বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণ কতটা যৌক্তিক?

  •    
  • ১৯ এপ্রিল, ২০২১ ১২:৫৩

শহরাঞ্চলের ভোক্তারা এখন ভীষণ অসহায়। লাকড়ি ব্যবহার করার উপায় নেই ফলে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু জ্বালানির মূল্য উৎসভেদে ভিন্ন থাকায় ভোক্তারা অসমনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারে ঢাকা শহরে দুই চুলার জন্য মাসিক স্থায়ী খরচ বর্তমানে ৯৫০ টাকা। কিন্তু যারা প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার করেন, তাদের খরচ যথেষ্ট কম।

একই দ্রব্যের যদি পরিমাণ ও মান একই রকম থাকে, তাহলে দাম একই রকম হবে। কেউ কি দ্বিমত করবেন এর সঙ্গে? সবাই বলবেন এ তো সাধারণ কথা, যা সবাই সত্য বলে মেনে নেবে। কিন্তু এই সাধারণ সত্যের প্রয়োগ দেখছি না আমরা এখন অনেক ক্ষেত্রেই। যার সাম্প্রতিক নিদর্শন এলপিজির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঘটল।

দীর্ঘ ২০ বছর পর এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ৫৯১ টাকা আর বেসরকারি কোম্পানির ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ৯৭৫ টাকা। সাড়ে ১২ কেজির দাম তাহলে ১ হাজার ১৭ টাকা। একই ধরনের দহন ক্ষমতাসম্পন্ন জ্বালানি কিন্তু দামের জ্বালাটা ভিন্ন।

বলা হয়ে থাকে চাহিদা এবং জোগান দ্বারাই সব জিনিসের দাম নির্ধারিত হয়। তাহলে প্রথমেই দেখা যাক এ দেশে এলপি গ্যাসের বাজার তথা চাহিদা ও জোগান কেমন। বিইআরসির দেয়া তথ্য থেকে বুঝা যায় যে, দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। ২০০৮ সালে এ দেশে এলপি গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল যেখানে মাত্র ৫০ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে তা বেড়ে ১,০২০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১২ বছরে চাহিদা বেড়েছে ২০ গুণ।

২০০৮ সালে এ দেশে গৃহস্থালি রন্ধনকাজে মাথাপিছু এলপি গ্যাসের ব্যবহার ছিল ০.৩ কেজি, কিন্তু ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫.৬৩ কেজিতে। গৃহস্থালি রন্ধনকাজে এ দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে তা সত্ত্বেও এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় এখনও যথেষ্ট কম। যেমন জাপানে মাথাপিছু এলপি গ্যাসের ব্যবহার ৫৮ কেজি, মালয়েশিয়ায় ২১, ভারতে ১৬, ভিয়েতনামে ১৩ কেজি।

বিইআরসির প্রদত্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ শতাংশ বা ৩৮ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহারকারী। অন্যদিকে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশ রান্নায় প্রাকৃতিক গ্যাস বা এনজি ব্যবহারকারী। সামান্য কিছু মানুষ বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া বাকি প্রায় ৭৫ ভাগ জনগোষ্ঠী রান্নায় জ্বালানির জন্য বায়োমাসের ওপর নির্ভর করে থাকেন। দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রন্ধনকাজের পাশাপাশি শিল্প, বাণিজ্য ও অটোমোবাইল খাতেও এলপি গ্যাসের ব্যবহার বেশ ভালো মাত্রায় শুরু হয়েছে।

চাহিদা এবং মুনাফা যেখানে সেখানেই পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা ছুটবেন, বিনিয়োগ করবেন। জ্বালানির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৯টি সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুতকরণ, বিতরণ, সরবরাহের কাজে নিয়োজিত। এলপিজির ডিলার প্রায় ৩ হাজার, আমদানিকারী অপারেটর ২০টি এবং এলপিজি আমদানি টার্মিনাল রয়েছে ১৪টি।

উল্লেখ্য, দেশে এলপি সরবরাহের সিংহভাগই (প্রায় ৯৮ শতাংশ) মেটানো হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। বাংলাদেশ মূলত কাতার, সংযুক্ত আরব-আমিরাত এবং সৌদি আরব থেকে এলপিজি আমদানি করে থাকে।

জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের জন্য এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গণশুনানির আয়োজন করে থাকে। এ বছরের শুরুতে তেমনি এক গণশুনানির প্রাথমিক ধাপে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি এলপিজি কোম্পানি, ব্যক্তিমালিকানাধীন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড বিইআরসিতে এলপিজির মূল্যহার পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব দাখিল করেছিল। আরও দুটি বেসরকারি এলপিজি কোম্পানি কোনো প্রস্তাব পেশ করেনি। তারা লোয়াবের প্রস্তাবে অভিন্ন মত পোষণ করে পত্র দিয়েছে। অপর আরেকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন এলপিজি কোম্পানি কোনো প্রস্তাব না দিয়ে সৌদিভিত্তিক এলপিজি উৎপাদক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরামকো ঘোষিত এলপিজির মূল্যতালিকা পেশ করেছিল। প্রস্তাবে ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বা বোতলজাত গ্যাসে বেসরকারি সর্বোচ্চ ১০৬০ টাকা এবং সরকারি কোম্পানি কর্তৃক পেশকৃত সর্বনিম্ন মূল্য ৬০০-৭০০ টাকা বলা হয়েছিল। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা, জানুয়ারি ১৪, ২০২১)।

এই মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে, এর মানদণ্ড বা মাপকাঠিই বা কী হবে? বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি মূল্য নির্ধারণের একটি সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশমালার ৮ (১০) ক্রমে দেখা যায়, মোট ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের ইমপোর্ট প্যারিটি প্রাইস, অভ্যন্তরীণ পরিবহন, ডিলারদের মার্জিন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যেমন মজুত, বিপণন ও বিতরণ, সংশ্লিষ্ট অবচয় যেমন মজুত, বিপণন ও বিতরণ, আয়কর ও অন্যান্য মজুত, বিপণন ও বিতরণ সংশ্লিষ্ট কর অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বেসরকারি সরবরাহকারীদের সংগঠন লোয়াবের পেশকৃত মূল্যহারে অন্যান্য ব্যয়ের পাশাপাশি স্থায়ী ব্যয় উশুলকে ধরা হয়েছে। যা কারিগরি কমিটির মূল্যায়নে অবচয় খাতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা। বাংলাদেশে গৃহস্থালি জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ না দেয়া এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় এলপিজি সরবরাহকারী কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেডকে সীমিত পরিসরে রাখার (যারা মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহে সক্ষম) ফলে এলপি গ্যাসের বাজারে বেসরকারি উদ্যোগকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে ২৯টি কোম্পানি এলপি গ্যাস আমদানি, বিতরণ ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা চাহিদার ৯৮ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে এখানে প্রতিযোগিতা থাকার কথা কিন্তু দৃশ্যত তারা তাদের কার্টেল ও সিন্ডিকেট (যেমন লোয়াব) গঠন করে সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করে মুনাফা নিশ্চিত করে চলেছে।

শহরাঞ্চলের ভোক্তারা এখন ভীষণ অসহায়। লাকড়ি ব্যবহার করার উপায় নেই ফলে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু জ্বালানির মূল্য উৎসভেদে ভিন্ন থাকায় ভোক্তারা অসমনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারে ঢাকা শহরে দুই চুলার জন্য মাসিক স্থায়ী খরচ বর্তমানে ৯৫০ টাকা। কিন্তু যারা প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার করেন, তাদের খরচ যথেষ্ট কম।

ব্যবহারকারী পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, ১ হাজার টাকা রিচার্জ করলে গড়পড়তা ৫ জনের পরিবারে প্রায় দেড় মাসের বেশি চলে। মিটারবিহীন সংযোগে ভোক্তারা মাসে পরিশোধ করছেন ৯৫০ টাকা। পাইপ লাইনের গ্যাসের তবু হিসাব আছে, এলপি গ্যাসের ক্ষেত্রে খরচের সঠিক আন্দাজ করা দুরূহ। একদিকে এলপিজির বাজারমূল্য অস্থিতিশীল, যা এ মাসে ৯৫০ তো অন্য মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা। আবার ১২ কেজির বোতলজাত গ্যাসে কখনও কখনও ১ মাসও যায় না। সে ক্ষেত্রে এলপিজি ব্যবহারকারী মাসে গড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকার বেশি খরচ করে থাকে। শ্রমজীবীদের কথা তো বাদ, মাসে ৩০ হাজার টাকা উপার্জনকারীর যদি আয়ের ৫ থেকে ৬ শতাংশ জ্বালানির জন্য ব্যবহার করতে হয়, তাহলে সংসার চালানো যে কত কঠিন তা তারা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন।

উন্নত অনেক দেশ যেমন জাপানে প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালন লাইনের পাশাপাশি এলপিজি বিদ্যমান। কিন্তু আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণে বর্তমানে প্রাকৃতিক এবং এলপি গ্যাসের পরিবর্তে বিদ্যুতের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভারতে এলপিজি ব্যবহারকারী প্রতিটি পরিবার বছরে প্রথম ১২টি ১৪.২ কেজি ওজনের বোতল ভর্তুকিতে পেয়ে থাকে। কোনো পরিবার এর চেয়ে বেশি ব্যবহার করলে বাজারমূল্যে ব্যবহার করে থাকে। জাপানে এলপি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শীত-গ্রীষ্মে সঞ্চালনের প্রেশার পরীক্ষা করত রিফিলিং বা প্রতিস্থাপন নিজ দায়িত্ব করে থাকে।

এলপিজি গ্রাহক প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহকের মতোই মাসিক বিল পরিশোধ করেন। ভারতেও এলপি গ্যাস সরবরাহ এবং ব্যবহার বেশ সহজতর। সেখানে প্রথমত নিয়ম মেনে ব্যবহারকারীকে নিবন্ধন করতে হয়। গ্রাহক বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এলপি গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পেতে পারেন। যেমন, বিপণন এজেন্সি, অনলাইন অর্ডার, মোবাইল অ্যাপস, এসএমএস, আইভিআরএস বা ইন্টার-অ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ এ কথা বাংলাদেশের মতো আর কথাও হয়তো এত বেশি উচ্চারিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য খাতের মতো এলপি গ্যাস ব্যবহারকারী গ্রাহক ডিজিটাল সেবার তেমন কিছুই পান না। অনেক ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই জ্বালানি সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হয়।

অঞ্চলভেদে মূল্যের তারতম্য তো আছেই। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি সরবরাহকারী এলপি গ্যাস কোম্পানির সক্ষমতা মাত্র ২ শতাংশ বিধায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেটদের হিমশিম খেতে দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায় তারা যে মূল্যতালিকা ঝুলিয়ে দেন, তা কোথাও মানা হয় না। দোহাই সেই একটাই! সরবরাহ কম, তাড়াতাড়ি নিয়ে যান, পরে আরও বেশি দামে কিনতে হবে। ক্রেতারা আর কী করবেন? আরও দাম বাড়ার ভয়ে কিনে নিয়ে যান বাড়িতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাপারটা কি যৌক্তিক বা ন্যায্য হচ্ছে?

লেখক: রাজনীতিক, কলাম লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর