বিশ্ব এক অস্থির সময় পার করছে। প্রতিনিয়ত চারদিকে মৃত্যুর সংবাদ। যা চারপাশকে আতঙ্কিত করছে এবং অনিশ্চয়তায় ঢেকে দিচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মে এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন এবং প্রস্থান এ কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত খবর নয়। বরং যা একেবারেই চিরন্তন সত্য। প্রতিদিন খবরের কাগজে পরিচিত এবং অপরিচিত মানুষজনের মৃত্যু সংবাদ দেখতে পাই। বরেণ্য ও অগ্রগণ্য মানুষের চলে যাওয়া আমাদেরকে ভাবায় এবং কাঁদায়। তেমনি একজন যৌক্তিক বোধশক্তিসম্পন্ন মানবতাবাদী কলাম-লেখক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে চলে যাওয়া সচেতন মানুষকে বেদনাহত করে।
এ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ১৯৫৩ সালের ৯ জুন পিরোজপুর জেলা সদরে পিতার কর্মস্থলের সরকারি বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃকসূত্রে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার পিটুয়া গ্রামের বাসিন্দা, যিনি কিনা কর্মগুণে আজ স্বমহিমায় খ্যাত। এ মহান শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৪ সালে বিএসএস এবং ১৯৭৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে জার্মানি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং ওই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যও ছিলেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে তিনি ঢাকায় বসবাস করছিলেন।
এ মানুষটি শিক্ষকতার পাশাপাশি তার ক্ষুরধার লেখনী চিন্তাশক্তি দেশপ্রেম সততার চর্চায় এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন। কঠিন অধ্যবসায়ী মেধাবী এ লেখকের চিন্তার ক্ষেত্র ছিল প্রধানত আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং বৈদেশিকনীতি। মৃত্যু অবধি এ আঙিনায় তার সরব বিচরণ নানা কলামে, বইয়ে এবং টকশোর আলোচনায় নানাভাবে উঠে এসেছে।
যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে আগ্রহ এবং বিচরণ এতই বিস্তৃত যে সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি এবং রাজনীতির হাল হকিকত সবকিছুই তার নখদর্পণে ছিল। তার লিখিত বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোষ নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এসব বিষয়ে জ্ঞানপিপাসু এবং বিশ্লেষকদের জ্ঞানের বাতিঘর হিসেবে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
তার লেখনীর অন্যতম বিশেষত্ব ছিল দেশপ্রেম; যার সরব উপস্থিতি দেখা যায় আন্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে যৌক্তিক এবং নির্মোহ মতামত তুলে ধরার মাধ্যমে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশেষত তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ফারাক্কা বাঁধ এবং টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ক তার তথ্যবহুল লেখনী নীতিনির্ধারকের সিদ্ধান্ত নিতে ও এগিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এ শক্তিমান লেখক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকার ও রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এসব বিষয়ে পুস্তক রচনা করে পাঠকদের মনে স্থান করে নিয়েছেন।
এ মানুষটি দেশ মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ধারণ করতেন। নির্মোহ সত্যকথনে সামান্যতম আপোস করতেন না। যার চরিত্রে তোষামোদি স্থান করতে পারেনি। তিনি সবসময় ভাবতেন এ দেশের সার্বভৌমত্ব বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদার। যার ফলস্বরূপ তিনি রচনা করেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতি, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ট্রানজিট ও গ্যাস রপ্তানি প্রসঙ্গ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও সমকালীন বিশ্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের রাজনীতির পঞ্চাশ বছর এবং করোনা পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতি বইটি প্রকাশের অপেক্ষায়। তুলনামূলক রাজনীতির বিষয়ে তার আলাদা নজর ছিল। যিনি সমসাময়িক ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গে নিয়মিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাগজে কলাম লিখতেন। বিভিন্ন টকশোতে যৌক্তিক তথ্যবহুল আলোচক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
একজন শিক্ষক ও জ্ঞানতাপস কতটুকু পরিশ্রমী ও নির্মোহ হলে এত অল্প সময়ে জ্ঞানের রাজ্যে বিশাল অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন, তার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা তারেক শামসুর রেহমান। শিক্ষকতাকে ভালোবাসতেন, ছাত্র ও গবেষণা ফেলোদের সঙ্গে আন্তরিকতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ফলে তার অধীনে ভালো মানের গবেষক তৈরি হয়েছে। যারা এ বিষয়ে অবদান রেখে চলেছেন। কোনো কাজ তিনি আগামীর জন্য ফেলে রাখতেন না। ফেলোদের উপর অর্পিত কার্যাবলি যথাযথ তদারকি করে ইতিবাচক মতামত দিতেন।
এ শিক্ষকের সান্নিধ্যে যারাই এসেছেন তার অমায়িক ব্যবহার দৃঢ়চেতা মানসিকতা এবং দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়েছেন। এ মানুষটির কোনো শত্রু ছিল না। কর্মবীর এ মেধাবীকে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন তার অগণিত ছাত্র ও শুভার্থী। সবার মঙ্গল কামনাই ছিল যার ব্রত।
কিছুটা মেজাজি স্বভাবের এ মানুষটি কখনো অন্যায় ও অনিয়মের সঙ্গে আপস করেননি। সংসার জীবন ছিল অগোছালো, সর্বদা পড়ালেখায় ব্যস্ত মানুষটিকে শেষদিকে একাকিত্ব গ্রাস করে। যার কারণে প্রায়শই বলতে শোনা যেত, মহান প্রভু যেন তাকে সুস্থ অবস্থায় মৃত্যু দান করেন। আমৃত্যু লালিত এ বাসনা টুকু ও সৃষ্টিকর্তা পূরণ করেছেন। একজন শিক্ষকের কাজই তো নিরপেক্ষ থেকে কাজ করে যাওয়া। এ মহান শিক্ষক সারাজীবন এ কাজটি সুচারুভাবে করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। জ্ঞান আহরণ জ্ঞানের চর্চা এবং জ্ঞান বিতরণ এ তিন ধারায় সমান পারদর্শী ছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সমসাময়িক রাজনীতি বিষয়ক ৫০-এর অধিক বই পাঠকের সামনে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিনয়ী মার্জিত সদালাপী এ মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সৃষ্টিশীল আকর যুগ যুগ ধরে জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা নিবারণের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। এ মহান শিক্ষকের মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং তার লেখনী এগিয়ে চলার প্রেরণা।
লেখক: শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।