পত্রিকায় দেখলাম, নীলফামারীর সৈয়দপুরে একটি চুল কাটার সেলুন আছে। সেই সেলুনের বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে বসে বই পড়া যায়। যারা চুল কাটাতে আসেন, তারা অবসর কাটানোর জন্য বই পড়েন। আবার শুধু বই পড়ার ইচ্ছে থেকেও এই সেলুনে এসে বসা যায়, বই পড়া যায়।
৩০ বছর আগে এরকম ঘটনা দেখলে তা নিয়ে হয়তো কেউ উপ-সম্পাদকীয় লিখত না। কারণ, তখন যেকোনো মফস্বল শহরেই একাধিক পাঠাগার দেখা যেত। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও সেসব পাঠাগারের সদস্য হতো এবং কিছুদিনের জন্য পছন্দের বই নিয়ে আসত বাসায়, পরে আবার ফেরত দিত। দিন পাল্টেছে। এখন পাঠাগারের সংখ্যা কমে গেছে।
বইপড়ার অভ্যাস কমে গেছে। দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অনেক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যে পরিবর্তন এসেছে, তার অনেকগুলোই হতাশাজনক। সহজে বলে দেয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার কথা ছিল, সে দেশটি আসলে গড়ে তোলা যায়নি। বরং, ধর্মব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে গেছে দেশ। খুবই সূক্ষ্মভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সালাফি মতবাদ। সুকৌশলে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষের মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি করা হয়েছে।
চাতুরীর সঙ্গে ওয়াজ মাহফিলে সংবিধানবিরোধী বক্তব্য রাখা হয়েছে বহু জায়গায়। সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামে জিহাদের নামে অরাজকতার উস্কানি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মসজিদে খুতবার সময় সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলা হয়েছে। আর এর সবকিছুই করা হয়েছে ইসলামের নাম ভাঙিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ধর্মান্ধতার চাষবাস করা হয়েছে। দেশের জনগণের একটা বড় অংশ যে এদের প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়েছে, সেটা না বললেও বোঝা যায়।
কওমি মাদ্রাসায় যারা পড়াশোনা করেন, সরাসরি তাদের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনও শোনা গেছে, বহু কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হতো না। দেশকে, দেশের সরকারকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করেছে এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা। আমাদের দেশের মানুষ ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মীয় নেতাদের বলা কথা বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই ধর্মীয় নেতাদের একটা অংশ ধীরে ধীরে উগ্রবাদী হয়ে উঠেছে এবং তাদের বয়ানে কোনো রাখঢাক না করেই তাদের বিশ্বাসের কথা জানিয়েছে। এই ধর্ম ব্যবসা রুখে দাঁড়ানোর জন্য যেটা ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো- রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে হয়নি। কোনো ধর্মের বিরুদ্ধেই হয়নি। তবে ধর্মের নামে যে শাসন ও শোষণ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছিল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান আমল মানেই ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে বাঙালিদের শোষণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশক আমাদের সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু করে গড়ে তুলেছিল।
ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছিল। উপনিবেশবাদ বজায় রাখার জন্য ব্রিটিশদের শঠতা ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই শঠতার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে ছিল হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতারা। একটা সময় এমনও কেটেছে যে, এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়কে সরাসরি ঘৃণার চোখে দেখেছে। অথচ ইতিহাস বলে, ভারতবর্ষে মুঘল শাসন কিংবা বাংলার সুলতানি শাসনামলে ধর্মে ধর্মে এত বিদ্বেষ ছিল না। যদিও সে সময় সাধারণ মানুষ রাজা রাজড়াদের জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে অনেক দূরে বসবাস করত মননে এবং বাহ্যিকভাবেও। তবুও বলা যায়, পাশাপাশি বসবাসকারী দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের প্রতি আস্থাশীল ছিল।
পুরনো কথা বলা হলো এই কারণে যে, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের একটা বড় শক্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধূলিস্যাৎ করতে চেয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, এদেশের সকল সম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদ না করলে ধর্মব্যবসার জোয়াল কাঁধ থেকে নামানো যাবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃপ্ত নেতৃত্বে যে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ছিল বিশ্ব মানব হওয়ার পথে কায়মনে বাঙালি হওয়ার শুরু। কিন্তু শুরুতেই যে থেমে যেতে হলো, তা কোনো কাজের কথা নয়। স্বীকার করে নেয়া ভালো, বিজয়ী বাঙালি পরিশ্রম, চর্চা এবং পরমতসহিষ্ণুতার পথে না গিয়ে নিজের আখের গোছানোর স্বার্থে এমন সব মানুষ বা মতবাদকে সামনে নিয়ে এলো, যা কোনোভাবেই মুক্তির ঠিকানার খোঁজ দেয় না। শুধু তাই নয়, আকস্মিকভাবে দেশটা পিছিয়ে যেতে থাকে। যে মেধা মনন ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়, তা এখন এই বঙ্গসমাজে সুলভ নয়। উচ্চশিক্ষিত বাঙালির মেধা ও মননে মধ্যযুগীয় বর্বরতা মিলেমিশে থাকে। কথাটা যে কতখানি সত্য, তার প্রমাণ পেয়ে যাবেন ফেসবুকে এ ধরনের কোনো বিতর্কিত বিষয় নানা মানুষের মন্তব্য দেখে। দেখলেই বুঝতে পারবেন, এক ধরনের অন্ধ তাই নিজেকে সমর্পণ করেছে শিক্ষিত মানুষের একটা বড় অংশ।
রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতেও বুঝতে পারবেন, অন্তরে ধর্মকে ধারণ না করে তার বাহ্যিক প্রকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে আছে এক শ্রেণির মানুষ। ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব তাদের হৃদয়ে ঢোকেনি।
এই পরিবর্তন হঠাৎ করে আসেনি। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুহূর্তের মধ্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এ পরিণত হয়েছিল।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল মিনি পাকিস্তানে। সরকারিভাবেই এই মিনি পাকিস্তান ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিল সাধারণ মানুষের মনে। জিয়াউর রহমান তার দল এবং মন্ত্রিসভা গড়েছিলেন চৈনিক বাম, মুসলিম লীগ আর জামায়াতে ইসলামের দালালদের নিয়ে। এরা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে দ্বিধাহীনভাবে বিরোধিতা করেছে। কিন্তু প্রগতির নাম ভাঙিয়ে করেছে রাজ্যশাসন ।
দেশের সরকার যদি অবারিতভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে যা ঘটার, তাই ঘটেছে। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে চেতনার দিক থেকে। লোকসংস্কৃতি, প্রতিদিনের জীবন যাপন পদ্ধতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফল যা দাঁড়িয়েছে তা হলো-
১. কোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি নতজানু হয়েছি আমরা। সে ঔপনিবেশকারী ইংরেজদের হোক আর পাশের দেশ ভারতের হোক। অন্য সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাতেই নিমজ্জিত হওয়াটা কুলক্ষণ।
২. স্কুল-কলেজ থেকে দেশপ্রেমের শিক্ষা বিতাড়ন করা হয়েছে। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের রেসের ঘোড়া হিসেবে তৈরি করার বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। যারা পড়াচ্ছেন, তারা পড়াশোনা এর মূল উদ্দেশ্য যাচ্ছেন ভুলে। রস কষহীনভাবে প্রতিদিনের পড়া তৈরি করে দিলে একজন শিক্ষার্থী কী শিখবে?
