বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাষ্ট্রীয় হেফাজত

  •    
  • ২৩ এপ্রিল, ২০২১ ১৯:৪৫

রাশিয়ার বিরোধী দলীয় তরুণ নেতা নাভালনি এখন রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বা জেলখানায় অনশন করছেন। নাভালনির এই অনশন ও তার জীবন সংশয় নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এশিয়া, আফ্রিকা এমনকি ওশেনিয়ান দেশগুলো সেভাবে দেখায়নি।

অনশনরত নাভালনির শারীরিক অবস্থা গত সপ্তাহে খুবই খারাপের দিকে চলে যায়। তার দুটো কিডনি অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে। তখন ডাক্তারের সূত্র ধরে খবর আসে, নাভালনি যে কোনো মুহূর্তে মারা যাবেন। এই খবর প্রকাশের পরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার বিবৃতিতে বলেন, মস্কো নাভালনিকে নিয়ে যা করছে, তা পুরোপুরি অন্যায়। যদি নাভালনি মারা যান, মস্কোকে তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে হবে। ফ্রান্স জোর প্রতিবাদ জানিয়ে নাভালিনকে জেল থেকে মুক্তি ও চিকিৎসার দাবি জানান এবং অবিলম্বে তার চিকিৎসকদের দেখা করার সুযোগ দেবার জন্যে বলেন।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাভালনির বিনাশর্তে মুক্তি দাবি করে। রাশিয়াতেও নাভলনি সমর্থকরা তার মুক্তির ও চিকিৎসার দাবিতে সব ধরনের বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে। এর ফলে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ পরে জানিয়েছেন, তাকে ভিটামিন থেরাপি দেয়া হচ্ছে।

একজন গণতান্ত্রিক নেতা যখন রাষ্ট্রীয় হেফাজতে এ ধরনের মৃত্যুর মুখোমুখি, সে সময় এশিয়াতে কিন্তু এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এশিয়ার বড় দেশ চীন। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে সেখানে মৃত্যু প্রতিদিনের ঘটনা। তাই তাদের কাছে নাভালনি যেমন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেন না, তেমনি তারা এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর নৈতিক জোরও পান না। এশিয়ার শুধু নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত। এ ধরনের ঘটনায় আগে ভারতে খুব বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া উঠত সিভিল সোসাইটি থেকে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জাগরণ হোক, আর দলীয় আনুগত্যের শিকার হোক, এখন ভারতের সিভিল সোসাইটি দুর্বল হয়ে গেছে।

অন্যদিকে তাদের দেশে কাশ্মীরসহ বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে অনেক মৃত্যু ঘটে, যা ক্রসফায়ার বলে পরে চিহ্নিত হয়। তারপরেও নাভালনির মতো একজন নেতার জীবন নিয়ে যখন সংশয় দেখা দেয়, তখন এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষ স্বাভাবিকই কোনো না কোনো সৎ প্রতিক্রিয়া আশা করে, যা অতীতে ভারতে ঘটেছে। এবার তারাও নিশ্চুপ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মূলত পুলিশি রাষ্ট্র। ওই সব দেশে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে ও রাষ্ট্র কর্তৃক মৃত্যু অত্যন্ত সাধারণ বিষয়। সে কারণে সেখানে নাভালনিকে নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়া স্বাভাবিক।

বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর যখন সারা বিশ্ব ভিয়েতনামের সংগ্রাম নিয়ে মুখ খুলতে ভীত ছিল, সে সময় দরিদ্র বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম ভিয়েতনামের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেন, যা তার নিহত হবার অন্যতম কারণও হয়ে দাঁড়ায়। আর বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু। পৃথিবীর সব থেকে কলঙ্কজনক রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু বা নিহত হবার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে ৩ নভেম্বর জেলখানায়। সেদিন রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে (যদিও আইনত তিনি অবৈধ তবু ক্ষমতা তার হাতে ছিল) খোন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া নেতা তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার নির্দেশ দেন। এবং পৃথিবীর সকল নিয়ম, মানবাধিকারের সকল কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার নির্দেশে সেনাসদস্যরা জেলখানায় ঢুকে হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে।

এরপর রাষ্ট্রীয় হেফাজতে অসংখ্য মুত্যু ঘটেছে জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসন আমলে বাংলাদেশে। জিয়ার আমলে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে সেনাসদস্যদের মৃত্যু এমনই নৈমিত্তিক বিষয় ছিল, যা নিয়ে প্রখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকা রিপোর্ট করেছিল প্রতিরাতে ক্যান্টমেন্টের পাশের জলাশয়ের ধারে গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। মূলত জিয়াউর রহমানের আমলে ২২টি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। আর এই সব অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বলে অনেক সেনাসদস্যকে গ্রেপ্তার করা হতো। এবং তাদের রাতে ক্যান্টমেন্টের পাশের জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে ফেলে দেয়া হতো। কোনো বিচার যেমন তাদের হতো না, তেমনি তাদের সম্পর্কে কোনো খবরও জনগণ জানতে পারত না।

সে সময়ে অবশ্য আমেরিকা এই সব মৃত্যু বা হত্যা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাত না। তখন তাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অন্তত বাংলাদেশের বিষয়ে ভোতা হয়ে গিয়েছিল। বরং তারা চাইতো যে কোনো প্রকারে হোক বাংলাদেশে একটি বর্বর শাসন টিকে থাকুক। সামরিক শাসনের অবসানের পরে রাষ্ট্রীয় হেফাজতের মৃত্যুর সব থেকে বড় প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে, থানায় পুলিশের অত্যাচারে রুবেল নামক এক তরুণের মৃত্যুতে। সত্যি অর্থে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় হেফাজতে কোনো মৃত্যু ঘটলে যা কর্তব্য তা সেদিন পুলিশ ও হত্যার সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে সেদিনের আওয়ামী লীগ সরকার দেখিয়েছিল। কিন্তু এই ধারার অবসান ঘটায় প্রথম লতিফুর রহমান ও সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আর তার ভয়াবহ রূপ দেখা যায় ওই দুই বিচারপতির সরকারের আনুকূল্যে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পরে। তারা সেদিন অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে ৫৪ জন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা করে। এদের একজনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাইকোর্টে একটি মামলাও হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র এতটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে সেই মামলা আর অগ্রসর হয়নি।

এর পরে ১/১১-এ সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। তাদের দ্বারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নির্যাতন নাভালনির নির্যাতনকেও ছাড়িয়ে যায়। আজ যেমন রাশিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে লাভালনিকে স্লো পয়জনিং করা হচ্ছে, সেদিন শেখ হাসিনাকে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ঠিক নাভালিনের মত স্লো পয়জনিং করে হত্যার চেষ্টা করেছিল। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ অবধি নির্যাতনের স্বীকার হন।

বাস্তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং রাষ্ট্রকে মানুষের কল্যাণে এনে মানুষের নিরাপত্তার সর্বোচ্চ অবস্থানে নিতে হলে এই পন্থাগুলো কখনই শুভ ফল দেয় না। আর রাষ্ট্রীয় হেফাজত হতে হয় সব থেকে নিরাপদ হেফাজত। জেলখানাকে হতে হয় রাষ্ট্রের সব থেকে নিরাপদ স্থান। দেশকে সত্যি অর্থে মানুষের কল্যাণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে কোনো তাড়াহুড়ো না করে এই ন্যায়ের পথ ধরে এগুনোই সর্বোচ্চ পথ। রাশিয়া নাভালিনের ক্ষেত্রে সে চিন্তাই করবে এটাই গণতান্ত্রিক বিশ্বের আকাঙ্ক্ষা।

এ বিভাগের আরো খবর