‘মুখচোরা, লাজুক ছেলেটি একদিন অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করবে তা কে ভাবতে পেরেছিলো!' লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পরিচিত সকলের কাছে বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর। অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ছেলে। তার পছন্দের কাজ ছিল বইপড়া। খোঁজ নিলে তাকে পাওয়া যেত বাড়ির দূরবর্তী কোনো এক ঘরে বসা অবস্থায়, হাতে থাকত বই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তার পিতা বঙ্গবন্ধু যখন দেশের সকলকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামার আহ্বান জানান তখন পরিবারের সকলের সঙ্গে গৃহবন্দি ছিলেন শেখ জামাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সেই বন্দিশালা থেকে কাঁটাতার টপকে পালিয়ে যান তিনি। পদে পদে লুকিয়ে থাকা বিপদ উপেক্ষা করে ভারতে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে। আজ (২৮ এপ্রিল) এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামালের ৬৮তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মৃত্যুর ওপারে থাকা লেফটেন্যান্ট।
১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ জামাল। টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী এবং একজন সফল ক্রীড়াবিদ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ জামালও গৃহবন্দি ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দেন তিনি। তিনি পাকিস্তানি পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৫ আগস্ট পলায়ন করে ভারতের আগরতলা চলে যান। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছান উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধা। রাইফেল কাঁধে অসীম সাহসের সঙ্গে পাকিস্তানি শত্রুর মোকাবিলা করে দেশকে মুক্ত করেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধের পোশাকেই ফ্রন্ট থেকে শেখ জামাল ঢাকায় ফেরেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এদিন প্রথম বঙ্গমাতা ও শেখ হাসিনাসহ ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হয় শেখ জামালের। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর হয়। ওই দিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায়ও যোগ দেন তিনি। তারপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে পিতার কাছে সামরিক পোশাকেই অন্য দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ রাসেলসহ উপস্থিত ছিলেন তিনি।
দেশপ্রেমিক চৌকস-মেধাবি সেনা অফিসার ছিলেন শেখ জামাল। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার ছিলেন।
২৯ জানুয়ারি ১৯৭৪। ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। শেখ জামালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রবল আগ্রহ দেখে মার্শাল টিটো তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৪ সালের বসন্তে ঢাকা কলেজের ছাত্র জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশে ভাষার অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখ জামালের পক্ষে কঠিন ছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্শাল টিটো শেখ জামালকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
১৯৭৫ সালের ২৭ জুন ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে সভরিন (পার্সিং আউট) প্যারেডে অংশ নেন শেখ জামাল যেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজকুমারী এলিস। এদিন বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে কমিশন লাভ করেন শেখ জামালসহ আরও দুজন। ১ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে স্যান্ডহার্স্টের রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স শুরু হওয়ার কথা ছিল, যেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল শেখ জামালের। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য এই কোর্সে অংশগ্রহণ না করে দেশে ফিরে আসেন শেখ জামাল। এ সময় তিনি দেশে ফিরে না আসলে হয়ত ১৫ আগস্টের নৃশংস সেই ইতিহাস থেকে রক্ষা পেত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের আরেকজন সদস্য।
ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে চাকরিকালে স্বল্প সময়েই অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তিনি অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই শেখ জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাদেরই একজন হয়ে যান। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে, রণকৌশলের ক্লাসে, অবস্টাকল ক্রসিংয়ে অংশ নিয়ে সৈনিকদের মুগ্ধ করেন। ব্যাটালিয়ন বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। জীবনের শেষ দিনটিতে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে নিজ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া শেখ জামালের জীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি পড়ালেখা ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে দুর্দান্ত সাফল্য দেখান। শেখ জামাল ছিলেন ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড়। বাংলাদেশ আবাহনী ক্লাবের সঙ্গেও শেখ কামালের পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন শেখ জামাল। তিনি প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন।
ক্রীড়াপ্রাণ শেখ জামাল ১৯৭২ সালে আবাহনী ফুটবল দলেও ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ঢাকা ফুটবল লিগে খেলেছিলেন। ফুটবলে তিনি রক্ষণভাগে খেলতেন। এ ছাড়াও ক্রিকেটের প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল শেখ জামালের। তোফাজ্জল হোসেন স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে তিনি ‘শেখ জামাল একাদশ’-এর হয়ে খেলেছেন। সে বছর ‘শেখ জামাল একাদশ’ দলটি শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল। শেখ জামাল আবাহনী ক্রীড়া চক্রে ক্রিকেটও খেলতেন। তার নামে গড়ে উঠেছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। ক্রিকেট ফুটবল ছাড়াও বাস্কেটবল ও ভলিবল খেলতেন শেখ জামাল।
শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা শেখ জামাল গিটার শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ জামালকে হত্যার বিষয়টি পৃথকভাবে স্থান পায় বিশ্ব মিডিয়ায়। কেননা তার কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো স্যান্ডহার্স্ট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য যাওয়া প্রশক্ষণার্থীদের একজন ছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে সেনাবাহিনীরই একটি অংশের হাতে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়। যারা মনে-প্রাণে পাকিস্তান ও আমেরিকার মদদপুষ্ট গোষ্ঠী ছিল তাদের কারণেই খুন হন তিনি। এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের রক্তপাত যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা করেছিল, তাদের সেনা আইনে বিচার করেনি তৎকালীন সেনাপ্রধান। শহীদ শেখ জামাল শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। যিনি ওই রাতেই শহীদ হয়েছিলেন সকলের সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল আগের মাসে ১৭ জুলাই। ঘাতকের বুলেট তাদের স্মৃতিকে বিলোপ করতে পারেনি বরং মৃত্যু অমর করেছে তাদের অবদানকে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।