৩. নীতিবাক্যগুলো টিকে আছে ঠিকই, কিন্তু অনৈতিক কাজ কারবারের অনুমোদন পরিবারের ভেতর থেকেই হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে বড়লোক হলেও পরিবারের লোকজন তা সমর্থন করছেন। ব্যাংক ঋণ নিয়ে তফসিল, পুনঃতফসিলের ব্যাপারগুলোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন, কিংবা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন এই ধরনের দস্যুতাও কোনো না কোনোভাবে পায়ের নিচে মাটি পেয়েছে।
৪. শুধু পরিবার নয়, আশপাশের মানুষেরাও এই মানুষটিকে ঘৃণ্য না ভেবে তাকে তোষামোদ করে চলেছে।
৫. এরই পরবর্তী ফলাফল, যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে দিয়ে এমন অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠান শীর্ষবিন্দুতে বসানো হচ্ছে, যিনি যেকোনো অনৈতিক কাজে সমর্থন দেবেন।
৬. এরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ধর্ম হয়ে যাচ্ছে ফ্যাশনের অঙ্গ। ব্যক্তিগত ধর্মপালন হয়ে যাচ্ছে লোক দেখানো ফ্যাশন। ধর্মের গভীর মর্মবাণী উপলব্ধি না করে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার জন্ম হচ্ছে মনে। এই অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা সমাজ থেকে উঠে আসছে না।
কেন উঠে আসছে না, তারও তো রয়েছে একটি বড় কারণ। সচেতন যে বাঙালি একসময় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তাদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এবং মিতালি পাতিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কৌশলী মানুষের সঙ্গে। ভুলে গেলে চলবে না, অস্ত্রহাতে যে কৃষক-শ্রমিক যুদ্ধ করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল যে যার কাজে। কিন্তু যারা অস্ত্র জমা দেয়নি, হাইজ্যাক লুটতরাজ ইত্যাদি করে পয়সার মালিক হয়েছে, তারা নৈতিকভাবে চেতনা থেকে সরে যাওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হতে পারেনি বাংলাদেশ।
এই অজ্ঞতা ও ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া আরও যেসব কারণে ঘটেছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল কাটাচ্ছে। এখনই কিছু ব্যাপারে বোধোদয় হওয়া দরকার। যার প্রথমটাই হচ্ছে, পরিবারের মধ্যে দেশপ্রেম জাগানো, শিক্ষালয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। চারপাশের মানুষ যদি শুধু হতাশার কথাই বলতে থাকে, এমনকি বলতে থাকে, পাকিস্তান আমলে ভালো ছিলাম, তাহলে বুঝতে হবে দেশের মস্তিষ্কে বড় অসুখ হয়েছে। শুরুতে যে পাঠাগারের কথা বলা হলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হওয়ার এটাই বড় কারণ। বইপড়ার মাধ্যমে বদলে যেতে পারে মনের মানচিত্র। যতটা পিছিয়ে এসেছি আমরা, ততটা এগিয়ে গিয়ে তারপর নতুন পথ সৃষ্টি করার জন্য বইয়ের ওপর নির্ভর করা যায়। তবে সেটাও নির্ভর করছে কোন বইগুলো পড়া হচ্ছে সেই বিসমিল্লাহ সেলুনে, তার ওপর। গল্প-উপন্যাস তো থাকবেই, পরোক্ষভাবে মনের গঠন তৈরি করে দেয় এরকম বই। সঙ্গে থাকতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ এবং ইতিহাসভিত্তিক বই। খাদের কিনারায় দাঁড়ানো একটি প্রজন্মের জন্য এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।
সেই আশা বুকে থাকলে জীবনটা আনন্দময় হয়ে ওঠে। কিন্তু সে পথের দিশা পেতে হলে ত্যাগ, পরিশ্রম এবং চর্চার বিকল্প নেই।
সেই পরিবর্তনটা আসছে, এরকম ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু সত্যিই কি আসছে, সে কথা ভেবে দুশ্চিন্তাও তো পাশাপাশি বাসা বাঁধে মনে।
লেখক: গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখj