বলা হয়ে থাকে, কোনো মানুষ সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে হলে তার সফরসঙ্গী হতে হয়। আমরা ঢাকার একদল সাংবাদিক ইউরোপে সৈয়দ ইয়ামিন বখতের সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। এই মানুষটি সম্পর্কে সেই যে ভালো ধারণা হলো তা আজও আছে, থাকবে যত দিন বেঁচে থাকব।
ইয়ামিন ভাইয়ের বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। করোনায় তাকে কেড়ে নিয়েছে আজ শনিবার। বলা যায়, এটা অকালমৃত্যু। মৃত্যুর খবর শোনার পর মনে পড়ছে ওনার নেতৃত্বে সেই গুরুত্বপূর্ণ সফরের কথা। গুরুত্বপূর্ণ সেই অর্থে যে, বাংলাদেশের একদল সাংবাদিক নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান কভার করার সুযোগ পেয়েছিল।
সৈয়দ ইয়ামিন বখত তখন গ্রামীণফোনের কমিউনিকেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান কভার করতে আমাদের নেয়া হয়েছিল নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। ৯ ডিসেম্বর ছিল নরওয়েজিয়ান নোবেল একাডেমির সংবাদ সম্মেলন, ১০ ডিসেম্বর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। এই সফরে তিনি ছিলেন আমাদের দলনেতা।
ওই দুটি অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে যোগ দেয়া সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন শাইখ সিরাজ, সদ্য প্রয়াত শাহীন রেজা নূর, নাসির আলী মামুন, ইনাম আহমেদ, আবু সাঈদ খান, জ. ই মামুন, সুপন রায়, আমীরুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম রতন, জাহেদ চৌধুরী, মাহমুদ হাসান, সাইফুল হাসান প্রমুখ। ইয়ামিন ভাই ছাড়াও গ্রামীণফোন থেকে এই দলে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের কমিউনিকেশন বিভাগের ম্যানেজার মঈন তারেক।
নরওয়ে সাগরের গা ঘেঁষে অবস্থিত অসলো সিটি হলে নোবেল পুরস্কার বিতরণ করা হয়। রাজকীয় ওই অনুষ্ঠানে নোবেল শান্তি পুরস্কার তুলে দেয়া হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। হলিউড তারকা অ্যাঞ্জেলিকা হিডস্টন ও শ্যারন স্টোন, ‘এ গার্ল লাইক মি’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়াজাগানো অ্যালবামের স্রষ্টা রিহানা, লায়োনেল রিচি, পাওলিনা রুবিও, হাকিম, মর্টেন আবেল, ওয়াইনোন্নাসহ বিশ্ববিখ্যাত তারকারা ওই অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলেছিলেন কথা ও সুরের মূর্ছনায়।
নরওয়ে থেকে আমাদের গন্তব্য সুইডেনে। স্টকহোমে অবস্থিত এরিকসন ভবনে আমাদের নেয়া হয়। সেখানে একদিন অবস্থান করার পর ১২ ডিসেম্বর ২০০৬ আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দেশে ফেরার আগের রাতে ঝামেলায় পড়লাম আমরা। সফরসঙ্গীদের একজনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। ইয়ামিন ভাই তখন অস্থির। আমাকে খুঁজতে শুরু করলেন। আসলে আমরা যে যার মতো ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। স্টকহোম আমার একটু বেশি চেনা। কারণ, ২০০৪ সালে স্টকহোম ইউনিভার্সিটি থেকে সিডার স্কলারশিপে ডিপ্লোমা করেছি। ওই সময়ে সুইডেনসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো ঘুরে দেখেছি।
