পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবাসিক ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লেগে মৃত্যু ঘটেছে মানুষের আর ধ্বংস হয়েছে সম্পদের। এ ঘটনা ঘটেছে চলতি মাসের ২২ তারিখে। সর্বশেষ নিহতের সংখ্যা চারজন বলে জানা গেছে, আহত অন্তত ১৭ জন।
‘আবাসিক ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন’ লাগার এই ঘটনা নতুন নয়, অথচ রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থাগুলো এত ধীর কেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। এর আগে ২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীর ঘটনা দেশবাসীকে কাঁদিয়েছে। নাড়িয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। তারপরেও ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্যোগ হিসেবে গণ্য হয়েছে, আশ্চর্য হলো সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও জনগণের সচেতনতার অভাব ভয়ংকর।
২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডির ঘটনা ছিল আতঙ্ক জাগানিয়া। এই অগ্নি-ট্র্যাজেডি ছিল আকস্মিক, কোনো ষড়যন্ত্রের ফল নয়; মানুষ সেখানে যেন নিয়তিতাড়িত; অগ্নিদহনে তার সংকট ও যাতনার শেষ ছিল না। সেদিন ওই অগ্নিকাণ্ডে সবমিলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১২৪। ওই দুর্ঘটনায় সম্পদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, এটা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। নিমতলীর ঘটনা স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিট ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর বার্ন ইনজুরিস দিনটিকে ‘অগ্নিসচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।
আরমানিটোলার ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হবে বলে আশা করছি। তবে, ২০১০ সালের ৩ জুন জনবসতির পাশে স্থাপিত একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হলে সেখান থেকে আশপাশের বাড়িগুলোতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের দোকানগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আগুন আরও বিস্তৃত হয়, দ্রুত গ্রাস করে সবকিছু। এছাড়া আক্রান্ত এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের ওই এলাকায় যেতে ও কাজ করতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, যা দ্রুত অগ্নিনির্বাপণ বাধাগ্রস্ত করে। এছাড়া পুরান ঢাকা এলাকার সংকীর্ণ অলি-গলি দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশ করাতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্নিকাণ্ডের যথাযথ কারণ উদঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি সেই সঙ্গে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি তার গভীর সমবেদনা জানান। তার সরকার ৫ জুন, ২০১০ সারা দেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। তবে ১২ বছর পরও নিমতলীর ট্র্যাজেডি পিছু ছাড়েনি হতভাগ্যদের। এখনও অনেক দগ্ধ, আহত মানুষের আর্তনাদ শোনা যায়। তবে নিমতলীর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আগুনে পোড়া মানুষের বাস্তবে সম্বল বলে কিছুই থাকে না। এজন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
নিমতলী ট্র্যাজেডিতে আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া তিন কন্যা উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনা, সাকিনা আক্তার রত্না ও আসমা আক্তার শান্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নিজের কন্যা পরিচয়ে তিনি নিজেই তাদের বিয়েও দেন। বর্তমানে নিয়মিত তাদের খোঁজ-খবরও রাখেন তিনি।
২০১৮ সালে রাজধানীর চাঁনখারপুলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ৫০০ শয্যার ‘জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’-এর উদ্বোধন হয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও অত্যাধুনিক এ বার্ন হাসপাতালটি উদ্বোধনের ফলে হাজার হাজার পোড়া রোগীর সুচিকিৎসার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আকাশছোঁয়া এ ভবনটি তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। একদিকে রয়েছে বার্ন ইউনিট, অন্যদিকে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট আর অন্য ব্লকটিতে করা হয়েছে অ্যাকাডেমিক ভবন। দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারি হাসপাতালে হেলিপ্যাড সুবিধাও রাখা হয়েছে।
নিমতলী ট্র্যাজেডির জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল; তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার মিল-অমিল উভয়ই রয়েছে।
১৭ দফার উল্লেখযোগ্য দিক হলো- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতিমাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়ানিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দপ্তরের পরিবর্তে সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা প্রভৃতি।
এর মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো বাড়ানো হলেও এখনও এই সেক্টরটি অত্যাধুনিকভাবে গড়ে ওঠেনি বলেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা জরুরি।
আরমানিটোলায় আবাসিক ভবনের রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার ঘটনাকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দায়কে নিজেদের দায়িত্ব মনে করে নিমতলী, চকবাজার, গার্মেন্টস কিংবা অন্য কোনো টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যেন না ঘটে সেজন্য জনগণের মধ্যে জোর সচেতনতামূলক প্রচার-অভিযান চালাতে হবে, পাশাপাশি সকল সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের (ওয়াসা এবং অন্যান্য) ভেতর সমন্বয় থাকতে হবে।
অপরদিকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও নিতে হবে কঠোর আইনি ব্যবস্থা- তা হলেই অগ্নিকাণ্ডের ট্র্যাজিক ঘটনাগুলো চিরতরে বন্ধ করা সম্ভব হবে।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কলাম লেখক।