বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে কারণে লকডাউন সফল হচ্ছে না

  •    
  • ২৯ এপ্রিল, ২০২১ ১৩:৪২

লকডাউন দিয়ে সবকিছু বন্ধ করে করোনা প্রতিরোধের চেয়ে ওই সময়ে কেউ যাতে অনাহারে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুর হার দুই শতাংশের কিছু কম-বেশি। কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে গণহারে মানুষ মরবে। সুতরাং, সাধারণ মানুষ যদি দেখে যে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি তার রুটিরুজিতে আঘাত করছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা নেই, তখন তাকে লকডাউন মানানো সম্ভব নয়। এমনকি সে কারফিউ ভেঙেও রাস্তায় নামবে জীবিকার সন্ধানে।

করোনা সংক্রমণরোধে চলমান বিধিনিষেধের মেয়াদ আগামী ৫ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যদিও দোকান ও শপিং মল সকাল ১০ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বন্ধ গণপরিব্হন।

প্রশ্ন হলো, দেশে আদৌ লকডাউন চলছে কি না? গণপরিবহন বলতে শুধু বাস-ট্রেন ও লঞ্চ বন্ধ। কিন্তু রাজধানী ঢাকার রাস্তায় দিনভর প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশার কারণে তীব্র জ্যাম। চলছে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানও। রিকশা ও মোটর সাইকেল তো আছেই। উবার-পাঠাও অ্যাপস বন্ধ থাকলেও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করছেন মোটরসাইকেল চালকেরা। বিভিন্ন সড়কে অটো ও লেগুনাও চলাচল করছে।

দোকান ও শপিং মল খোলা রেখে আদৌ লকডাউন হয় কি না, সে প্রশ্নও উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। তার মানে পুরো বিষয়টি নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা বা একধরনের বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সরকারি নির্দেশনার কোথাও নাগরিকের চলাচলের জন্য মুভমেন্ট পাসের কথা বলা না হলেও পুলিশ এখনও বলছে যে, মুভমেন্ট পাস লাগবে। যদিও শুরুর দিকে এই পাস নিয়ে যেরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তা বন্ধ হয়েছে। এসব ছাপিয়ে মূল যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো- মানুষ কি লকডাউন চায় না বা না চাইলে কেন চায় না? তারা কি করোনার ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না নাকি তাদের আত্মবিশ্বাস বেশি? প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেখানে মৃত্যুর বিভীষিকা— সেখানে আমাদের দেশের মানুষ কী করে এমন নির্ভার ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন?

সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে চলমান লকডাউন নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। অনেকে বলছেন, রাজধানীসহ সারা দেশের জীবনযাত্রা যেখানে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক, সেখানে আবারও সাতদিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপনের হেতু কী?

বিষয়টি হয়তো এরকম যে, এখন পরিস্থিতি যা তাতে লকডউনের বিকল্প নেই। আবার সামনে ঈদ। ব্যবসায়ীরা আগের দুটি ঈদে লস করেছেন। এবার সেটা চান না। মার্কেট খুলে দেয়ার দাবিতে এ মাসের শুরুতে একাধিকবার বিক্ষোভ করছেন রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা। তারা মিছিল নিয়ে আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করেন। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নীলক্ষেত নূর ম্যানশনসহ বেশ কিছু মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারী রাস্তায় অবস্থান নেন। রাজশাহীতেও বিক্ষোভ করেছেন আরডিএ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, রাজশাহী শিক্ষানগরী। এক বছর ধরে করোনার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই মন্দা পরিস্থিতিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

গত বছরের লকডাউনে এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরকারি প্রণোদনা পাননি। মূলত রমজান মাসে ব্যবসা হয়। এই সময়ে মার্কেট বন্ধ থাকলে তারা আরও ক্ষতির শিকার হবেন। সব মিলিয়ে সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের একটা চাপ ছিল। সেসব বিবেচনায় নিয়ে দোকান ও শপিং মল খুলে দেয়া হয়। তার মানে লকডাউন চলবে, শপিং মলও খুলবে। যাদের দরকার তারা শপিংয়ে যাবেন। সরকার হয়তো ভাবছে, গণপরিবহন বন্ধ থাকলে মার্কেটে ভিড় তুলনামূলক কম হবে। কারণ অনেকে লকডাউনের কারণে মার্কেটে যাবেন না। অর্থাৎ সব কুল রক্ষার একটা চেষ্টা।

লকডাউনের মধ্যেও মার্কেট খুললেও দোকানদার ও ক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কড়াকড়ি রয়েছে।

বাস্তবতা হলো, এখনও রাস্তায় অনেকেই মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়ান। টেলিভিশনের সংবাদে দেখা গেছে অনেকে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে শপিং মলে গেছেন। এ রকম জরুরি পরিস্থিতিতে খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো শপিং মলে যাওয়া এবং তাও শিশুদের সঙ্গে নিয়ে— এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার রাজধানীতে মাস্ক পরার প্রবণতা দেখা গেলেও ঢাকার বাইরের চিত্র একেবারেই আলাদা। গত শুক্রবার রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখানে জুমার নামাজের জন্য একটি দোতলা মসজিদে ঢুকি। চারপাশে খেয়াল করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। প্রশ্ন হলো, তাহলে কাদের করোনা হচ্ছে এবং কারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন?

অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে সাহসী এবং এখানের সাধারণ মানুষ দিনের বড় সময়ই ওপেন এয়ারে বা খোলা হাওয়া ও রোদে বসবাসের কারণে তাদের শরীরে ভিটামিন ডিয়ের ঘাটতি নেই এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। মাস্ক না পরার পরও করোনায় গণহারে সাধারণ মানুষের সংক্রমিত না হওয়ার এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়। তবে শুধু এ কারণেই যে মানুষ লকডাউন চায় না বা সরকার লকডাউন দিলেও তা মানতে চায় না, তা নয়। বরং এখানে মূল কারণ অর্থনৈতিক।

এখনও দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী দিনের আয়ের ‍ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং একটানা ২১ দিন যদি সবকিছু বন্ধ থাকে, কাজ না থাকে, তাহলে ওই ২১ দিন তারা পরিবার নিয়ে কী খাবে— সেটি একটি বড় চিন্তা।

গত বছরের লকডাউন বা সাধারণ ছুটির সময়ে সারা দেশে গরিব মানুষের জন্য সরকারি সহায়তা বা ত্রাণের যে ব্যবস্থা ছিল, এবার তা ছিল না। ফলে এবার শুরু থেকেই লকডাউন বা নিষেধাজ্ঞা মানার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের একটা গাছাড়া ভাব ছিল। বিশেষ করে রিকশাচালক রাস্তায় নেমেছেন। কোথাও কোথাও পুলিশ রিকশা উলটে দিয়েছে। তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনাও হয়েছে। কারণ লকডাউন দিয়ে সবকিছু বন্ধ করে করোনা প্রতিরোধের চেয়ে ওই সময়ে কেউ যাতে অনাহারে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুর হার দুই শতাংশের কিছু কম-বেশি। কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলে গণহারে মানুষ মরবে। সুতরাং, সাধারণ মানুষ যদি দেখে যে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি তার রুটিরুজিতে আঘাত করছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা নেই, তখন তাকে লকডাউন মানানো সম্ভব নয়। এমনকি সে কারফিউ ভেঙেও রাস্তায় নামবে জীবিকার সন্ধানে।

বাংলাদেশের মানুষের লকডাউন বা কড়াকড়ি বিধিনিষেধ মানতে না চাওয়ার আরেকটি কারণ অতি উৎসাহ। যেমন লকডাউন মানে সবাই ঘরে থাকবে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হবে না। কিন্তু তার মধ্যেও অনেকে বাইরে বেরিয়েছেন লকডাউন কেমন চলছে তা দেখার জন্য।

বাংলাদেশের মানুষ লকডাউন মানতে চায় না, এর আরেকটি কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। তারা মনে করে, বাংলাদেশের ওপর সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমত আছে। অতএব, এখানের পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হবে না। রাস্তাঘাটে বা বাজারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যে কারণে যার বা যাদের পরিবারের কেউ করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন বা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের বাইরে অধিকাংশ মানুষই করোনাকে পাত্তা দিতে নারাজ। অর্থাৎ যতক্ষণ না নিজের ঘরে আগুন লাগছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই বিশ্বাস করতে চায় না যে, আগুন তার ঘরেও লাগতে পারে।

কিন্তু এই অবস্থার অবসান হবে কী করে? এ বছরের বছর করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে যাওয়ার পরে সারা দেশে মানুষ যেভাবে মাস্ক ছাড়া বেপরোয়া চলাচল করে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও সেন্ট মার্টিনসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে যেভাবে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয় এবং যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না; যেভাবে শপিং মলে মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড় দেখা যায়—তাতেই করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

এবার শুধু গণপরিবহন বন্ধ রেখে যে লকডাউন চলছে সেটিও মনে হয় ঈদের সপ্তাহে ভেঙে পড়তে পারে। কারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে হয়তো ঈদের আগের সপ্তাহে সরকার গণপরিবহন চালু করে দেবে। তখন আবার লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন এবং ঈদের পরে তারা আবার বাস, লঞ্চ, ট্রেনে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরবেন। তখন যদি করোনার প্রকোপ আবার বেড়ে যায়, তাহলে পুনরায় লকডাউন দেয়া হবে? যদি তাই হয়, তাহলে সেটি করোনার সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা হবে—যা আখেরে কোনো ভালো ফল দেবে না। তাহলে উপায় কী?

বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেহেতু এরইমধ্যে এটা প্রমাণিত যে, এখানে আদর্শিক লকডাউন কোনোভাবেই কার্যকর সম্ভব নয় এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তত তিন সপ্তাহ খাবার নিশ্চিত করা না গেলে মানুষ রাস্তায় নামবেই— ফলে লকডাউনের বিকল্প নিয়েই ভাবতে হবে। সেটি হলো, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সাহস ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, অতএব তাদের ঘরবন্দি করে না রেখে, তাদের জীবিকা বন্ধ না করে, সবাই যাতে অবশ্যই মাস্ক পরে চলাফেরা করেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রথমত কঠোর হতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষকে উদ্বুদ্ধও করতে হবে। তবে যেহেতু শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে করোনায় সংক্রমিত হওয়া বা এতে মৃত্যুবরণের সংখ্যা কম, ফলে তাদের চেয়ে অন্য পেশার মানুষ, যারা দিনের একটা অংশ এসির ভেতরে বা বদ্ধঘরে থাকেন, তারা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, তার উপরে জোর দেয়া দরকার। ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে দেয়া দরকার। জীবন-যাপন স্বাভাবিক করে দিয়ে করোনার সঙ্গে বাঁচতে শেখার পথ বের করা দরকার। সরকার অবশ্য এখন সেটিই করছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর