বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রিকশাচালককে অসম্মান করলে কার মর্যাদা বাড়ে?

  • রবিউল আলম খান   
  • ২৭ এপ্রিল, ২০২১ ১৩:২৯

লঘু দোষে গুরুদণ্ড পাচ্ছেন রিকশাচালকেরা। ট্রাফিক আইনের এ নির্বিচার প্রয়োগ সমাজের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র পেশার মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করছে। রিকশাচালকের তো আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ নেই। সহায়সম্বলহীন রিকশাচালকদের রিকশা জব্দ ও জরিমানা কোনো কাজের কথা হতে পারে!

রাজধানীর বিভিন্ন অংশ থেকে ট্রাফিক পুলিশ রিকশা জব্দ করছে। করছে জরিমানা। একেকটি রিকশার জরিমানা এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। জরিমানা পরিশোধ করে ডাম্পিংগ্রাউন্ড থেকে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে হয়। একজন রিকশাচালকের দৈনিক আয় আমাদের অজানা নয়। এ জরিমানার টাকা রিকশাচালককে পরিশোধ করতে হয়। অফিসে যাওয়ার পথে শ্যামলী ওভারব্রিজের নিচের পয়েন্টে মূলসড়কে ওঠার অভিযোগে ট্রাফিক পুলিশ যেসব রিকশা জব্দ করে তা পর্যবেক্ষণ করছি প্রায় এক বছর।

কিছুদিন আগে এক ভুক্তভোগী রিকশাচালক জানালেন, রিকশাগুলো নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের কাছাকাছি ডাম্পিংগ্রাউন্ডে। জরিমানা পরিশোধ করে সেখান থেকে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে হয়।

রিকশা জব্দ করার পর যখন তা পিকআপে তোলা হয় তখন রিকশাচালকেরা পিকআপে উঠে পড়েন। নিজের রিকশার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। দুরন্ত গতিতে চলা পিকআপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সহজ কথা নয়। তারা থরথর করে কাঁপতে থাকেন। সব রিকশাচালক যে অল্পবয়স্ক বা মাঝবয়সী এমন নয়, অনেকে আছেন বয়স্ক।

একদিনের এক ঘটনায় মুষড়ে পড়লাম। একজন বয়স্ক রিকশাচালক বারবার ট্রাফিক পুলিশ অফিসারের পা ধরার চেষ্টা করছেন। রিকশাচালক মিনতির স্বরে বলছেন, আর কোনো দিন আসব না। তার আকুতি দেখে একজন ভদ্রলোক পুলিশকে অনুরোধ করলেন, রিকশাটি ছেড়ে দেয়া যায় কি না? পুলিশের সরাসরি জবাব, সম্ভব না। এরপর আমি গেলাম, বললাম, দেখুন উনি বয়স্ক মানুষ আপনার পা ধরছেন, সকাল বেলা সবাই নিজ নিজ কাজে যাচ্ছেন। এ দৃশ্যটা খুব ভালো দেখাচ্ছে না। কর্তাব্যক্তি বললেন, সম্ভব না, তা হলো যতগুলো রিকশা ধরেছি সব ছেড়ে দিতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের যাত্রীরা ঘটনাটি দেখছিলেন, সিগন্যাল ছেড়ে দিলে চলন্ত বাসের একজন যাত্রী আমাকে উদ্দেশ করে বললেন- ওদের কিছু বলতে যাবেন না, সরকারি কাজে বাধাদান মামলা খাবেন।

এ সমস্যার সমাধান খুব সহজ। মোড়ের ওপর একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড় করিয়ে রিকশাগুলো মূল সড়কে উঠতে নিষেধ করলেই হয়। এতে কারও পেট বা মর্যাদায় হাত পড়ে না।

লঘু দোষে গুরুদণ্ড পাচ্ছেন রিকশাচালকেরা। ট্রাফিক আইনের এ নির্বিচার প্রয়োগ সমাজের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র পেশার মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করছে। রিকশাচালকের তো আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ নেই। সহায়সম্বলহীন রিকশাচালকদের রিকশা জব্দ ও জরিমানা কোনো কাজের কথা হতে পারে!

