বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কোনো পক্ষেরই বাড়াবাড়ি কাম্য নয়

  •    
  • ২১ এপ্রিল, ২০২১ ১৭:২৯

সব পেশাতেই ভালো এবং মন্দ মানুষ আছে। পেশাজীবীদের সংগঠনগুলো সদস্যদের মান ভুলত্রুটি সংশোধনের দিকে সামান্য নজর দিলেও হয়তো দেশের মানুষের উপকার হতো। মানুষের সেবা দেয়া যাদের কাজ, তাদের কেউ কেউ যে মানুষের প্রতি খারাপ আচরণ করেন, তারা যে অনেক সময় মানুষের বাড়তি দুঃখ-দুর্ভোগের কারণ হন। তা নিশ্চয়ই সংগঠনের নেতাদের অজানা নয়। কিন্তু কোনো সংগঠন কি তাদের কোনো সদস্যকে কখনও মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য নিন্দা বা তিরস্কার করেছেন? ক্ষমতা পেলে তার অপব্যবহার আমাদের একটি জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে লকডাউনের মধ্যে একজন নারী চিকিৎসক, পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে যে বাগবিতণ্ডা হয়েছে, তা এখন অনেকেরই জানা। ঘটনার সময় ধারণকৃত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা হতে থাকে। কেউ মনে করছেন, চিকিৎসকের অন্যায়। তিনি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। আবার কেউ বলছেন, পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট বাড়াবাড়ি করেছেন। একটু ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটি ভাবলে এটা বোঝা যায় যে, একটি ছোট ঘটনাকে বড় করে তুলতে তিনজনই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। এই বিষয়ে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং বিএমএ’র দেয়া বিবৃতি ফয়সালার পথে না হেঁটে পেশাগত বিদ্বেষ বাড়াতে প্ররোচনা জোগানো হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন।

কী হয়েছিল সেদিন? এলিফ্যান্ট রোডের নিরাপত্তা চৌকিতে একজন চিকিৎসকের গাড়ি থামিয়ে পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর এবং একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার পরিচয়পত্র দেখতে চান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনির কাছে তখন পরিচয়পত্র না থাকলেও লকডাউনের সময় হাসপাতালে কাজ করার আদেশনামা, গাড়িতে বিএসএমএমইউর স্টিকার এবং পরনে তার নাম লেখা গাউন ছিল। তারপরও তার সঙ্গে কর্তব্যরত পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট কেন নমনীয় না হয়ে পরিচয়পত্র না থাকার জন্য অসৌজন্যমূলক আচরণ করলেন, তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এ থেকে মনে হতে পারে যে, ওই দুইজনের ডাক্তারের প্রতি কোনো কারণে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ছিল। সুযোগ পেয়ে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

বলা হচ্ছে, চিকিৎসক ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছেন এবং গালি দিয়েছেন। এটাও অসত্য নয়। এখানে প্রশ্ন হলো, চিকিৎসক কি আগে উত্তেজিত হয়ে তুই বলেছেন, নাকি তাকে প্ররোচিত করা হয়েছে? নিশ্চয়ই কোনো অবস্থাতেই একজন চিকিৎসকের মুখে অশোভন শব্দ উচ্চারণ ঠিক নয়। সবাইকে তার শিক্ষা ও পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কথাবার্তা, চালচলন করতে হবে। কিন্তু অন্যদিকটিও দেখতে হবে। একজন চিকিৎসককে না জেনে ‘ভুয়া’ বলা, পাপিয়া নামের একজন বিতর্কিত নেত্রীর সঙ্গে তুলনা করা কি ঠিক?

এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনা দেখে মনে হয়, আমাদের দেশে লকডাউন কার্যকর করতে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সাহেবেরা বুঝি জীবনপণ করে মাঠে নেমেছেন। কাউকে বোধহয় বাইরে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি তো আসলে তা নয়। অপ্রয়োজনে, মিথ্যা কথা বলে অসংখ্য ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় চলছে। তাদের অনেকের কাছেই মুভমেন্ট পাস বা বাইরে বের হওয়ার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি এবং অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার বাইরে জনপরিবহন অব্যাহত আছে। কই কারো সঙ্গেই তো পুলিশ মারমুখী আচরণ করছে না। অ্যাপ্রোন পরা একজন চিকিৎসকের ব্যাপারেই ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ইনস্পেক্টর এত কড়া হলেন কেন? এ থেকে কি পেশাদারি দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, নাকি একটি বিশেষ পেশার প্রতি বিরাগের প্রকাশ লক্ষ করা যায়?

ডা. সাঈদা ঘটনার একপর্যায়ে নিজেকে একজন খেতাবপ্রাপ্ত

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়াতেও অনেককে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ প্রশ্ন তুলছেন, যাদের পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা নেই তাদের কী হবে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে পৃথক আলোচনা করা যাবে। তবে এখানে বলার কথা এটাই যে, কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গ টেনে না আনাই ভালো। এমনিতেই বিষয়টিকে আমরা অনেক হালকা করে ফেলেছি। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যদি কোনো কারণে এই গৌরবের কথা প্রকাশ করেন, তাতে বড় কোনো অন্যায় হয় না। ডা. সাঈদা নিশ্চয় পিতার পরিচয় ভাঙিয়ে তার বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাননি। এ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা তারাই করতে পারে যাদের রক্তে বিরোধিতার বীজ আছে। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তা বলতে না চান, সেটা তার ব্যক্তিগত রুচিবোধের ব্যাপার। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, সে পরিবারের সদস্যদের তো এই গ্লানি বহন করতেই হবে। ডা. জেনি পিতার পরিচয় হয়তো উত্যক্ত হয়েই দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তো মিথ্যা বলেননি। অসত্য তথ্য দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশীদ। তিনিও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে দাবি করলেও জানা গেছে, তার পিতা একাত্তরে খুলনায় রাজাকার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন এবং বিএমএর পক্ষ থেকে দুটি পৃথক বিবৃতি দেয়া হয়েছে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে ‘ওই চিকিৎসক গোটা বাহিনীকে হেয় করেছেন’ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। অপরদিকে চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর বিবৃতিতে ‘চিকিৎসককে হেনস্তায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার’ দাবি জানানো হয়েছে।

আগেই বলেছি, এলিফ্যান্ট রোডে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অনভিপ্রেত। একটি ছোট বিষয়কে অকারণ বড় করা হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের পেশাদারি সংগঠন এবং চিকিৎসকদের পেশাদারি সংগঠন নিজ নিজ সংগঠনের সদস্যদের পক্ষ নিয়ে বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। বিষয়টিতে যে উভয়পক্ষের বাড়াবাড়ি আছে তা কোনো সংগঠন স্বীকার করেনি। এটা দুঃখজনক।

আমাদের দেশে এটাও একটা সমস্যা যে, পেশাজীবীদের নিজস্ব সংগঠন আছে এবং এই সংগঠনগুলো নিজেদের সদস্যদের অসদাচরণের প্রতি সব সময় নমনীয়তা দেখাতে অভ্যস্ত।

সব পেশাতেই ভালো এবং মন্দ মানুষ আছে। পেশাজীবীদের সংগঠনগুলো সদস্যদের মান ভুলত্রুটি সংশোধনের দিকে সামান্য নজর দিলেও হয়তো দেশের মানুষের উপকার হতো। মানুষের সেবা দেয়া যাদের কাজ, তাদের কেউ কেউ যে মানুষের প্রতি খারাপ আচরণ করেন, তারা যে অনেক সময় মানুষের বাড়তি দুঃখ-দুর্ভোগের কারণ হন। তা নিশ্চয়ই সংগঠনের নেতাদের অজানা নয়। কিন্তু কোনো সংগঠন কি তাদের কোনো সদস্যকে কখনও মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য নিন্দা বা তিরস্কার করেছেন? ক্ষমতা পেলে তার অপব্যবহার আমাদের একটি জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিকিৎসকদের কারো কারো বিরুদ্ধে যেমন মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে, তেমনি পুলিশের ব্যাপারেও তো মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। আবার এই দুই পেশার সদস্যদের কাছেই অন্যরা বিপদে আপদে ছুটে যায়। জীবন এবং সম্পদের নিরাপত্তার জন্য মানুষকে ডাক্তার এবং পুলিশের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এই যে গত এক বছরের বেশি সময় করোনাভাইরাসের ভয়ে মানুষ তটস্থ আছে, এই সময়েও তো ডাক্তার এবং পুলিশ নিজেদের জীবনবাজি রেখেই মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। এই সময় করোনায় ১৪০ জন চিকিৎসক, ৯০ জন পুলিশ প্রাণ হারিয়েছেন। তাই এই দুই পেশার মানুষ তো পরস্পরের প্রতিপক্ষ নন। আমরা আশা করব, একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ না ছড়িয়ে, একে অপরকে প্রতিপক্ষ না ভেবে পেশাজীবী সংগঠনগুলো সৌহার্দ্যের মনোভাব নিয়ে মানুষের বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয় দিক। কার ক্ষমতা বেশি সে বিতর্কে না গিয়ে কে কত বেশি মানবিক এবং সহনশীল – সেটাই হোক আলোচনার বিষয়। একটি কঠিন সময়ের মধ্যে আছি আমরা। এখন বিভেদ ভুলে এক হয়ে চলার সময়। এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনা নিয়ে পানি ঘোলার নীতি না নিয়ে ডাক্তার এবং পুলিশের সংগঠন দুটি একটি সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে তৎপর হবে বলেই আমরা আশা করব। মনে রাখতে হবে, সম্মান বা মর্যাদা জোর করে আদায় করার বিষয় নয়। এগুলো অর্জন করতে হয়। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে উদ্ধত নয়, বিনয়ী করে।

সবার মধ্যে শুভবোধের উদয় হোক। মানুষের বিপদ-সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় দেই। খারাপ দৃষ্টান্ত সামনে এনে কূটতর্কে না জড়িয়ে ভালো দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমরা নিজেরাই যেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর