ইসরায়েলের জেরুজালেম হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইউভাল নোয়াহ হারারির মতে, রাষ্ট্র এক সময় নাগরিকের শরীরের ওপরের অংশ পরিবীক্ষণ করত, বোঝার চেষ্টা করত রাজনৈতিক মতবাদ, অভিব্যক্তি, চিন্তাচেতনা ও গতিবিধি।
করোনা রাষ্ট্রকে সুযোগ করে দিয়েছে নাগরিকের শরীরের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের। রাষ্ট্র আজ সহজেই ব্যক্তির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত শরীর সম্পর্কিত তথ্য পরিবীক্ষণ করতে পারছে। রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের ওপর অংশের পরিবীক্ষণকে হারারি বলছেন ‘ওভারস্কিন’ মনিটরিং। করোনাকালে এ পরিবীক্ষণে বড় ধরনের পরিবর্তন এলো- রাষ্ট্র অবাধে নাগরিকের ‘আন্ডারস্কিন’ মনিটরিংয়ের অবারিত সুযোগ পেল।
অনেক আগেই ডেভিড আরনল্ড তার বিখ্যাত বই ‘কলোনাইজিং দ্য বডি’তে উল্লেখ করেন যে, প্রতিটি মহামারি কীভাবে ব্যক্তির শরীরে উপনিবেশের শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলে। কীভাবে আধিপত্যের শেকড় বিস্তৃত হয়। প্রতিটি মহামারি নতুন রাজনীতি, নতুন অর্থনীতি ও নতুন আধিপত্যের সোপান গাড়ে।
মহামারি মানে কেবল জীবন ও মৃত্যুর সমীকরণ নয়, এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতা ও জ্ঞাননির্ভর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তর লড়াই। এটাও মহামারিকে ঘিরে এক ধরনের আধিপত্যবাদ।
করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোড়দৌড় দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ মুহূর্তে যে রাষ্ট্র যত দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ভ্যাকসিন সবাইকে সরবরাহ করতে পারবে সেই রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে বিশ্ববাসীর মনোজগতে আলাদা একটা জায়গা পেতে সক্ষম হবে, যা হবে নতুন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়।
করোনাকালে সমকালীন রাজনৈতিক প্রবণতা হলো ‘নলেজ সুপ্রিমিসি’ বা জ্ঞাননির্ভর আধিপত্য। ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম তার অন্যতম একটি দিক। করোনা ভ্যাকসিন হয়ে উঠছে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণের নতুন নিয়ামক।
করোনাকালে নাগরিকের শরীরের উপর ও অভ্যন্তরে জমে থাকা তথ্যের ওপর রাষ্ট্রের পুনর্নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ মহামারি প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি করে তুলেছে। নিকট ভবিষ্যতে এ থেকে মুক্তির কোনো আশা নেই। তাই মহামারি হয়ে উঠছে দাসত্ব ও বন্দিত্বের সহায়ক উপায়। মহামারি কেবল ব্যক্তি সংরক্ষণবাদকে উৎসাহিত করছে না, বরং রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণবাদকে উৎসাহিত করে। নলেজ সুপ্রিমিসি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যস্ত ধনী ও উন্নত দেশগুলো। করোনার কারণে ক্ষতির মাত্রা সবার সমান নয়। যারা যত গরিব তারা ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যারা ধনী বা বিত্তবান তারা তত সুরক্ষিত বা উপকৃত। এ মহামারি জাতীয়তাবাদী ধারণাকে নতুন করে শক্তিশালী করে তুলছে।
মনে রাখতে হবে, মহামারি হলো রোগকেন্দ্রিক ও ওষুধ ও পণ্যের প্রসার। মোড়ে মোড়ে সুসজ্জিত ওষুধের দোকান, নতুন আউটলেট খোঁজার ধুম। দেখে মনে হবে, এ সমাজ কেবল জীবন আর মৃত্যুর পসরা সাজিয়ে বসেছে।
বাস্তবতা হলো সব মৃত্যুই সমান কিন্তু সব জীবন সমান নয়। করোনাকালে সেই সত্য নতুনভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। যার যতটুকু সামর্থ্য থাকে, তার ততটুকু সুরক্ষা। যার সামর্থ্য নেই, তার সুরক্ষার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু সবাই সুরক্ষিত না হলে এককভাবে কেউ সুরক্ষিত হতে পারবে না। সুরক্ষা সবার জন্য, কেবল ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এখানে বিভক্তির কোনো সুযোগ নেই। করোনাকে ঘিরে সমাজে বিভক্তি তীব্র হচ্ছে। বৈষম্য সাদা চোখে ধরা পড়ছে। করোনা ছড়ানোর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘিষ্ঠদের দুষছেন। এক দেশের সরকার আরেক দেশকে দুষছে। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে দুষছেন। একইসঙ্গে চলছে ভিকটিম ব্লেমিং বা ভুক্তভোগীদের দোষারোপ। মহামারি থেকে সুরক্ষা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে সচেতন ও বাধ্য করার দায়িত্বও রাষ্ট্রের।
আরেকটি দিক হলো, করোনাকালে যেসব সুরক্ষা উপকরণ পথে-ঘাটে বিক্রি হচ্ছে এবং তা হচ্ছে তুলনামূলক কম দামে, সেগুলো কি যথেষ্ট মানসম্মত? এগুলো কি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে?
