রাজধানীর পুরান ঢাকায় কিছুদিন পর পর একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত বিভিন্ন রাসায়নিকের গুদামগুলো ওই এলাকা থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উদ্বেগ আর আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে এসব এলাকার সাধারণ মানুষদের। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় সতর্ক করে জানিয়েছেন, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ রয়েছে, তা থেকে যেকোনো সময় আরও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি ভবনের নিচেই রয়েছে রাসায়নিকের গুদাম অথবা কারখানা। আর এসব এলাকায় যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তার প্রতিটিতেই ভূমিকা রাখছে এই গুদাম আর কারখানাগুলো। সম্প্রতি বংশালের বাবুবাজার ব্রিজসংলগ্ন আরমানিটোলায় এরকম এক রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে এখন পর্যন্ত মারা গেছে কলেজছাত্রীসহ ৫ জন। এছাড়াও গুরুতর দগ্ধ হয়ে ২০ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
কিছু অপরিণামদর্শী মানুষের লোভের কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছে এই এলাকার সাধারণ মানুষ। ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১২৪ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদাম বিস্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছে আরও ৭১ জন।
প্রতিটি বিস্ফোরণের কারণ ছিল রাসায়নিক দ্রব্য। অথচ, নিমতলীর মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাসায়নিকের গুদাম ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। তার পরিবর্তে বেশ দেরি করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক পল্লি স্থানান্তরে নতুন আরেকটি প্রকল্প নেয়া হয়। তবে সেখানেও অবকাঠামো নির্মাণকাজে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে।
বারবার অগ্নিকাণ্ডের মোটাদাগের একটি কারণ হচ্ছে, পুরান ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুদের জন্য ভাড়া দেন। আরমানিটোলায় যে গুদামটিতে আগুন লেগেছে সেটির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল। ৬ তলা এই বাড়িটির নিচতলা রাসায়নিকের গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এই কারখানা ও গুদামগুলোর বেশির ভাগেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদফতর কিংবা ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র।
অপরদিকে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও রাসায়নিক আমদানির অনুমোদন দিয়ে সেটা কোথায় রাখা হচ্ছে, কীভাবে রাখা হচ্ছে এর খোঁজ রাখে না। ব্যাপারটা এমন যে, অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কোনো সংস্থা আবার লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখলেও অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। এই সবকিছুর ইক্যুয়েশন হচ্ছে, নিমতলী, চুড়িহাট্টা আর আরমানিটোলার মতো ট্র্যাজেডিগুলো।
কিছুদিন আগেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ রয়েছে, তা বৈরুত বন্দরে যেসব রাসায়নিক পদার্থ মজুদ ছিল তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ ভয়ংকর সব রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো সামান্য আগুনের স্পর্শে এলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বৈরুতে লোমহর্ষক বিস্ফোরণের পর বিপজ্জনক পদার্থ বা রাসায়নিক কারখানাগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক দেশ। অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিডনিতে মজুদ করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ভারতও চেন্নাইয়ের ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। পুরান ঢাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপজ্জনক সব রাসায়নিক পদার্থের বিপুল মজুদ থাকলেও তা সরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
উল্লেখ্য, খননশিল্পে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া বোমা তৈরিতেও এই রাসায়নিক পদার্থটি বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটিকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মনুষ্য বসতির বাইরে সংরক্ষণ করতে হয়।
অপরদিকে, সার উৎপাদনেও আবার এই রাসায়নিক পদার্থটির ব্যবহার রয়েছে। তবে সার কারখানাগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাখা হয় কেবল পুরান ঢাকার বিভিন্ন গুদামে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, পুরান ঢাকার গুদামগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ড্রামভর্তি করে মজুদ করা হয় তেমনই অনেক গুদামে মজুদ থাকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন- যার সবই দাহ্য পদার্থ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে বেশকিছু রাসায়নিকের এক-একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী; যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। কারণ, এসব গুদামের কোনোটাতেই অগ্নিকাণ্ড নিরোধকের তেমন ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্যবস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। কোনো ধরনের মনিটরিং ছাড়াই যেখানে সেখানে এসব এলাকায় রাখা হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য।
২০১০ সালে নিমতলীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে প্রাণঘাতী রাসায়নিক পদার্থের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়ার দাবি উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, পরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক শিল্পজোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেয়া এবং দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য আনা-নেয়া বন্ধসহ সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। পরিতাপের বিষয় হলো, এতো বছরেও এখনও সরেনি একটি কারখানাও। উলটো, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার সুযোগে অবৈধ রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন দিনের পর দিন।
অপরদিকে এমনও ঘটেছে যে, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ঠিকানায় ব্যবসার অনুমতি নিয়ে অনেকেই পুরান ঢাকার ভেতরেই রাসায়নিকের মজুদ ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কাজকে নির্বিঘ্ন করতে তারা স্থানীয় প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবকেও কাজে লাগাচ্ছেন। তাছাড়া, এই এলাকার রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত যেমন কার্যকর হচ্ছে না তেমনই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও তাদের সমীহ করে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুরান ঢাকার লাখ লাখ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিলে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা আর গুদামগুলো অচিরেই স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
রাসায়নিক পল্লির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অস্থায়ীভাবে এই গুদামগুলো নিরাপদ কোনো স্থানে স্থানান্তর করতে হবে; এটা এখন সময়ের দাবি। নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দিকনির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন- এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দ্রুততার সঙ্গে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো এতদিনে বাস্তবায়িত হলে চুড়িহাট্টা কিংবা আরমানিটোলার মতো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না বলেই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। একটি অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভারও রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
লেখক: কবি, কলাম লেখক
mortuza.hasan.Shaikat@gmail.com