বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর গর্ব শেখ জামাল

  •    
  • ২৮ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৫৩

বেগম মুজিবের কাছে লেখা তার একটি চিঠি গোয়েন্দারা ‘অসাধারণ দক্ষতায়’ জিপিও থেকে ‘আটক’ করে, যাতে ৫ মে তারিখ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- “স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।”

১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বধ্যভূমি বাংলাদেশ। সর্বত্র চলছে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট। অপরদিকে, মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তাকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির দণ্ড প্রদানের ষড়যন্ত্র চলছে।

এদিকে, ধানমন্ডির একটি ভবনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে দুই কন্যা ও দুই পুত্র এবং জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াসহ বন্দি রাখা হয়েছে। পাকিস্তান আর্মির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা সেখানে। কিন্তু এদিন (৫ আগস্ট) থেকে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বয়স তার ১৭ বছর।

অগ্রজ শেখ কামাল আগেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তিনি কীভাবে ঘরে আবদ্ধ থাকেন? পরে জানা গেল, কিশোর জামালও প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে গেছেন রণাঙ্গনে, মুক্তিবাহিনীতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত পুত্রকে দেখার জন্য ব্যাকুল এক মাকে রণাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হলে শত্রুকে তাক করে মেশিনগান চালনায় মগ্ন পুত্রকে দেখে তিনি বলেছিলেন- শাবাশ! বাহাদুর বেটা আমার- এটাই দেখতে এসেছিলাম, তুমি বীরের মতো লড়ছ। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দুঃসহ-যন্ত্রণাময় দিনগুলোতে স্বামীকে সংকল্পবদ্ধ ও আপসহীন থাকায় প্রেরণা দিয়ে গেছেন, একাত্তরে যে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে দুই কন্যা, শিশুপুত্র, জামাতা, নাতিসহ বন্দি করে রেখেছিল তাদের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ নিতে দুই তরুণ পুত্রকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছেন।

১৯৪৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু এক যুগ বন্দি ছিলেন। সে সময়ে তিনি শত শতবার কারাগারের গেটে গেছেন দেখা করার জন্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সহস্র মাইল দূরের শত্রুরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকার দিনগুলোতে এমনটি ঘটতে পারেনি। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি, পাকিস্তান আমলে যেমন বারবার বলেছেন, কখনও নত হবে না, বীরের মতো মাথা উঁচু করে থাকবে- সুযোগ পেলে একাত্তরেও বলতেন, এখন তুমি বাঙালির শত শত বছরের স্বপ্ন স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, উদ্যত বন্দুকের মুখেও নির্ভীক উচ্চারণ করে যাবে, আমি বাংলাকে ভালোবাসি। বাংলাদেশ আমার প্রাণ। বাংলার জনগণ শত্রুকে পরাজিত করতে লড়ছে। তারা হার মানতে জানে না। আমি তাদের বলে এসেছি, কেউ তোমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।

যদি হানাদারদের কঠোর নজরদারি এড়িয়ে একাত্তরের রণাঙ্গনে যেতে পারতেন, তাহলে শেখ কামাল ও শেখ জামালকেও বলতেন, বাপের মতোই সাহসী হয়েছিস। সব মুক্তিযোদ্ধার মায়েরা যেমন সন্তানকে নিয়ে গর্ব করে, তেমনি আমারও তোদের জন্য আনন্দে বুকভরে ওঠে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর মুখোমুখি, জীবন যে সার্থক তোদের।

জননী সাহসিকা চিরন্তন!

একাত্তরে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দিনগুলো কেমন কেটেছিল? বঙ্গবন্ধুর দিনগুলোই-বা কেমন ছিল? তার দিনলিপি কি পাকিস্তান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব? বেগম ফজিলাতুন্নেছা গৃহকোণে ছিলেন। জীবনের বড় অংশ কেটেছে নিভৃত পল্লিতে এক বড় পরিবারে। এ পরিবার কেবল ঘরের কয়েকজনকে নিয়ে নয়, নিকট ও দূরের স্বজন, গ্রামবাসী, দলের অগণিত নেতা-কর্মী, সবাইকে নিয়ে। কাউকেই করুণা বা অনুকম্পার পাত্র হিসেবে দেখেননি, বরং কর্তব্যবোধ থেকেই পরিচালিত হয়েছেন তিনি। ঢাকায় যখন স্থায়ীভাবে চলে এসেছেন তখনও সেই একই রূপ উদারমনা, অপরের তরে জীবন।

তার নিজের জীবন কেমন ছিল? বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, সংসারে অনটন আছে। অথচ রেণু আমাকে বলেছে, ‘যদি বেশি অসুবিধে হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব।’

আরেক স্থানে লিখেছেন-

‘বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ছেলেমেয়েদের বলি, আমি তো সারা জীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে।’

বঙ্গবন্ধু যেন নির্ভাবনায় থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে সেটাও সংসারের কাজ। ১৯৪৯ সালের শেষদিকে নিশ্চিত কারাবাস জেনেও যখন বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার পথে-

“রেণু বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল এবং কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে”।

আরেক স্থানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল,

“জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।”

বেগম মুজিব নিজেকে কখনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করেননি। মিছিলে যাননি, সম্মেলন-সমাবেশে এমনকি শুভেচ্ছা জানাতেও হাজির হননি। অথচ এমন সাহসী উচ্চারণ! একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে, যখন প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ আসছে ৩২ নম্বরে দিকনির্দেশনা নিতে- তখনও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে মুহূর্তের জন্য কেউ দেখেনি ব্যালকনি বা দরজার কাছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন জেলে, বাসা থেকে ঈদ বা অন্য বিশেষ দিনে খাবার যেত অনেক বন্দির কথা ভেবে। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ যখন উপস্থিত, আওয়ামী লীগকে ৬ দফা থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য যখন ভয়ংকর ষড়যন্ত্র, তখন দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারীদের ভরসাস্থল গৃহকোণে থাকা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, যিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতেই আয়োজন করছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভা।

যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়েছে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেকেই দিশেহারা, তিনি তখনও নির্ভিকচিত্ত। কলরেডি মাইকের হরিপদ ঘোষ আমাকে বলেছেন, এক শীতের সকালে গাজী গোলাম মোস্তফা হাতের বালা ও আরও কিছু অলংকার নিয়ে তাদের পুরান ঢাকার বাসায় হাজির, বেগম মুজিব পাঠিয়েছেন, মামলার খরচ ও সংসার চালাতে অর্থ চাই। এসব গয়না রেখে যা পারেন দেন।

আমরা চোখের জলে ভিজি, সাহসিকতার জন্য গর্ব অনুভব করি। দুই পুত্রকে রণাঙ্গনে পাঠাবেন বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারদের পরাভূত করার জন্য, তাতে আর বিস্ময় কী!

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালেই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বড় মেয়ে শেখ হাসিনার বিয়ে দিয়েছেন ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর, কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ ছিল না। ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে যখন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, দুই পুত্রের বিয়ে দেয়ার সময় সুযোগ ছিল জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করার। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্রের বউভাতে কেবল চা-মিষ্টি, আর মেজো পুত্র শেখ জামালের বিয়ে তো একেবারেই ঘরোয়া। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে একদল দর্শনার্থীর কথোপকথন আমি শুনেছি, যারা এসেছিলেন একেবারেই সাধারণ পরিবার থেকে। এক তরুণী তার বান্ধবীকে মুজিব দম্পতির দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালের বিয়ের শাড়ি দেখিয়ে বলছিল, ‘দেখ, দেখ- আমগো মতো গরিবদের শাড়ি।’ এর চেয়ে বড় প্রশংসা বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। ৩২ নম্বরের বাড়িতে তিনি এক যুগের মতো বসবাস করেছেন। কিন্তু সেখানে এয়ারকন্ডিশন্ড ছিল না, মেঝেতে বসেনি কার্পেট। লিফটের কথাও ভাবা হয়নি। এমন পরিবেশেই এ পরিবারের পাঁচ সন্তান বেড়ে উঠেছে।

১৯৭৪ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্মিত গণভবনে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে বেগম মুজিব বলেন, সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মনমানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যানধারণার সৃষ্টি হবে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বংলাদেশ, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পৃষ্ঠা ১৭৪]

শেখ জামালের জন্ম হয় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকায়, থাকেন মেসের মতো একটি বাসায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তার কাঁধে। এ সময় বেগম মুজিবের কাছে লেখা তার একটি চিঠি গোয়েন্দারা ‘অসাধারণ দক্ষতায়’ জিপিও থেকে ‘আটক’ করে, যাতে ৫ মে তারিখ দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।” [গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খণ্ড- পৃষ্ঠা ২৩৩]

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের জন্মের পর লেখা এ চিঠিটি কি প্রাপক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে পৌঁছেছিল? পৌঁছালে চিঠিটা চোখের জলে কতটা সিক্ত হয়েছিল? গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ৫ মে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ ঈশ্বরদীগামী ট্রেনে ওঠেন। পরদিন পাবনায় ছিল জনসভা। আর শেখ জামলের জন্ম ২৮ এপ্রিল।

ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শেখ জামাল ব্রিটেনের বিশ্বখ্যাত স্যান্ডহার্স্ট রয়্যাল একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করা হয়।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর