বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে একটি জাতিরাষ্ট্র রয়েছে যা একক কোনো ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি, আর সেই দেশটি হলো লাল-সবুজের শ্যামল প্রকৃতির সোনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা সরল মনের রাজনীতিবিদ। তার রাজনীতির প্রধান শর্তই ছিল সততা। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন মানবদরদি। মানবতা যার প্রধান ধর্ম সে আর যা-ই হোক স্বার্থন্বেষী হতে পারেন না। তাই বঙ্গবন্ধু একটি ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত হওয়া প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশকে শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য জীবন ও যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন।
শুধু বাংলার নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজ ভূলুন্ঠিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িতকার করাল গ্রাসে, যা কখনও কেউ কল্পনা করতে পারেনি! একশ্রেণির লোক যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষের ধর্মাবেগকে কাজে লাগিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সদা ব্যতিব্যস্ত। উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে যেসব রাজনীতিক তাদের দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছেন। ভারতীয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিক যশোবন্ত সিংহ তার ‘জিন্নাহ ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা’ বইটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। কীভাবে উপমাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এসব রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে ফিরেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প হতে বের হতে পারেননি।
অথচ স্বাধীন বাংলার অপর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোনো পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও ছিলেন একজন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহক। তিনি প্রায় বক্তব্য বিবৃতিতে বলতেন এই বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান যেন পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমে বসবাস করতে পারে। কতটা উদার মানসিকতার হলে একটা মানুষ এমন কথা বলতে পারে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সব ধর্মের লোক সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারে তার জন্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু কতটা প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তার ছোট্ট একটি উদাহরণ হলো, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সমুদ্র আইন প্রণয়ন করেন, আর বৈশ্বিক জাতিপুঞ্জের সংগঠন জাতিসংঘ ১৯৮২ সালে সেই সমুদ্র আইন প্রণয়ন করেন। কতটা নির্মোহ চিন্তাশক্তির অধিকারী হলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক আর ধর্মীয় ভাবাবেগে সাচ্চা মুসলমান। তিনি সদ্য স্বাধীন দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররমের মতো অসংখ্য ইসলামিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন।
দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুকে শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয় ,বহির্বিশ্বের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে। একদিকে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে তোলা ও অভ্যন্তরীণ বিবাদ (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ফেরত আনা) সামাল দেওয়া, অপরদিকে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাসহ দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানসহ তাদের বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের অপপ্রচার প্রতিহত করা। সেসময় বিশ্বে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করত।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার পরে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করা হয়। তবে,বাংলাদেশ Basket Case নয় । কারণ গত ২০০ বছর বাংলাদেশের সম্পদ লন্ডন, ডান্ডি, ম্যানচেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদে পাচার করা হয়েছে। আজ সেই Basket Case দেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্নতার কারণে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা যে কত অগ্রগামী তা দেশের উন্নয়ন দ্বারা সহজে অনুমেয়। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার জন্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। আসলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বিষয়ট সাধারণের সহজে বোঝার কথা নয়। এটা অর্থনীতিবিদরা বিশদ এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন। তারপরও আমরা যতটুকু বুঝি একটা দেশে কর্মক্ষম মানুষের (১৫-৬৪) সংখ্যা যদি কর্মক্ষম নন (১৪ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ) এমন মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেটা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটা স্থায়ী হয় ২০-৩০ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার ভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১-এর উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
যার প্রেক্ষিতে সরকার পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প, চট্টগ্রামের জাম্বুরা পার্ক, ঢাকার দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল, বিনোদন কেন্দ্র, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ইত্যাদি বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছে। এছাড়া-মেট্টোরোল,কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। দেশের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে কটি স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় মন্দচর্চা করেছে এবং করছে। ফতোয়া দিয়ে দেশের সরল জনগোষ্ঠীকে উস্কে দিয়ে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তারা কখনও ভাস্কর্য আবার কখনও কোনো বন্ধু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সফরে এলে বিভিন্ন অজুহাতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি তাদের ভাস্কর্য নিয়ে যে ব্যাখ্যা তা সত্যিই আদিম যুগের কল্পনাপ্রসূত বিষয়ের মতো। ভাস্কর্য বা মূর্তি যা-ই বলা হোক না কেন, এদের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে, যা তারা বুঝেও বুঝতে চায় না। কোনো অবয়ব বা ভাস্কর্যের আরাধনা করা আর কোনো ভাস্কর্য বা অবয়বের সম্মান কিংবা স্মৃতি ধরে রাখা এক বিষয় নয়। দেশে জাতির পিতার ভাস্কর্য নিয়ে তারা তুমুল আন্দোলন করে। আসলে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণ হলো সম্মান ও স্মৃতি, অন্য কিছু নয়। কিন্তু তারা সেটা বুঝতে নারাজ। ইসলামের পুণ্যময় ভূমি সৌদি আরবে মানব চোখ, উট ও মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে সেটা সবারই জানার কথা। এছাড়া-তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক পাশা, ইরানে ইবনে সিনা, কবি ফেরদৌসী ও ইমাম খোমেনি, পকিস্তানে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও বেনজীর ভুট্টো, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনহ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে সে দেশের জাতীয় বীর ও নেতাদের ভাস্কর্য রয়েছে। আসলে উদ্দেশ্য ভাস্কর্য বা কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সফরে আসা নয়, কীভাবে উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে জঙ্গি ও ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানে রূপান্তরিত করা যায় তার অপপ্রয়াস। তাই তারা ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য মৌলবাদ সমর্থন করছে। এখনই সময় এসব সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমূলে বিনষ্ট করা, নইলে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়বে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা।