশি ধর্মের মৌলিক অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ অনেককেই পেতাম, যারা ধর্মের গভীরতম বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হতেন। কিন্তু আমাদের হাজার হাজার কওমি এবং আলিয়া মাদ্রাসা থাকা সত্ত্বেও তেমন কোনো ইসলামি গবেষক দেশে পাওয়ার খবর জানা যায় না। এর কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুক্ত থাকা। সেই কাজটি না ঘটলে চিন্তার সৃজনশীল বিকাশ ঘটার সুযোগ পায় না। আমাদের উভয় ধারার মাদ্রাসাই গবেষণায় অবদান রাখার তেমন কোনো নজির স্থাপন করতে পারেনি।
অপরদিকে কওমিধারার শিক্ষার্থীরা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় না। নিজেরাও কেউ ওইসব বিষয়ে পড়াশোনা করে বিশেষজ্ঞ হওয়ার সুযোগ পায় না।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম থেকে শিক্ষা নিয়ে কেউ ডাক্তার, প্রকৌশলী, অণুজীববিদ, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ তাদের মধ্যেও জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। তারা অনেকেই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নিজস্ব আগ্রহের জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা করে অনেক কিছু আবিষ্কারও করতে পারত।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা ছোট্ট একটি গণ্ডির বাইরে দৃষ্টি দেয়া, চিন্তা করা, নিজেদেরকে বিকশিত করার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। তাদেরকে জীবন দক্ষতায় সক্ষম মানুষরূপে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে তারা নিজেরাও যেমন একজন মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ, সৃজনশীল মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারছে না। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকেও তারা কিছু দেয়ার মতো করে ভাবতে পারছে না। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের যদি শিক্ষালাভে তার পছন্দের বিষয়টি অধ্যয়ন করার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি কওমি মাদ্রাসা থেকেও শিক্ষালাভকারী অসংখ্য শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার নজির স্থাপন করতে পারত । কেননা শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মনে প্রকৃতি, জীবন, জগৎ, মানুষ, চিন্তনসহ নানা বিষয়ে আগ্রহ, কৌতূহল সৃষ্টির যে সুযোগ করে দেয় সেটিই তাকে উচ্চতর জ্ঞানচর্চায় সমৃদ্ধ হতে আকৃষ্ট করে, বিশেষজ্ঞ তৈরি করে। এমনকি নতুন আবিষ্কারক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করে।
শিশুরা যখন এসব শিক্ষার সুযোগ পায় তখনই কেবল তারা দক্ষতা ও সক্ষমতায় মানব সম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে। যারা এই সুযোগ পায় না তারা নামে মানুষ হলেও চিন্তা ও দক্ষতায় পেরে না ওঠার কারণে সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে হীনম্মন্যতা, যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি অজ্ঞতার কারণে বড় ধরনের কূপমণ্ডূকতাও তৈরি হয়। এরা স্বদেশ, মাতৃভূমি, জনগণ ও বিশ্বমানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হয়। এদের মধ্যে তৈরি হয় জ্ঞানী-বিজ্ঞানী এবং আধুনিক মানুষদের সম্পর্কে বিদ্বেষ, ঘৃণা এবং ভুল ধারণা। কওমি মাদ্রাসায় মানবিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোকে বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিকশিত করার শিক্ষাক্রম, সহ-শিক্ষাক্রম এবং উদ্যোগ প্রায় নেই। যদিও দেশে সেধরনের পাঠাগার, গবেষণাগার, পাঠচক্র ইত্যাদির উপস্থিতি রয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে মনে করা হয়। ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর কওমি মাদ্রাসার নাম আলোচনায় চলে আসে। দেশের রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে এই সংগঠনটি যুক্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের বড় অংশই এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনেকেই এই সংগঠনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের নামে ঢাকার শাপলা চত্বরে যে সমাবেশ ঘটানো হয়, তাতে কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয়।
সম্প্রতি ২৬-২৮ মার্চ হেফাজতের কর্মসূচিতেও কওমি শিক্ষার্থীদের ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ ধ্বংসে ব্যবহার করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম সংগঠনগতভাবে এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকগণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সরকার উৎখাত এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে ব্যবহার করার যে নজির সৃষ্টি করেছে তাতে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ভাবমূর্তি চরমসংকটে পড়েছে। এর জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়, হেফাজত-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই দায়ী। এই অবস্থায় রাষ্ট্র, সচেতনমহল, অভিভাবকগণ কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত মেধাবী, দেশপ্রেমিক, সৃজনশীল, ও উদ্ভাবনী চিন্তায় সক্ষম শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের উদ্যোগ না নিলে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশ রাষ্ট্রের সম্পদ না হয়ে অপশক্তির জোগানদার নামে পরিচিত হতে পারে।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক