বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শেখ জামালের সাহস

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ২৮ এপ্রিল, ২০২১ ১৫:৫৩

শেখ জামালের খবরটা তখন কৌশলগত কারণে চেপে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। এই ইস্যুতে প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের তীব্র চাপে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি ছাপা হয়। তেমনি একটি ছবিতে সীমান্তের দশ মাইল ভিতরে একটি রণাঙ্গনে সাব-মেশিনগানধারী এক কিশোরকে দেখা যায়। সেই কিশোরটাই ছিলেন শেখ জামাল।

১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট। ধানমণ্ডির ২৬ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর (বর্তমানে ৯এ) বাড়ি থেকে এক বন্দি পালিয়ে গেলেন। বন্দির নাম শেখ জামাল। এ বাড়িতে বন্দি থাকা সবাই ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এ বাড়িতে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু কিশোর শেখ জামাল সে বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে এলেন। কিশোরই তো। তার বয়স তখন ১৭ বছর তিন মাস হয়েছে কেবল। আগে থেকে কেউ তার পালিয়ে যাওয়াটা টেরও পাননি। না তার পরিবারের কেউ, কিংবা পাহারাদার সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য- কেউই না। নিশ্চয়ই বেশ কিছুদিন থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন শেখ জামাল। অপেক্ষার পর সুযোগ পেয়ে নিজেকে মুক্ত করে ফেললেন। মুক্ত হয়ে কোথায় গেলেন?

ওই বাড়িতে তখনও বন্দি মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বড় বুবু শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা, ছোটভাই শেখ রাসেল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাবা শেখ মুজিবকে বন্দি করে নিয়ে যায়। তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি আক্রমণ করার ঠিক আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বড় ভাই শেখ কামাল। তারপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ কামাল ছিলেন মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি।

বড়ভাই শেখ কামালের বয়স তখন ২২ বছর। আর শেখ জামালের আঠারোও হয়নি। তাতে কী! মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অদম্য এক সংকল্প করে রেখেছেন শেখ জামাল। মাকে বলে যাননি। কারণ বলতে গেলে যদি বয়স কম হওয়ার যুক্তিতে অনুমতি না মেলে!

ভাইবোনদের মধ্যে বেশ চাপা স্বভাবের ছিলেন শেখ জামাল। সহজে মনের কথা প্রকাশ করতেন না। সবসময় বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। প্রচণ্ড বই পড়ুয়া ছিলেন। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও কাছে পাননি খুব একটা। কী করে পাবেন! জন্মের পর থেকেই তো বাবাকে জেলে আর রাজনীতিতে বাড়ির বাইরে কাটাতে দেখেছেন।

শেখ জামালের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার জন্মের ঠিক বারোদিন পর ১৯৫৪ সালের ১০ মে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বাবা মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে পুরো পরিবার তখন মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনের বাসিন্দা। কিন্তু ওই বছরই ৩১ মে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। ওই সময় গ্রেপ্তার হয়ে সাতমাস জেলে বন্দি ছিলেন বাবা শেখ মুজিবুর রহমান।

শিশু বয়স থেকেই বাকি ভাইবোনদের মতো বাবার জেল জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন শেখ জামাল। মাঝে মাঝে মায়ের কোলে চড়ে বাবাকে জেলখানায় দেখতে যেতেন। জেলবন্দি বাবার কাছ থেকে আর কতটুকুইবা আদর স্নেহ পেয়েছেন! এরপর তো বাবাকে দেখেছেন কীভাবে নেতৃত্ব দিয়ে পুরো বাঙালি জাতিকে এক বিন্দুতে এনেছেন। সেই বিন্দুর নাম স্বাধীনতা। পরাধীন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন তারই বাবা। আর সেই তিনি কী করে বন্দি থাকেন!

তারকাঁটার বেড়া দেয়া বাড়ি থেকে কিশোর শেখ জামাল পালিয়ে গেলেন। নিরুদ্দেশের পরেই শুরু হয়ে গেল তার খোঁজাখুঁজি। খোঁজ না পেয়ে মায়ের সন্দেহ হলো পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর। কদিন ধরে ওদের হাবভাবও ভালো ঠেকছিল না। ওরা শেখ জামালকে গুম করে দেয়নি তো! পাকিস্তানিদের বিশ্বাস নেই। নিরীহ মানুষদের ওপর যারা রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলি চালায়, তাদের কে বিশ্বাস করবে? পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছেলে শেখ জামালকে অপহরণের অভিযোগ তুললেন মা। পুরো বিশ্বে সে খবর প্রচার হলো। বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো শেখ জামালের নিখোঁজ হওয়ার খবর।

ততদিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছে গেছেন কিশোর শেখ জামাল। তারপর আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে পৌঁছে গেলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। যোগ দিলেন মুজিব বাহিনীতে। ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ নিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে চলে গেলেন রণাঙ্গণের ৯ নম্বর সেক্টরে।

শেখ জামালের খবরটা তখন কৌশলগত কারণে চেপে গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। এই ইস্যুতে প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের তীব্র চাপে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিছু মুক্তিযুদ্ধের ছবি ছাপা হয়। তেমনি একটি ছবিতে সীমান্তের দশ মাইল ভিতরে একটি রণাঙ্গনে সাব-মেশিনগানধারী এক কিশোরকে দেখা যায়। সেই কিশোরটাই ছিলেন শেখ জামাল। সেই ছবিতে কোনো কিশোরের মুখায়ব নয়, ফুটে উঠেছিল সংকল্পবদ্ধ সৎ সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি।

স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরলেন ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তাকে পেয়ে সেদিন মা আর ভাইবোনদের কী যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস!

শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। খুব ইচ্ছের কারণে গিটার শিখতে ভর্তি হলেন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া ক্রিকেটও খেলতেন নিয়মিত। হয়ত গিটারিস্ট বা ক্রিকেটার হতেন। কিন্তু ছায়ার মতো তার সঙ্গী ছিল সৎ সাহস। সেই দুঃসাহসের পালে হাওয়া দিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো।

১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন মার্শাল টিটো। আলাপচারিতায় শেখ জামাল জানালেন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান। সঙ্গে সঙ্গে মার্শাল টিটো তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। দুমাস পরেই ১৯৭৪ সালে বসন্তে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন শেখ জামাল। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষাগত সমস্যার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। মার্শাল টিটো তাকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের পরামর্শ দেন।

১৯৭৪ সালের শরতে লন্ডনে গেলেন শেখ জামাল। কিন্তু সরাসরি স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেন না। তার আগে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকসফিল্ড থেকে কিছু পূর্ব প্রশিক্ষণ নিতে হলো। তারপর স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনে ছয় মাসের সুকঠিন গ্রাজুয়েট কোর্স করেন।

১ আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টে নিয়মিত ক্যারিয়ার কোর্সের সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাননি শেখ জামাল। কারণ তার প্রিয় দুই বন্ধু দেশে ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া অনেকদিন মায়ের সান্নিধ্যে থেকেও বঞ্চিত। মাকে না দেখে কতদিন থাকা যায়! মা যে তার খুব প্রিয়।

ফিরে এলেন ঢাকায়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পোস্টিং হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। কোম্পানি অফিসার হিসেবে শুরু হলো রেজিমেন্ট-জীবন।

প্রায় দেড় মাসের পেশাদার সৈনিক জীবন পেয়েছিলেন শেখ জামাল। তবু এই সামান্য সময়েও পেশাগত দক্ষতা ও কাজের প্রতি ভীষণ রকম আন্তরিক ছিলেন। ইউনিট মাঠে সৈনিকদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলেন, বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। সন্ধ্যায় সৈনিকদের সঙ্গে মেসে রাতের খাবার খান।

রাষ্ট্রপতির সন্তান হিসেবে আলাদা কোনো সুযোগ কখনও নেননি। বরং নিজের টাকায় কোম্পানির সৈনিকদের জন্য উন্নতমানের প্লেটের ব্যবস্থা করেন।

এমনকি মায়ের নির্দেশে, গাড়িতে করে নয়, অন্য তরুণ অফিসারদের মতো মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টমেন্টে যাতায়াত করতেন।

১৪ আগস্ট ১৯৭৫। ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে, মায়ের অনুরোধে রাতে বাসায় থেকে গিয়েছিলেন শেখ জামাল।

১৫ আগস্ট ভোররাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সে বাড়িতে উপস্থিত পরিবারের সবাই বিশ্ব ইতিহাসের এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। শিকার হলেন মাত্র ২১ বছর তিন মাস ১৮ দিন বয়সি শেখ জামালও।

শেখ জামালের সৎ সাহস ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। তার সৎ সাহস তারুণ্যের গর্ব। ২৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসী তনয় শেখ জামালকে জন্মদিবসের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর