শেষ কয়েক দশকে টাইম-ট্রাভেল বিষয়ে অনেক চলচ্চিত্র বা গল্প-উপন্যাস হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেই তত্ত্ব বা কন্টেন্টই থাকুক না কেন, কাহিনি মোটাদাগে একই। সবগুলোতেই হয় অতীতে গিয়ে সেই সময়ের কিছু অসংগতি পরিবর্তন করে বর্তমানকে সুসংগঠিত করা হয় নতুবা ভবিষ্যতে গিয়ে কিছু দেখে এসে বর্তমানকে আরও বেগবান করা হয়। দুধরনের বিষয়েই কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের একটা কমন ফ্যাক্টর আছে। সে ভবিষ্যতেই যাক আর অতীতেই যাক সেই সময় থেকে কিছু শিক্ষা নিয়ে সে বর্তমানকে আরও সুন্দর, বেগবান করে গড়ে তোলে।
আমার কাছে ব্যক্তিকভাবে ইতিহাস সেই অভাবনীয় টাইম মেশিনের মতোই। অন্তত পেছন ফিরে চাওয়া যায়। অতীতের ঘটনা থেকে নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝে বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা শিক্ষা নেয়া যায়। ইতিহাসচর্চার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অতীতের কৃত ভুলকে পুনর্বার সংগঠিত হতে না দেয়া, তার নিবারণ করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের এখানে অতীত চর্চিত হয় আইন হিসেবে।
ইতিহাস তো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহৃত স্টোররুমের মতো। আমাদের মজ্জাগত সংস্কারের কথা বলে চলে, বলে আমাদের পূর্বপুরুষের যাপিত জীবনের কথা। মানুষ চূড়ান্ত বিচারে অনুকরণশীল প্রাণী বলেই আমি মানি। জন্মমুহূর্তে সে নির্জ্ঞান হলেও পূর্বপুরুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করে, পথচলার মার্গ প্রদর্শন করে।
মানুষ নামের প্রাণীর গুহাচারী ভ্রাম্যমাণ রূপ থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগুন-লোহা, বর্ণ-ভাষা, বিজ্ঞানের যোগ হওয়ার ফলেই কিন্তু আমরা এখন নিজেদের সভ্য প্রজাতি হিসেবে দাবি করি। ফলে ইতিহাসকে অস্বীকার করলে আমরা যেমন নেই হয়ে যাই, একইসঙ্গে সময়ের সঙ্গে সেই ইতিহাসকে পরিমার্জন করে, পূর্বের থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কিছুকে আত্তীকরণ না করলেও কিন্তু আমরা এক জায়গায় স্থির হয়ে যাই। ফলে প্রকৃতিগত কারণেই তার পূর্বপুরুষ যে জায়গা থেকে শেষ করে, পরের প্রজন্ম সেখান থেকে নতুন করে শুরু করে। পুরাতন জীবনের অভ্যস্ততা, একঘেয়েমি এবং অসুবিধা থেকেই কিন্তু নতুন প্রজন্ম নতুনের দিকে ধাবিত হয়, আবিষ্কার করে নতুন কিছু, ধ্বনিত হয় নতুনের জয়গান। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে এই পুরাতনের প্রতি অবজ্ঞা আর নতুনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয় ‘জেনারেশন গ্যাপ’ নামক টার্মটি।
উদাহরণ হিসেবে একটা বিষয় আনা যেতে পারে। আজকে থেকে মাত্র তিন-চার দশক আগেও বিয়ের আগে নারী-পুরুষের পরিচিত হওয়ার বিষয়টিকে ভাবাই যেত না বা সোজা কথায় প্রেম করে বা একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ব্যাপার সেখানে ছিল না। কিন্তু কয়েক দশকেই কিন্তু প্রেম বা পরস্পরকে বোঝাপড়ার বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। আর এখন তো বিবাহপূর্ব লিভ টুগেদারও নানা দেশে আইনিভাবে সিদ্ধ।
সুতরাং, সমাজের জন্য প্রকৃতপক্ষে যেটা কল্যাণকর আস্তে আস্তে তা সহনশীল হয়ে যায় বা আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে তা প্রচলিত হয়ে যায়। তার মানে এক প্রজন্মের কাছে যেটি নমস্য, ধ্রুব সত্য, পালনীয়; আরেক প্রজন্মের কাছে তা ঠুনকো সংস্কার হিসেবে প্রতিভাত হওয়া সময়ের ব্যবধান মাত্র। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানসিক দ্বন্দ্বও সেখানে অনিবার্য।