মহামারিতে স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীর মান ও ত্রুটিপূর্ণ বাজারব্যবস্থা সহজেই চোখে পড়ছে। মানবিক এ বিপর্যয় করোনা সুরক্ষার উপকরণের মান সকল ক্ষেত্রে সমান নয়। বড় বড় শহরগুলোতে যেসব সুরক্ষার উপকরণগুলো পাওয়া যাচ্ছে আর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যে উপকরণগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর মানের ভেতর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। রয়েছে সহজলভ্যতার সংকট। আরও রয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। অথচ করোনা রোগের প্রভাবে নেই কোনো পার্থক্য। জাতীয় সীমাবদ্ধতা হলো সবার জন্য সমমানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
মহামারি নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের বিষয়টিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা জেনেছি, দুর্ভিক্ষে যারা বেশি লাভবান হয়েছে তাদের মধ্যে ডাক্তার শ্রেণি ছিল অন্যতম। করোনাকালে ওষুধ শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের যেমন ফেসবুক, গুগল, জুম ও বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও অনলাইন কেনাকাটার সাইটগুলো অর্থের পাহাড় গড়ছে। করোনা হচ্ছে সিংহভাগ মানুষকে নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া এবং স্বল্পসংখ্যককে বিত্তশালী করার উপায়। করোনা বিশেষ শ্রেণির কাছে বিত্তবৈভব অর্জনের উপায় হয়ে ওঠছে।
করোনা মহামারির আরেকটি বিশেষ দিক রয়েছে প্যানিক বায়িং। জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জিনিসপত্র কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফলে বাজারে সংকট তৈরি হচ্ছে। প্যানিক বায়িং জনগণের পকেট কাটার এক অভিনব কৌশল। মাঝেমধ্যেই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোর কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। যেমন, গত বছর এসময় ডেটলসহ বেশকিছু স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে যায়। প্যানিক বায়িংয়ের পেছনে এক বড় ধরনের যোগসাজস কাজ করে। জনগণ জীবন বাঁচানোর তাগিতে অতিমূল্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র কিনতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারের কাছে ব্যক্তি হয়ে পড়ছে অসহায়।
করোনাকালে নেমে এসেছে অনিশ্চিয়তার ঘন অন্ধকার। সঙ্গে এসেছে তথ্য এবং অপতথ্যের মিশেল। নেই কোনো স্বচ্ছ তথ্যব্যবস্থা। আইইডিসিআর-এর মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারোনা সংক্রমণের হার, সুস্থ ও মৃত্যের পরিসংখ্যান। কী পরিমাণ জাতীয় সুরক্ষা সামগ্রী রয়েছে এর কোনো জাতীয় হালনাগাদ তথ্য নেই। যেখানে তথ্য থাকে না, সেখানে শেকড় গেড়ে বসে গুজব। একদিকে অসুস্থতা, অপরদিকে তথ্যশূন্যতা ও গুজব মিলিয়ে এক ধরনের নতুন ‘পাবলিক সাইকি’।
এর একটি বিশেষ দিক হলো জন-অস্থিরতা। এই অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে যে পাবলিক আচরণ তৈরি হচ্ছে, তার একটি বিশেষ দিক হলো পারস্পরিক আস্থাহীনতা। জনগণ তথ্য শূন্যতায় নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় অসহায় বোধ করছে। জনগণ জানে না করোনাকে ঘিরে আসলে কী হতে যাচ্ছে বা সামনের দিনগুলো কতটুকু অন্ধকারাচ্ছন্ন বা আলোকময়।
করোনাকালের চরম বাস্তবতা হচ্ছে অস্পষ্টতা। কেবল রাষ্ট্র পারে এ অস্পষ্টতা দূর করতে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রের রয়েছে ঢাক ঢাক গুড় গুড় অবস্থা। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে তা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। করোনা মহামারি প্রমাণ করছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি কতটা ভঙ্গুর। রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি।
বিপরীতে বেসরকারি উদ্যোগকে প্রণোদনা দিয়েছে। চারদিকে সুরম্য ও ঝকঝকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। যারা মূলত, স্বাস্থসেবার নামে জনস্বাস্থ্য নিয়ে এক ধরনের বাণিজ্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছে। তাদের এত চড়া চিকিৎসাব্যয় ভাবা যায় না, যা স্বল্প আয়ের বা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। করোনাকালে বেসরকারি ও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ছে।
রোগব্যাধিকে ঘিরে যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ওপর রাষ্ট্রের নজরদারির শৈথিল্য লক্ষ করা যায়। এর পেছনে রয়েছে বড় ধরনের রাজনীতি-অর্থনীতি। এসব প্রাইভেট ক্লিনিক ও হসপাতালের মালিকানার সঙ্গে রয়েছে রাজনীতির সংযোগ। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, একদিকে ভঙ্গুর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপরদিকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের উচ্চ চিকিৎসাব্যয়। এই দুয়ের চোরাগলিতে ঢুকে পড়েছে জনগণ। এই চোরাগলির সুড়ঙ্গ ক্রমশও দীর্ঘ হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি অন্ধকার জিইয়ে রাখে এবং তা আলোকায়নের উদ্যোগ না নেয়, তবে তা জনগণের জন্য চরম দুরাশার ব্যাপার হবে।
অন্ধকার পথে কোনো মুক্তি নেই। রাষ্ট্রের সামর্থ্য, প্রস্তুতি ও দক্ষতা নিয়ে জনগণ জানতে পারলে তাতে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি। কিন্তু জনগণের সে জানার সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ফলে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং সুরক্ষা উপকরণের সহজলভ্যতা ও স্বাস্থ্যসেবা। প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার রয়েছে। আর এ অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকাই মুখ্য। নাগরিকের শরীর নিয়ন্ত্রণ নয়, নয় কোনো রাজনীতি। নাগরিকের জীবন সুরক্ষাই রাষ্ট্রের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।