হোটেলে ফেরামাত্র ইয়ামিন ভাই রুমে ছুটে এলেন। বললেন, ‘পিন্টু, ঝামেলা হয়ে গেছে। অমুককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কী করা যায়, দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে। এখানে বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’
সুইডেন সম্পর্কে আমার মোটামুটি ধারণা থাকার কথা ইয়ামিন ভাই আগেই জানতেন। এর আগে কয়েক দিন ধরে তার সঙ্গে গল্পগুজব কম হয়নি। তিনি বেশ সুন্দরভাবে সিগারেট টানতেন।
ইয়ামিন ভাই অস্থির হয়ে পড়লেন। পরদিন ভোরে একই ফ্লাইটে আমাদের স্টকহোম থেকে ঢাকায় ফেরার কথা। ইয়ামিন ভাই আমাকে বললেন, ‘পিন্টু একটা অনুরোধ করব। রাখবেন?’ বললাম, অবশ্যই। ‘আপনাকে স্টকহোমে থেকে যেতে হবে। আপনি গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিককে ছাড়িয়ে নিয়ে ঢাকায় ফিরবেন।’ এমনভাবে ইয়ামিন ভাই বললেন যে, না করতে পারিনি। বললাম, আমার সঙ্গে আরেকজনকে রেখে যান।
তখন সাইফুল আমার সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন, তিনি তখন চ্যানেল ওয়ানের রিপোর্টার, আমি প্রথম আলোর। আমাদের বয়সও কাছাকাছি। আমি ও সাইফুল টিকিট পরিবর্তন করতে বের হলাম। এরপর গেলাম স্টকহোমে বসবাসরত বাঙালি দেলোয়ার হোসেনের পরামর্শ নিতে। তিনি সুইডেনের রেল বিভাগে চাকরি করতেন, আর বাংলাদেশ থেকে প্রজন্ম একাত্তর নামে একটি মাসিক পত্রিকা ছেপে তা সুইডেনে নিয়ে বাঙালি গ্রাহকদের কাছে পাঠাতেন। আমিও প্রজন্ম একাত্তরের কয়েকটি সংখ্যা ঢাকা থেকে বের করে দিয়েছিলাম, প্রতি মাসে একটি সংখ্যা বের হতো। তা ছাড়া দেলোয়ার ভাই জনকণ্ঠের সুইডেন প্রতিনিধি ছিলেন।
প্লেনের টিকিট পাল্টাতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়লাম। ঢাকার এই সাংবাদিক কবে ছাড়া পাবেন, তা জানি না। সুইডেনের আইনকানুন সম্পর্কেও তেমন ধারণা নেই। সাইফুল আর আমি পরামর্শ করে তিন দিন পর টিকিট বুকিং দিলাম। এরপর ফোনে দেলোয়ার ভাইয়ের অবস্থান জানতে চাইলাম। একটি রেলস্টেশনে কর্মস্থলে গিয়ে দেখা করলাম দেলোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। সব খুলে বললাম। উনি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেন। দূতাবাসের পক্ষ থেকে সুইডিশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো।
হোটেলে ফিরলাম, সবার মন খারাপ। প্রায় এক সপ্তাহ একসঙ্গে কাটিয়েছি ইয়ামিন ভাইয়ের নেতৃত্বে। সবাই চলে যাবে। একজন জেলে আছে, তাকে ছাড়িয়ে দেশে নিতে আমাদের দুজনকে থাকতে হবে।
আমরা একই হোটেলে থাকতে চাইলাম। কিন্তু দেলোয়ার ভাই নাছোড়বান্দা। তার বাসায় থাকতে হবে। বললাম, আমরা তো দুজন, হোটেলেই থাকি। তিনি বললেন, তার বাসায় থাকতে হবে।
পরদিন হোটেল ছেড়ে দেলোয়ার ভাইয়ের বাসায় উঠলাম। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে থাকি। বিকেল নাগাদ দেলোয়ার ভাইয়ের কাছে খবর এলো, ওই সাংবাদিক মুক্তি পেয়েছেন। আমরা কোথায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম তা এখন আর মনে পড়ছে না। তবে তাকে সঙ্গে নিয়ে পরদিনের টিকিট নিশ্চিত করলাম। বললাম, তাকে ঢাকায় চলে আসতে।
এদিকে সাইফুলের মাথায় চাপল আশপাশের কোনো একটি দেশ ঘুরতে যাবে। আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী লিংকন মোল্লার সঙ্গে। তাকে ফোনে বললাম, পরদিন কোপেনহেগেন আসছি। একটা হোটেলে রুম বুকিং দিতে অনুরোধ করলাম। লিংকন ভাই বললেন, আগে আসেন। তারপর রুম পাওয়া যাবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। কোপেনহেগেনে সেদিন ব্যাপক সহিংস ঘটনা। কোনোমতে লিংকন ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম। এটা কয়েক দিন ধরে চলতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। লিঙ্কন ভাইয়ের বাসায় খাওয়াদাওয়া করে রাতেই রওনা হলাম স্টকহোমে, পরে সেখান থেকে ঢাকায়।
১০ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান কভার করতে যাওয়া সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সৈয়দ ইয়ামিন বখত। ছবি: সংগৃহীত।
ইয়ামিন ভাই স্টকহোমে আমাদের দুজনকে রেখে আসার সময় তিন হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে এসেছিলেন। কোথাও কোনো খরচ হলে যাতে অসুবিধা না হয় সে জন্য। ঢাকায় ফিরে ডলারগুলো তাকে ফেরত দিতে গ্রামীণফোন কার্যালয়ে যাই। পুরো তিন হাজার ডলার ফেরত দেয়ায় তিনি একটু বিস্মিত হলেন। তাকে বললাম, আসলে আমাদের তেমন কোনো খরচ হয়নি। স্টকহোমে দেলোয়ার ভাই এবং ডেনমার্কে মোহাম্মদ আলী ভাই আপ্যায়ন করেছেন। স্টকহোমে থেকেছি দেলোয়ার ভাইয়ের বাসায়। আর স্টকহোম থেকে ডেনমার্ক গেছি নিজেদের খরচে।
ইয়ামিন ভাই খুশি হলেন। বললেন, করপোরেট হাউসে এই তিন হাজার ডলার কীভাবে খরচ দেখাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম। এর তো কোনো রসিদও দেয়া যেত না।
মনে পড়ছে ইয়ামিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় জনকণ্ঠে আমার সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী রেজোয়ানুল হকের মাধ্যমে (এখন মাছরাঙা টেলিভিশন)।
একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এসে জানালেন গ্রামীণফোন কল সেন্টারের জন্য শ শ ছেলেমেয়েকে খণ্ডকালীন চাকরি দিচ্ছে। গ্রামীণফোনে আমার কেউ পরিচিত আছে কি না? আমি জানতাম, ইয়ামিন ভাইয়ের সঙ্গে রাজা ভাইয়ের সুসম্পর্কের কথা। রাজা ভাইকে বিষয়টি বললাম। তিনি ছাত্রটির বিষয়ে বললেন ইয়ামিন ভাইকে। তিনি আমাকে যেতে বললেন। দেখা করলাম ইয়ামিন ভাইয়ের সঙ্গে। এরপর ছাত্রটির খণ্ডকালীন চাকরি হয়ে গেল।
ইয়ামিন ভাই আসলে ছিলেন সাংবাদিক। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাকে চিনবেন না। তিনি দ্য ডেইলি স্টারের সাবেক বার্তা সম্পাদক ছিলেন, পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। সেখান থেকে গ্রামীণফোনে যোগ দেন এবং প্রতিষ্ঠানটির কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক হয়ে অবসরে যান। মাত্র কিছুদিন আগেও মঈন তারেকের কাছে খোঁজ নিলাম ইয়ামিন ভাই সম্পর্কে। অবসরে যাওয়ার পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বছর দুয়েক আগে কথা হয়। আজ শুনলাম আকস্মিক বিদায়ের কথা। যেন চোখের সামনে একজন ভালো মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
লেখক: সাংবাদিক।