ইদানিং প্রায়ই শোনা যাচ্ছে সন্তানেরা বাবা-মার ভরণ-পোষণ বা অন্য দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অনুরূপ নতুন প্রজন্ম ভুগছে হতাশায়, নিঃসঙ্গতায়। ডিজিটাল মিডিয়া বা স্যোশাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়িত সন্তানেরা হতাশা-আত্মহনন, কষ্ট-দুঃখের কথা বলে। যে বয়স তারুণ্যের, নতুনত্বের, বিস্ময়ের, নতুন কিছু করবার, আবিষ্কারের; সে বয়সে কেন তাদের সিংহভাগ এসব বলে? কেন নতুন প্রজন্ম পরিবার থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গিয়েছে? কয়েকদিন পর পর তাদের আত্মহনন, ডিপ্রেশন, মাদকে আসক্ত হবার, বিভিন্ন ক্রাইমে যুক্ত হবার খবর আসে? প্রতিনিয়ত এমন নিউজ আমাদের সামনে আসে এবং নতুন ইস্যু আসলে আবার আমরা এসব বেমালুম ভুলেও যাই।
সত্য বলতে আমাদের এই মেনে নেয়া, কোনো বিষয়কে শুরুতেই গুরুত্ব না দেয়া, আর বেমালুম ভুলে যাওয়ার প্রবণতাই আমাদের মেরেছে। কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন এমন ঘটনার পর নিজেদের নিয়ে ভেবেছেন? একবার প্রশ্ন করেছেন কেন তারা এমন করল? আর যারা ভেবেছেনও আমি শতভাগ নিশ্চিত ৯০ ভাগই পুরো দোষটা ভিক্টিমের ওপরেই বর্তিয়ে রাতে সুখনিদ্রা দিয়েছেন।
একটি দুটি একই ঘটনা ঘটে, তখন তা বিচ্ছিন্ন হতে পারে। কিন্তু যখন একই ঘটনা বিভিন্নভাবে ঘটে, বার বার ঘটে, তখন তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বৈকি।
আমার ব্যক্তিকভাবে মনে হয় এ ঘটনাগুলো সংঘটিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ‘জেনারেশন গ্যাপ’। হ্যাঁ, আরও বহুকারণ এটির পেছনে ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করে এ বিষয়ে আমি তর্কে জড়াতে চাই না। তবে এটিই অন্যতম প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। পূর্বপুরুষের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা ঠুনকো নয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনটা মেনে নেয়া জরুরি। পুরাতন প্রজন্ম যারা নিজেরাই একসময় ১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে স্কুলে গিয়েছেন, তারা এখন ১০ মিনিট দূরত্বের রাস্তায় রিকশা নেন। তাহলে জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে কেন আপনারা নতুন প্রজন্মের কাছে আপনাদের প্রজন্মেরই কার্যকলাপ, আপনাদেরই যাপিত জীবন আশা করেন? যেখানে আপনারা নিজেরাই এর রক্ষা করতে পারছেন না!
অনেকেরই বুঝতে হবে এই প্রজন্ম আকাশ দেখেনি, পাখি-লতাপাতা, মাটির সোঁদাগন্ধ পায়নি, উপভোগ করতে পারেনি জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য; এরা মাঠ পায়নি, আঙিনা পায়নি, মায়ের আঁচলের সুরক্ষা পায়নি। এরা মায়ের কিংবা দাদীর বুকে শুয়ে রূপকথার গল্প, আলাদিনের চেরাগ কিংবা রাজপুত্রের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমাতে পারেনি। এরা তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনাদের কাছে ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করা আর নিজের ওজনের সমান স্কুল ব্যাগ কাঁধে পেয়েছে। স্কুলে কার সঙ্গে মিশতে হবে, স্ট্যাটাস মেনে কীভাবে চলতে হবে সেসবের সবক পেয়েছে।
আপনাদের অফিস থেকে ফেরার পথে উন্মুক্ত হয়ে আপনার কাছে চাওয়া সময়ের বিনিময়ে পেয়েছে হাতে একটা নতুন উড়ন্ত বিমান বা রোবট অথবা কোনো ভিডিও গেমস। স্কুলের ছুটির দিনগুলোতে আপনারা তাদের এক্সট্রা টিউশন আর কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন! সোজাকথায় আপনারা তাদের শৈশব-কৈশোর সব কেড়ে নিয়েছেন অথচ এসব কিছুর বিনিময়ে আপনারাই আবার তাদের মধ্যে এখন আবেগ খোঁজেন, যখন আপনিই তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন খেলনা রোবট। তাই সব দোষ আসলে একটা প্রজন্মের ওপর বর্তালেই সমস্যার সমাধান হয় না। অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে আপনি হয়ত সাময়িক মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাবেন, কিন্তু সমস্যাটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
সভ্যতা আমাদের যা দিয়েছে, নিয়েছে তার চেয়েও বেশি। এটি অনেক জটিল আলোচনা। কিন্তু এতটুকু আমাদের অস্বীকার করার আসলেই কোনো পথ আর নেই যে, এ দায় শুধু নতুন প্রজন্মের নয়। আমাদের নিজেদেরও।
ডিজিটালাইজেশনের ফলে একচাপে আমরা পুরো পৃথিবী যেখানে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছি, তখন সেই সুবিধা নিয়ে বড় হওয়া প্রজন্মের চাওয়াগুলোও আমাদের থেকে ভিন্ন, একথা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে চাই না। আমাদের মধ্যে যে ছোট ছোট কারণে আবেগের বা বিস্মিত হবার ক্ষমতা তা তাদের মধ্যে নেই। ফলে তাদের আনন্দ, তাদের পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তাদেরকে সময় দিতে হবে, শুধু নিজেদের না তাদের পছন্দ-অপছন্দকেও গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের নতুন প্রজন্ম এভাবেই হতাশায় ম্লান হয়ে যাবে, মাদকে ডুবে যাবে, সেই মাদকের জন্য অতিরিক্ত টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আপনাদেরই গলায় ছুরি চালাবে। বিগত দিনগুলোতে আপনারা এমন নিউজ কি পড়েননি? অথচ আপনারা এই আত্মসুখে ঢেকুর তুলে শুতে গেছেন যে, আপনার সন্তান এমন নয়।
আপনি কি আসলেই জানেন আপনার সন্তান এমন নয়? আপনি কি পুরোপুরি নিশ্চিত আপনার সন্তান কারো গলায় ছুরি ধরেনি? হ্যাঁ, আপনি হয়ত নিশ্চিত, তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে যিনি গত নিউজে সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন, তিনিও আপনার মতো নিশ্চিতই ছিলেন যে তার সন্তান এমন নয়।
সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে আমাদের নতুন করে ভেবে দেখার। তাদের প্রতিটি কাজকে পুনর্বিবেচনা করার। একটা বয়সসীমা পার হবার পর তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
আমাদের পূর্বপুরুষ বা আমরা সেই স্পেসটি পাইনি বলেই তাদের জন্যও সেটি ক্ষতিকর তা কে বলল? আমাদের মনে রাখা দরকার, আমরা যে চিঠির যুগে বাস করেছি অর্থাৎ কাউকে একটা প্রয়োজনীয় খবর পৌঁছাতে যেখানে ২/৩ দিন সময় লাগত, সেখানে তারা অপ্রয়োজনীয় কথাও জানাচ্ছে ২/৩ সেকেন্ডে!
তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের যুগে বাস করে চিঠির যুগের সঙ্গে তাদের তুলনা করতে আপনাদের আরেকবার ভাবা উচিত নয় কি? আপনাদের বুঝতে হবে প্রত্যেকটা প্রজন্মের একটা পালস আছে, সেটার সঙ্গে নিজেদেরই মানিয়ে নিতে হয়। আপনাদের সময় হয়নি বলে যদি আপনি তা অস্বীকার করেন, তবে বৃন্তচ্যুতি আপনারই ঘটবে, তাদের নয়।
‘জেনারেশন গ্যাপ’ না থাকলে প্রকৃতপক্ষে বুঝতে হবে আসলে আমাদের সমাজ স্থবির হয়ে গেছে। যেহেতু প্রজন্মের এই দ্বন্দ্ব একটি সামাজিক প্রক্রিয়ারই অংশ, সেহেতু একে অস্বীকার করার কোনো পথ আমাদের নেই। ফলে এটিকে কীভাবে সহনশীল পর্যায়ে রাখা যায় এবং দুটো প্রজন্মকেই একটা সমন্বয়ের মধ্যে আনা যায় তা নিয়ে আসলেই আমাদের ভাবা উচিত। আর এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা মানে পুরাতন প্রজন্ম এগিয়ে আসবেন। সব দোষ যে তাদের নয়, এটা মেনে নিয়ে তারা কী চায়, তাদের মতামতকে গুরুত্ব ও ভালোবাসার সঙ্গে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে যেন আবেগের বিকাশ ঘটে, তারা যেন মানবিক হয়ে ওঠে, অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতে শেখে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতার চর্চা করতে পারে তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আর তা নিশ্চিত করতে তাদেরকে প্রচুর সময় দিতে হবে, তাদের ভালবাসতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে নতুনেরা আপনার উপদেশ গ্রহণ করে নয়, আপনার ব্যবহারকেই অনুকরণ করে অবচেতন মনে। তাই নিজেকে পালটান, দেখবেন আপনার প্রজন্মও পালটে যাবে। নইলে আমাদের বাবা-মা, আমাদের আত্মীয়-স্বজনরাই যেমন রাস্তায় পড়ে থাকবে, তেমন আমাদের উত্তর প্রজন্মই মানুষ হবে ডে কেয়ারে, ভারি ব্যাগ কাঁধে। আর কে জানে এরাই বড় হয়ে কোনোদিন আপনার গলায় ছুরি বসাবে, ছিনতাই করবে। নইলে আপনার সন্তানই মেতে ওঠবে ‘blue hole’ নামক মরণ গেমসে, ঝুলে পড়বে ফ্যানের সিলিংয়ে, কিংবা পুরো পরিবারকে হত্যা করে নিজেও আত্মহননের পথ বেছে নেবে!
লেখক : প্রাবন্ধিক