বিলম্বে হলেও বিগত ১৮ এপ্রিল বহু নিন্দিত, আলোচিত ও সমালোচিত হেফাজতে ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। বিলম্বে হলেও এই গ্রেপ্তারের জন্য অভিনন্দন জানাই সরকারকে। একই সঙ্গে কামনা করি বাবুনগরীসহ হেফাজতে ইসলামের দোষী নেতা-কর্মী এবং জামায়াতে ইসলামীর সকল নেতা-কর্মীকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
অপরাধীদের দুর্বলতম সময়েই কঠোরতম আঘাত হানতে হয়। হেফাজত ও জামায়াত নেতা-কর্মীরা দীর্ঘকাল পর এখনই তাদের দুর্বলতম সময় অতিক্রম করছে। তাদের আস্ফালন বিগত আটটি বছর ধরে যেভাবে বাড়ছিল এবং কোনো অপকর্মেই ন্যূনতম বাধা পাচ্ছিল না, ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল। অবসান ঘটানো হোক সেই দুঃস্বপ্নের যুগের সকলকে গ্রেপ্তার ও শাস্তিদানের মাধ্যমে।
হেফাজতে ইসলাম নামটি অজানা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু ২০১৩ সালে অকস্মাৎ ঢাকায় বিশাল সমাবেশ ডেকে দেশে সংবিধান ও সংস্কৃতিবিরোধী ১৩ দফা দাবি তুলে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয় হেফাজত প্রথম বারের মতো। ওই ১৩ দফা দাবি না মানলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটাবে বলেও তারা ওই সমাবেশে ঘোষণা দেয়। সর্বশেষ ঘোষণা দেয় ঢাকা অবরোধ এবং বিপুল জমায়েত ঘটিয়ে ঢাকা নগরীর নানা সড়ক অবরুদ্ধ করে ফেলে। ফলে মানুষের চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। সরকারের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নিতে হয় মামলা।
আকস্মিকভাবে থমকে দাঁড়ায় মামলাগুলোর তদন্ত। হেফাজত তার স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সমঝতায় আসে। সরকারও অজানা কারণে গোপন সমঝোতা করে। ধীরে ধীরে আটক সকল হেফাজত কর্মীর মুক্তি প্রত্যক্ষ করা গেল।
স্বস্তি পেল হেফাজতে ইসলাম। আবদার বেড়ে যেতে থাকল তাদের। তারা চাইলো পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ। সরকার বলল তথাস্তু! অসাম্প্রদায়িক বিশ্বখ্যাতি-সম্পন্ন লেখকদের রচনাসমৃদ্ধ কোটি কোটি টাকার পাঠ্যপুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হলো। জনগণের টাকার অপচয় হলো। নতুন করে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সাম্প্রদায়িক লেখকদের লেখা নিয়ে পাঠ্যপুস্তক ছেপে তার কোটি কোটি কপি সারা দেশে যথারীতি বিলি করা হলো। ঘটলো শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ। শুরু হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে কোটি কোটি শিশুর মগজ ধোলাই।
বাড়তে লাগলো সমাজে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা। পিছু হটানো শুরু হলো বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃত ও অসাম্প্রদয়িক চেতনা, প্রসার ঘটতে থাকল সংবিধানবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতা। বাড়তে থাকল মাদ্রাসার সংখ্যা- পশ্চাৎগতি শুরু হলো বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা। উধাও ঘটলো এককেন্দ্রিক শিক্ষা প্রসারের ঘোষিত সরকারি নীতির।
বেজায় উৎফুল্ল হেফাজত। তারা দাবি করল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে জাস্টিসিয়া নামক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার। অযৌক্তিক এই দাবিটিও তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয়া হলো-অপসারিত হলো এ ভাস্কর্যটি।
আর থামে কে? এবারে দাবি মাদ্রাসাগুলোর, বিশেষত কিওমি মাদ্রাসাগুলোর, উচ্চতম ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রির সমতুল্য বলে ঘোষণা দিতে হবে। আল্লামা শফির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তা-ও মেনে নেয়া হলো বলে তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিলেন। উচ্চ শিক্ষার অবৈজ্ঞানিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো।
অতঃপর হেফাজত দিগবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো ঘোষণা দিল সরকার যদি মুজিব শতবর্ষ পালনে বঙ্গবন্ধুর বিশালাকার ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্প পরিত্যাগ না করে এবং যদি প্রকৃতই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করে তবে তা ভেঙে ফেলে দেয়া হবে। এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ হুমকিটি প্রকাশ্যে দিলেন হেফাজতে ইসলামের দ্বিতীয় শীর্ষনেতা মাওলানা মামুনুল হক। নানা মহল থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ উঠল কিন্তু সরকারি উচ্চমহল থাকল নিশ্চুপ। অতঃপর কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলল কিছু মাদ্রাসা ছাত্র। ধরা পড়ার পর পুলিশকে তারা জানাল মওলানা মামুনুল হকের ওয়াজ শুনে তারা ভেবেছিল ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী। তার ওই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা ভাস্কর্যটি ভেঙেছে।
কয়েকটি মাস চলে গেল। মামুনুলরা দিব্যি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে থাকল। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ওয়াজ করতে গিয়ে মামুনুল মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িকতায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেন। প্রশাসন নিশ্চুপ থাকল। একটি হিন্দু ছেলে ক্ষোভবশত মাওলানা মামুনুলের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে মুহূর্তে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
পরিস্থিতি উগ্র হতে দেখে গ্রামবাসী ছেলেটিকে পুলিশে হস্তান্তর করে। তবুও মাইকে প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়ে হাজার হাজার লোক জড়ো করে শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁ গ্রামের একশ’ নিরীহ নির্দোষ হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর ভাঙচুর করা, তাদের সোনাদানা টাকা পয়সা লুটপাট করে নিয়ে সবগুলো পরিবারকে চরম অসহায়ত্বের মুখে দাঁড় করায়। বিষয়গুলো আগে থেকেই প্রশাসনের জানা ছিল। তদুপরি আক্রমণ শুরু হওয়ামাত্র হিন্দুরা ফোন করে থানাকে জানালেও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে অজানা কারণে চুপ যাকে। ঘটনাটি ঘটে গেল প্রকাশ্য দিবালোকে।
মামুনুল উস্কানি দিলেন, থাকলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ওই হিন্দু ছেলেটি কারারুদ্ধ থাকল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
এমন একের পর এক ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে সরকার আইন প্রয়োগ না করায় হেফাজতিরা তাদের আস্ফালন তুঙ্গে তুলল। হুঙ্কার দিয়ে দাবি তুলল মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেয়া আমন্ত্রণপত্র বাতিল করা হোক- নইলে তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হবে না। সরকার কঠোর ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় সংবর্ধিত করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি ঢাকা আসেন দুদিনের জন্য। একদিন যোগ দেন সরকার আয়োজিত উৎসবে। পরদিন যান দুই জলার দুটি গ্রামে-মন্দিরে পূজা দিতে এবং একটি সম্প্রদায়ের সমাবেশে ভাষণ দিয়ে কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সেখানে বাসরত ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে তার দল বিজেপির পক্ষে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে রথ দেখা-কলা বেচা দুইটা সারলেন।
মোদি ঢাকায় অবস্থানকালেই ২৬ মার্চ হেফাজত ভয়াবহ তাণ্ডব চালাল, আবার ওই তাণ্ডবে পুলিশি বাড়াবাড়ির ফলে হেফাজতি বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ মারা গেছে- এমন গুজব ছড়িয়ে ঢাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে ভয়াবহ তাণ্ডব চালায় হেফাজতের অসংখ্য নেতা-কর্মী বাবুনগরী মামুনুলদের উস্কানিতে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ঢাকা-হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন, তার তাবৎ বাদ্যযন্ত্র, ঘরবাড়ি, অপরাপর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস, থানা, সরকারি নানা অফিস এবং রেল স্টেশনেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর কিছু মামলা মামুনুলসহ হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হতে থাকে ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলে।
এর মাঝেই তিনি স্বরূপ উদঘাটন নিজেই। মামুনুল অপরের স্ত্রীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের এক রিসোর্টে ঢুকলে এলাকাবাসী তা জানতে পেরে ঘেরাও করে। ঘটনাটি অকস্মাৎ ভাইরাল হয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে জনতার হাত থেকে মামুনুলকে উদ্ধার করে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার হেফাজতি বাহিনী এসে ওই রিসোর্টে ব্যাপক ভাঙচুর করে এবং মামুনুলকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মামুনুল এবার অবৈধ নারী সম্ভোগকারী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন। তার বৈধ প্রথম স্ত্রী ছাড়াও আরও দুই মহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।
এর পর সাম্প্রতিক জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই মামুনুল ও হেফাজতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন প্রথমবারের মতো। এর পরে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে তার বিরুদ্ধে ২৩টি মোকদ্দমার সবগুলোই তদন্ত করা হবে। এরপর মুখ রক্ষা করতে বাবুনগরী এক বিবৃতি দিয়ে হেফাজতের সকল কর্মীকে হত্যা, ভাঙচুর ও তাণ্ডব ঘটানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান, এবং আটককৃত হেফাজতের সকল নেতা ও কর্মীকে মুক্তিদানের আহ্বান জানান।
এবারে আর তর সইল না বিএনপির। তাড়াহুড়ো করে দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে আটক সকল আলেম-ওলেমা অর্থাৎ হেফাজত নেতাদের মুক্তির দাবি করেন।
ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানি না। কিন্তু যা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, এক সপ্তাহ হলো মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হলেও এ যাবৎ একমাত্র বাগেরহাটের একটি উপজেলা ছাড়া অন্য কোথাও হেফাজত প্রতিবাদ মিছিল সমাবেশ ঘটানোর সাহস পায়নি। তবুও হেফাজতের শক্তিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তীক্ষ্ন নজর রেখে সকল অপরাধীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে হেফাজতের সর্বোচ্চ নেতা এবং মামলার আসামি বাবুনগরীকেও গ্রেপ্তার করা এখন অত্যন্ত জরুরি।
সমগ্র দেশবাসী এ কাজে সরকারের সঙ্গে সহগোগিতা করতে প্রস্তুত। তা সত্ত্বেও তারা নানা মাহফিল, বিভিন্ন মসজিদে ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নিতে পারে। সেগুলোর প্রতি কড়া পুলিশি নজর রাখা প্রয়োজন।
বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম অর্জন। আর এই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় দৃঢ় থাকার কারণে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে, চার জাতীয় নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শঙ্কা-অনিশ্চয়তাও আছে সরকারের দৃঢ়তা নিয়ে, কারণ মামুনুল গ্রেপ্তারের পর দু’দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হেফাজত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। মন্ত্রী বললেন, কোনো বৈঠক হয়নি- হেফাজত নেতারা দেখা করতে এসেছিলেন। কেন? মুখ দেখতে? এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।