সিটি করপোরেশন হলো রিকশার নিবন্ধন প্রদানের বৈধ সংস্থা। রাজধানীতে নিবন্ধিত রিকশার তুলনায় বহুগুণ অনিবন্ধিত রিকশা চলাচল করছে। ২০১৬ সালে এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা রিকশা পরিবহন কল্যাণ সমিতি’ বৃহত্তর ঢাকা রিকশা/ভ্যান পরিবহন কল্যাণ সমিতি’ ‘ঢাকা বিভাগ রিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতি’, ‘বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন’, ‘রিকশা ও ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগ’, ‘মহানগর রিকশা মালিক লীগ’, ‘মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন নামে রিকশার পেছনে ক্রমিক নম্বরসংবলিত নম্বরপ্লেট দেখা যায়।

এসব ক্রমিক নম্বরের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের দেয়া নিবন্ধনের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব নম্বরপ্লেট বসিয়ে একধরনের ব্যবসা করছে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক ২০১৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য রিকশার মোট নিবন্ধন নবায়ন ফি ছিল ৬০০ টাকা। অথচ ‘মুক্তিযোদ্ধা রিকশা পরিবহন কল্যাণ সমিতি’ নিবন্ধন নিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন এমন একজন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ সমিতির আওতায় নিবন্ধন নিতে তার রিকশার মালিককে ত্রিশ হাজার টাকা এককালীন এবং প্রতি ছয় মাস পর পর ৩০০ টাকা ফি জমা দিতে হয়। ‘বৃহত্তর ঢাকা মহানগর রিকশা/ভ্যান পরিবহন কল্যাণ সমিতি’ নম্বরপ্লেট লাগানো একজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার রিকশার নিবন্ধন নিতে মালিককে এককালীন জমা দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা এবং প্রতি মাসে ফি দিতে হয় তিন শ ঢাকা।

ঢাকা শহরে রিকশার রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিধি শ শ কোটি টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে ত্রিপক্ষীয় জোট। রিকশার মালিক, বিভিন্ন সমিতি যারা মূলত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলে ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। রিকশাকেন্দ্রিক এ বৃহৎ নেক্সাসে এক পক্ষের রয়েছে লগ্নি, অন্য পক্ষের রাজনৈতিক পরিচয় এবং শেষ পক্ষের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা। কিন্তু টাকা বানানোর মূল মেশিন রিকশাচালকের শরীরের ঝরানো ঘাম। বাস্তবতা হলো রিকশাচালক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এখান থেকে সামান্যই সুবিধা নিতে পারে। দিন শেষে মহানগর থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা ও হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে।

মহানগরে রিকশার অপরিহার্যতা যখন মেনে নেয়া হচ্ছে তখন রিকশাচালকদের প্রতি কী আচরণ হবে তা স্থির করা জরুরি। কারণ, এখান থেকে তো সংশ্লিষ্টদের কারও কম লাভ হচ্ছে না। ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতনার অভাব বা আইন না মানা বা ‘ফাঁক’ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রিকশাচালকদের ওপর নিপীড়নের অজুহাত হতে পারে না। কারণ, এমন ‘ফাঁক’ অনেকেই খোঁজেন। রিকশা চালানোর সামান্য দক্ষতা ও জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে মফস্বল থেকে একজন রিকশাচালক এ মহানগরে প্রবেশ করে। অন্য রিকশাচালকদের অনুসরণ করে সে পথ চলে। সিংহভাগ নগরবাসী রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে শিষ্টাচার, বিধি বা আইন তোয়াক্কা করে না। সে ক্ষেত্রে কেবল রিকশাচালকদের ওপর দোষ চাপানো অনায্য।

ট্রাফিক আইন না মানার অভিযোগে রিকশা জব্দ বা রিকশাচালকদের হেনেস্তা গা সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিকশা জব্দ করার পর ট্রাফিক পুলিশ প্রথমে তা উলটিয়ে দেয়। একেই বলে বিমানবিকীকরণ। রিকশা উলটে দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ বুঝিয়ে দিতে চায় এ পেশা কত নীচু, কত মর্যাদাহানিকর, কত ফালতু। চাইলেই রিকশা উলটে দেয়া যায়, পেশা উলটে দেয়া যায়। রিকশা ওলটানোর পর নিজের রিকশার প্রতি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি অসংখ্যা রিকশাচালককে। রিকশা ওলটানোর আগপর্যন্ত রিকশাচালক ট্রাফিক পুলিশের হাতপা ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন রিকশাটি উলটে দেয়া হয় তখন সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। দুয়েকজন রিকশাচালককে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখেছি। মোবাইল ফোন ক্ষমতা ও সম্পর্ক নির্ণয়ের নিয়ামক হলেও গ্রাম থেকে আসা এক রিকশাচালকের দৌড় কতদূর হবে তা তো অজানা নয়। চূড়ান্ত বিচারে সে কাউকে পায় না। একাই যুদ্ধ করে রিকশাটি উদ্ধার করতে হয়।

রিকশা উলটে দেয়া একজন রিকশাচালকের কাছে পরিচয়হীনতার শামিল। নিঃসঙ্গ এ শহরে একজন রিকশাচালকের কাছে রিকশাটি তার সংসার। তিন চাকার এ পরিবহনের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে এক মিথোজীবিক সম্পর্ক। এর ভেতর সংসারের পূর্ণ ছবি দেখে। দেখে স্ত্রী ও সন্তানের মুখ। কারণ, এ রিকশা তার দিনবদলের অবলম্বন।

একই সঙ্গে, রিকশা তার সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমও বটে। সংস্কৃতিচর্চায় কেন্দ্র ও প্রান্ত সম্পর্কে বলতে গিয়ে যেমনটি আহমদ ছফা বলেছিলেন, মানুষ যেখানে জন্ম নেয়, যা কর্ষণ করে তাই তার সংস্কৃতি, এখানে কেন্দ্র বা প্রান্ত বলে কিছু নেই। উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন-একজন তেলি যখন সকালে বাহুকে করে তেল বিক্রি করতে বের হয় তখন সে বাহুকের অগ্রভাগে একটু তেল দিয়ে চকচক করে নেয়। অতঃপর এক থাবা তেল মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এটাই তার সংস্কৃতি।

একজন রিকশারচালকের কাছে রিকশা তার সংস্কৃতির আধার। কত বিন্যাসে সে রিকশাকে সাজায়। রিকশার প্রতি যে নির্মমতা শেষাবধি তা বিঁধে তার শরীর ও মনে।

অন্যের পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা আজ জাতীয় রোগে পরিণত হয়েছে। কর্তৃত্ব রয়েছে বলেই আমরা অন্যকে অস্বীকার করতে চাই। শ্রমনির্ভর রিকশা চালানোকে ছোট কাজ ভাবি। গোটা মহানগরের শিক্ষিত চাকুরে এককেজি ধান উৎপাদন না করেও কেবল কলমপিষে আর কম্পিউটারের কালি ও সাদা কাগজ খরচ করে নিজ নিজ পেশাকে মহৎ করে তুলছে। আর রিকশা চালানোর মতো কাজকে ভাবছে নগণ্য। রিকশা চালানো মোটেও সহজ কাজ নয়। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার লিপিস্টিক কবিতায় পাঁচ টাকা দিয়ে বউ পালিশ কেনায় রিকশা চালকের তিব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে-

‘...একটা টাকা কামাই করতে গিয়ে

আমার গুয়া দিয়া দম আয়ে আর যায়।

আর তুই পাঁচ ট্যাকা দিয়ে

ঠোঁট পালিশ কিনছস কারে ভুলাইতে?...’

কবি রিকশাচালকের শ্রমের মূল্য বুঝেছেন। ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ সেই মূল্য বুঝতে চায় না। সাধারণ জনগণ ও ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। হয়তো নিজেরা সম্মানিত হয় না বলেই অন্যদের সম্মান করতে চায় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল, যা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণকে প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে উল্লেখ হয়েছে। রিকশাচালক তো আর জনগণের বাইরে নয়। তাহলে মালিকদের প্রতি জনগণের সেবকদের এ ব্যবহার কেন?

সমাজের সবক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট আকারে ধারণ করেছে- এমনকি আইনের প্রয়োগ বা নাগরিক অধিকারের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ তার গ্রেট ডিভাইড বইয়ে উল্লেখ করছেন- বৈষম্য অনিবার্য নয় (ইন-ইকুইলিটি ইজ নট ইনহ্যাটেবল)। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রতিভাত হচ্ছে অনিবার্যভাবে। একই বইয়ে জোসেফ স্টিগলিজের আরেকটি কথা ভাবিয়ে তোলে, তিনি বলছেন- ন্যায়বিচার সবার জন্য, এটি যেমন সত্য, তেমন সত্য, এটি পাওয়ার সামর্থ্য যারা রাখেন তারাই কেবল ন্যায়বিচার পেতে পারেন। এখন ভাবার সময় এসেছে বিদ্যমান বাস্তবতায় একজন রিকশাচালক কতটুকু ন্যায়বিচার পেতে পারেন, যেখানে ক্ষমতার বিকারে সমাজ ভারাক্রান্ত।

রিকশাচালকের আরেকটি পরিচয় তারা গরিব। বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ তার ‘গরীবের সৌন্দর্য’ শীর্ষক কবিতায় বলেছেন-

‘‘...জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।

শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।’’

একজন রিকশাচালকও পাক সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সুফল।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর