বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মালেকা বেগম: নিভে গেল শিক্ষার প্রতিবাদী কণ্ঠ

  • শরিফুজ্জামান পিন্টু   
  • ২০ এপ্রিল, ২০২১ ১৬:৫৮

মাধ্যমিক শিক্ষার কোথায়, কতটুকু অসঙ্গতি—এটা ভালো করেই জানতেন প্রতিবাদী ও প্রবীণ শিক্ষক নেতা মালেকা বেগম। তার সঙ্গে বেশিরভাগ কথায় হতো শিক্ষা বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে। উনি যেহেতু শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, সেহেতু শিক্ষার অনেক খবরাখবর রাখতেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি ছিলেন এক সময়।

‘ভাই, এই অন্যায় আর মানা যায় না। প্লিজ, কিছু লেখেন।’ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক নেতা মালেকা বেগমের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে এই কথাটি কানে বাজছে।

ভাঙা গলায় বলা তার এই বাক্যটি বারবার মনে পড়ছে। করোনা কেড়ে নিয়েছে প্রতিবাদী ও প্রবীণ এই শিক্ষক নেতাকে।

মালেকা আপাকে কবে থেকে চিনি, মনে পড়ছে না। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে ভালোভাবে চিনি। তখন জনকণ্ঠে প্রায়ই আসতেন। বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকার বাইরে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকার নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তখন প্রায়ই যোগাযোগ হতো। সর্বশেষ খুলনা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তবে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তিনি অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

মালেকা আপা ফোন করলেই তার প্রতিবাদী বক্তব্য শুনতে হতো। মাধ্যমিক শিক্ষার কোথায়, কতটুকু অসঙ্গতি—এটা তিনি ভালোই জানতেন। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরতে পারতাম না। একদিন উনি কয়েকবার ফোন করেছিলেন। কোনো জরুরি কাজে ফোন ধরতে পারিনি।

পরে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ভাই, আপনি ফ্রি থাকেন কখন?’

বললাম, ‘বেশি রাতে’।

আপা বললেন, ‘বেশি রাত মানে কয়টা?’

বললাম, ‘রাত সাড়ে ১১ বা ১২টা’।

‘এত রাতে ফোন দেব?’

বললাম, ‘অনেকেই তো দেন। কারণ, অন্য সময় বেশি কথা বলার সুযোগ পাই না।’

এরপর থেকে উনি রাতেই ফোন করতেন। বেশিরভাগ ফোন শিক্ষা বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে। উনি যেহেতু শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, সেহেতু শিক্ষার অনেক খবরাখবর রাখতেন। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি ছিলেন এক সময়।

একবার উনি নিজেই শিক্ষা বিভাগের রোষানলে পড়েছিলেন। ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ওনার পক্ষে জনকণ্ঠে একটি লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আমিও প্রতিবেদন লিখেছিলাম ওনার ওপর অন্যায়ের চিত্র তুলে ধরে। এরপর তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

সেই কৃতজ্ঞতা উনি অনেকবার প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ খুলনা জেলা স্কুলেও একটি ঝামেলায় পড়লেন। যেহেতু প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন, সেহেতু স্কুলে, শিক্ষা বিভাগে বা শিক্ষক রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ ছিল।

সম্ভবত, ২০১৮ সালে উনি অবসরে গেলেন। খবরটি জানিয়ে তিনি বললেন, ‘এই আপা আর আপনাকে খবরাখবর দেবে না।’

বলেছিলাম, অবসরে গেলেও তো আপনার চোখ–কান বন্ধ হয়ে যাবে না। একদিন ঢাকায় আসেন কথা বলব। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর আর দেখা হয়নি। শুধু একদিন ফোন করে বললেন, ‘ভাই, কন দেখি আমি নাকি ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি করছি। জীবনভর দুর্নীতি ঠেকালাম। শেষ সময়ে আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। আমার পেনশন আটকে রেখেছে।’

বললাম, ‘ধৈর্য ধরেন, আপা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এরপর তদন্তে দেখা গলে, তার বিরুদ্ধে ভর্তি অনিয়মের অভিযোগ সঠিক ছিল না। বেশ কিছুদিন ভোগার পর উনি পেনশন পেলেন।

আজ মালেকা আপার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। শিক্ষা বিষয়ে যখন সাংবাদিকতা করতাম, তখন আপনার অনেক সহায়তা পেয়েছি। যেখানেই অনিয়ম, দুর্নীতি দেখেছেন জানাতে দেরি করেননি। নিজের স্বার্থের চেয়ে শিক্ষার স্বার্থ বেশি দেখেছেন। খুলনা জেলা স্কুলের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন সেই ব্যস্ত সময়েও আপনার ফোন ধরতে হতো। স্কুলের ভালো ফল করার খবরটি আমাকে জানিয়ে যেন স্বস্তি পেতেন।

একবার আমার এক চাচাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম। খুলনায় মালেকা বেগমের তখন অনেক নামডাক। ওই চাচা তো ভেবেছেন খুলনা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিন্তু চাচা ফিরে এসে তো ভাতিজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খুলনা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে এতো স্নেহ করতে পারেন, এটা নাকি চাচার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে।

ভালো থাকেন মালেকা আপা। খুলনায় শিক্ষকতা করলেও আপনার ছাত্ররা দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে আছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে আপনি বেঁচে থাকবেন। সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে বেঁচে থাকবেন শিক্ষা জগতের ‘প্রতিবাদী কণ্ঠ’ হিসেবে। হে আল্লাহ, মালেকা আপার জন্য বেহেশতে একটু জায়গা রেখো।

লেখক: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর