২০১২ সালে ম্যানচেস্টার সিটির ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের পর একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়। ৪৪ বছর পর সিটির লিগ শিরোপা জয়ের ম্যাচ দেখে ফেরা এক ভক্তের সাক্ষাৎকার ছিল ওই ছোট ভিডিওতে।ইতিহাদ স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বয়স্ক ওই সিটি সমর্থক বলেন, ‘আমার ৪৪ বছরের অপেক্ষা শেষ হলো। ১৯৬৮ সালে তাদেরকে শিরোপা জিততে দেখেছি। তাদেরকে আমি ৭৫ বছর যাবৎ সমর্থন করে আসছি। ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা এক তরুণ ছিলাম। মাথা ভর্তি চুল ছিল আমার। দেখো এরা আমার কী অবস্থা করেছে (নিজের টাক মাথার দিকে ইঙ্গিত করে)!
ভাইরাল হয়ে পড়া সেই বৃদ্ধের নাম জানা যায়নি। জানার প্রয়োজনও নেই বোধহয়। যারা ফুটবলকে ভালোবাসেন তারা জানেন খেলাটার আবেগটাই এমন। দলের যে অবস্থাই থাকুক না কেনো ভক্তরা সমর্থন যুগিয়ে যান আজীবন।ইউরোপে ফুটবল সংস্কৃতির দিকে তাকালে দেখা যাবে এই সমর্থন ও সমর্থকেরাই টিকিয়ে রেখেছে ফুটবল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে চলে আসে নির্দিষ্ট কোনো দলের সমর্থন। কেউ বা বাবাকে দেখেছেন সমর্থন করতে। কারও বা জন্ম ও বেড়ে ওঠা নির্দিষ্ট শহরে যেখানে ফুটবল ক্লাব হাতে গোনা। ছোটবেলা থেকে তাদেরই সমর্থন করে চলা।শহর বা এলাকা ভিত্তিক সমর্থকেরাই মূল ভিত্তি ইউরোপিয়ান ফুটবলের। লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, মাদ্রিদ, মিলান, বার্সেলোনা কিংবা মিউনিখ এই শহরগুলোর পরিচয় বিশ্বজুড়ে এখন তাদের ফুটবল ক্লাবগুলোকে দিয়েই।এই সমর্থকদের কথা না ভেবেই বা কিছু ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়েই যখন ইউরোপের সেরা ১২টি ক্লাব চুক্তি করে ফেলে বিদ্রোহী এক টুর্নামেন্টের তখন তা আলোচনা- সমালোচনার ঝড় তুলবে সেটাই স্বাভাবিক। নতুন সুপার লিগ যাত্রার প্রাক্কালে ফুটবল ফ্যানদের কথা ভেবেছে কি না ক্লাবগুলো সেই প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।সুপার লিগে যোগ দেয়া ছয় ইংলিশ ক্লাবের সমালোচনা করে বরিস জনসন বলেন, ‘পরবর্তী কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে ক্লাবগুলোকে তাদের সমর্থক ও ফুটবল কমিউনিটিকে জবাব দিতে হবে।’ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পর এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করেছে খোদ ইউয়েফা। তাদের চেয়ারম্যান আলেক্সান্ডার সেফেরিনের কাছে এই পদক্ষেপ ভক্তদের মুখে থুথু দেয়ার সমান।‘আমার মতে এই পরিকল্পনা সমর্থক ও পুরো সমাজের মুখে থুতু দেয়ার মতো। আমরা কোনোভাবেই খেলাটিকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে দেবো না।’ক্লাব ও ইউয়েফা দ্বন্দ্বের শুরুটা কোথায় সেটা জানতে কিছুটা পেছাতে হবে।ইউরোপের সেরা ক্লাব নির্ধারণ করার জন্যে ১৯৫৫ সালে শুরু হয় ইউরোপিয়ান কাপ। তবে এতে অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। শুধু মাত্র চ্যাম্পিয়নরাই এতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতো। আর টুর্নামেন্ট নক-আউট হওয়ায় খুব বেশি ম্যাচ খেলারও সুযোগ পেতো না ক্লাবগুলো।১৯৯২ সালে ইউয়েফা বদলায় টুর্নামেন্টের নাম। অ্যাপিয়ারেন্স ফি ও প্রাইজমানি বাড়লেও দলের সংখ্যা রয়ে যায় আটে। পরের বছর সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও বড় ক্লাবগুলো নাখোশ ছিল তাতেও। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় সুপার লিগের পরিকল্পনা।সেটি ঠেকাতে ১৯৯৭-৯৮ সালে ইউয়েফা বর্ধিত কলেবরে আয়োজন করে চ্যাম্পিয়নস লিগ। ১৬ দল থেকে করা হয় ২৪ দলের টুর্নামেন্ট। তারও দুই বছর পর ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে শুরু হয় ৩২ দলের আসর। যা এখনও টিকে আছে।ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো বরাবরের দাবী ছিল বড় ক্লাবগুলো যেন লভ্যাংশ বেশি পায় যেহেতু তারাই টিভি রেটিং ও মাঠের দর্শককে বেশি আকর্ষণ করে। কিন্তু ইউয়েফা তাদের দাবিতে কান না দেয়ায় পরিকল্পনা করা হয় সুপার লিগের।সুপার লিগে অংশ নিলে বাড়তি অর্থ সুবিধা পাবে দলগুলো এটা নিশ্চিত। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী আমেরিকান কোম্পানি জেপি মরগ্যান টুর্নামেন্টের জন্য বাজেট করেছে ছয় বিলিয়ন ডলার। আর ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানি ডিএজিএন দিচ্ছে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি দল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য পাবে অন্তত ১২ কোটি ডলার। যেটি যেয়ে ঠেকতে পারে ৪৩ কোটি ডলারে।এ ছাড়া লক্ষ্য করার মতো বিষয় ১২ ক্লাবের জোটের পাঁচটি ক্লাব আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, টটেনহ্যাম হটস্পার, মিলান ও ইন্টারনাৎসিওনাল গত এক দশকে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিয়মিত নয়। ঘরোয়া সাফল্যও কম পাচ্ছে এই দলগুলো।বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মাঝারি মানের দল আর্সেনাল, যারা সবশেষ লিগ জিতেছে ২০০৪ সালে ও কখনই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি। তাদের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগের আশায় বসে না থেকে সুপার লিগে খেলার প্রস্তাবই ভালো।কারণ, এই ১২টি ক্লাব সহ মোট ১৫টি ক্লাবকে করা হবে টুর্নামেন্টের স্থায়ী সদস্য। বাকি ৫টি ক্লাব নির্বাচন করা হবে ঘরোয়া লিগে পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে। ফলে, আর্সেনাল বা টটেনহ্যামের মতো অসফল কিন্তু জনপ্রিয় দলগুলোর সামনে সুযোগ নিশ্চিত ভাবে ১২ কোটি ডলার বাগানোর। সঙ্গে প্রতি মৌসুমের অন্যান্য আয় তো থাকছেই!পাশাপাশি রয়েছে টিভি রেটিং ও স্টেডিয়ামে দর্শক উপস্থিতির বিষয়ও। ১২টি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব হওয়ার কারণে প্রায় সবসময়ই তাদের ম্যাচের রেটিং থাকে উচ্চ। তবে, যখন তারা নিচু সারির কোনো দলের বিপক্ষে খেলে ও ওই একই সময়ে অন্য দেশের লিগে বড় কোনো খেলা হচ্ছে তখন রেটিং কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে বৈকি!উদাহরণ হিসবে বলা যায়, যদি লিগ ম্যাচে আর্সেনাল মুখোমুখি হয় ফুলহ্যামের আর অন্য চ্যানেলে যদি থাকে মিলান বনাম ইউভেন্তাস লড়াই, বৈশ্বিক বাজারে দ্বিতীয়টিরই চাহিদা বেশি থাকবে সন্দেহ নেই।এ ছাড়া এই ১২টি ক্লাবের স্টেডিয়ামগুলোও বিরাট। অন্তত ৭০ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন। বার্সেলোনার ক্যাম্প ন্যুয়ে ধরে প্রায় এক লাখ (৯৯ হাজার ৫০০)। এমন কোনো দল যখন চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে যায় বেলারুশের বাতে বরিসভের ১৩ হাজার ধারণক্ষমতার মাঠে, তখন টিকিট বিক্রি থেকে থেকে পাওয়া লভ্যাংশের পরিমাণ নিয়ে দুশ্চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক তাদের জন্যে।মোটা দাগে এই সব বিষয়গুলোই চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করে ক্লাবগুলোর মধ্যে। সুপার লিগ হলে প্রতি সপ্তাহেই থাকবে ব্লকবাস্টার সব ম্যাচ। স্পনসররা ঝাপিয়ে পড়বেন, দর্শকে টইটুম্বুর হয়ে থাকবে গ্যালারি এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।তবে, এতো পরিকল্পনা ও অর্থকড়ির ঝনঝনানিতে ক্লাবগুলো ভুলে গেছে ফুটবলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথা। সমর্থক। শুরুতে যেমনটা বলা হয়েছে, সেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের ভক্তদের কথা ভাবতে হবে ক্লাবগুলোকে সবার আগে। ভাবতে হবে তাদের সংস্কৃতি ও চিরকালীন অভ্যাসের কথা।যে অভ্যাসে তারা প্রতি উইকেন্ডে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-বান্ধবী-বন্ধুকে নিয়ে যান মাঠে। ম্যাচ শেষ দলের জয়ে একান থেকে ওকান হাসি নিয়ে ফেরেন, প্রতিপক্ষ সমর্থকদের দু’কথা শোনাতে শোনাতে। লোকাল ডার্বিগুলো এখনও সমর্থকদের দেয় ‘ব্র্যাগিং রাইটস’।ইউয়েফা এরই মধ্যে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে সুপারলিগের দলগুলোকে তারা খেলতে দেবে না ঘরোয়া লিগ ও অন্য মহাদেশিয় আসরগুলোতে। নিষিদ্ধ হবেন ফুটবলাররা।এই কারণেই ভক্তরা সুপার লিগ চাচ্ছেন না। তাদের ভয় ক্লাবগুলো ঘরোয়া ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ও শুধুমাত্র খেলবে সুপারলিগে। নিষেধাজ্ঞার পরও থামবে না তাদের সেই নতুন ‘পয়সা বানানোর মেশিন’।ভক্তদের ক্ষোভটা বোঝা গেছে তাদের প্রতিক্রিয়াতেই। ইংল্যান্ডের ছয়টি ক্লাবের সমর্থকেরা ক্লাবের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছেন নানা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার। কোনোটাতে লেখা ‘গরীবদের থেকে ছিনিয়ে ধনীদের জন্য’, কোনোটাতে ‘ধিক্কার তোমাদের’।সার্বজনীনতার কারণে ফুটবলকে ডাকা হয় দ্য বিউটিফুল গেইম। ভিয়া ফিয়োরিতার দিয়েগো মারাদোনা কিংবা আলজেরিয়ান ইমিগ্র্যান্ট জিনেদিন জিদান দোলা দেন ধনী গরীব নির্বিশেষে সকল সমর্থকের মনে। সুপার লিগ যদি জয় করতে পারে এই সমর্থকদের মন তাহলেই একমাত্র ইউয়েফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেও সাফল্য পাওয়া সম্ভব।আর যদি ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে যেয়ে শুধুমাত্র টিভি রেটিং, বিজ্ঞাপণ ও মার্চেন্ডাইসিং-এ মনোযোগী হয় নতুন এই লিগ তাহলে হয়তো পুরনো সমর্থকদের ভুলে নতুনদের আকর্ষণ করার পরিকল্পনা আঁটতে হবে ক্লাবগুলোকে।