আজ ১৭ এপ্রিল, ২০২১। ১৯৭১ সালের এদিনে মেহেরপুরের এক নিভৃত গ্রাম বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। আজ সেই সরকারের শপথ গ্রহণের ৫০ বছরপূর্তি। ওই সরকার ১০ এপ্রিলে গঠিত হয়।
সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী একটি সরকার গঠনের খবর দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের অভ্যন্তরে যদিও পাকিস্তানের হানাদারবাহিনী গণহত্যা, দখলদারিত্ব, জনগণের ওপর বর্বরোচিত হামলা, অত্যাচার, নির্যাতন, পাশবিকতা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি চালিয়ে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করতে বাস্তবে দৃশ্যমান না হওয়ার জন্য সব কিছুই করছিল। কিন্তু জনগণের এরই মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘটনা ঘটতে থাকে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা আকস্মিকভাবে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যাচ্ছিল- কবে সরকার গঠিত হবে? ১০ এপ্রিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা দেশি-বিদেশি বেতার থেকে জানা গেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থ-শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ-পুনর্বাসন ও কৃষিমন্ত্রী এবং কর্নেল এমএজি ওসমানীকে সেনাবাহিনীর প্রধান করে একটি সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু যেহেতু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, তাই তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই দিন নবগঠিত এই সরকার স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্রও গ্রহণ করে।
এই সরকারের অংশগ্রহণকারী সকলেই ছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধি। সুতরাং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার দেশ-বিদেশে সকল মহলের সমর্থন লাভে আইনগত বৈধতা ছিল। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একত্রিত হয়েই এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১০ এপ্রিল সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতাকে বাস্তবের রূপ দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ভাষণটি ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হওয়ার পর যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের মধ্যে আনন্দের ঢেউ সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ তখন দেশের অভ্যন্তরে প্রস্তুতি গ্রহণ, একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য অনেকেই সীমান্ত অতিক্রম করতে থাকেন।
১০ তারিখের পর থেকে প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করতে শুরু করে। দায়িত্বগ্রহণকারী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য বিভিন্ন সেক্টর-সাবসেক্টর তৈরি করে, প্রশাসন, অর্থ, কূটনীতি ইত্যাদি জায়গায় উপদেষ্টা পরিষদ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সরকার কাঠামো গঠন করতে থাকে।
সরকার দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকদের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ প্রদান করেন। তবে সরকারের মধ্যে তখন যেকোনো দিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার মাধ্যমে শপথ নেয়ার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনের চিন্তা ক্রিয়াশীল ছিল। সেটি বাস্তবায়ন করা খুব সহজ কাজ ছিল না।
অত্যন্তে গোপনে এর স্থান নির্বাচন এবং সংক্ষিপ্ত আয়োজন সফলভাবে সমাপ্ত করার এক অনন্য নজির নতুন সরকার স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল।
১০ এপ্রিল সরকার গঠিত হওয়ার পর যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এলাকায় পাকিস্তানিদের আক্রমণ ও বোমাবর্ষণ বেড়ে যায়। সেই পরিস্থিতিতেও মেহেরপুরের নিভৃত একটি অঞ্চলকে সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনে নির্ধারণ করার দায়িত্ব যারা পালন করেন তাদের মধ্যে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ঝিনাইদহের এসডিও মাহবুব, মাগুরার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম, পাবনার প্রশাসক নুরুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন গোপনে স্থান নির্ধারণের কাজটি ১৫-১৬ তারিখ থেকে করতে থাকেন।
অপরদিকে ভারতের বিএসএফের লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী তৌফিক-ই-ইলাহীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তারা অবশেষে সীমান্ত নিকটবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামটিকেই সব ধরনের নিরাপত্তার বিবেচনা থেকে যোগ্য জায়গা বলে নির্বাচন করেন। পাকিস্তানি বাহিনী বোমাবর্ষণ করার জন্য কোনো উদ্যোগ নিলেও ভারতীয় সীমান্ত এলাকার কারণে তাদের বিমান নিরাপদে এই জায়গায় হামলা করতে পারবে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তেমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেখানে তৈরি করে।
অবশেষে ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা গ্রামের ঘন আমবাগানের পাশের মিশনারি হাসপাতাল থেকে চেয়ার টেবিল এনে মঞ্চ স্থাপন করা হয়। তবে রাষ্ট্রপতির চেয়ারটি খালি রেখে অন্য চেয়ারগুলো পদ অনুসারে বসানো হয়। সকাল ৯টা থেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ আসতে শুরু করেন। অবশেষে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা মঞ্চে আসীন হলে স্বাধীনতার শপথ পাঠ করান গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল নবগঠিত সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করবেন মেজর ওসমান চৌধুরী। কিন্তু তিনি সময়মতো এসে পৌঁছাতে না পারায় ঝিনাইদহের এসডিও মাহবুব উদ্দিন উপস্থিত আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
শপথ গ্রহণের পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একটি গুরত্বপূর্ণ ভাষণ ইংরেজিতে প্রদান করেন। এর মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বকে নতুন রাষ্ট্র ও সরকারের বক্তব্য জানিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ভাষণে কষ্ট স্বীকার করে যেসব দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানান।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীনের ভাষণ শেষে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা গগনবিদারী কণ্ঠে তোমার নেতা, আমার নেতা/ শেখ মুজিব, শেখ মুজিব বলে স্লোগান প্রদান করেন। এই স্লোগানের দৃশ্য এখনও ধারণকৃত ভিডিওর মাধ্যমে সবাই দেখতে পাচ্ছেন।
অবিশ্বাস্য সেই শপথ অনুষ্ঠান অনাড়ম্বর ছিল। কিন্তু ছিল নতুন রাষ্ট্র গঠনের এক দৃপ্ত শপথ উচ্চারণের নজিরবিহীন আবহ যা দেখে নতুন প্রজন্মের তরুণরা সেই সময়ের সরকার, মুক্তিযোদ্ধা এবং উপস্থিত জনতার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উৎসর্গকৃত চেহারা।
শপথ অনুষ্ঠানে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের দৃশ্য ধারণ এবং ছবি তোলার কাজটি তারা সাহসের সঙ্গেই করেছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই শপথ অনুষ্ঠান শেষ করে সরকারের নেতৃবৃন্দ নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন।
শপথ গ্রহণের স্থান ত্যাগের আগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। সেই থেকেই এই সরকারকে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তান সরকারের সব গোয়েন্দা তৎপরতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রথম সরকার বাংলাদেশের মাটিতেই স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠ, শপথ গ্রহণ এবং গার্ড অব অনার ও মুখরিত স্লোগান দিয়ে যুদ্ধরত মানুষকে যেমন উজ্জীবিত করতে সক্ষম হলেন একই সঙ্গে বিশ্বকেও নতুন সরকারের আইনগত কর্মকাণ্ডের দৃশ্য দেখাতে সক্ষম হলেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল নবগঠিত সরকার বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে শপথ নেয়ার মাধ্যমে এর যাত্রার নতুন পর্ব শুরু করে। তবে ১০ তারিখ থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের নৈতিক মনোবল দৃঢ়তর হয়। একই সঙ্গে নতুন সরকার সম্পর্কে জনগণ এবং বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ রাখেনি।
এই সরকার পরবর্তী সময়ে সকল প্রতিকূলতাকে মেধা, প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির ও নিষ্ঠার যে প্রমাণ দিয়েছিল সেটি বিশ্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। নয় মাসের এই মুক্তিযুদ্ধে সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানের জেলে বন্দি করে রাখার পরও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই তার অনুসারীরা যোগ্য নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনি একজন প্রাণপ্রিয় নেতা যাকে গোটা দল এবং জাতি এতটাই বিশ্বাস ও আস্থায় নিয়েছিল যা একটি মুক্তিযুদ্ধের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আয়োজনকে সফল করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। তিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরে আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজে যেমন হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রচিন্তক, একই সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন দলকে, আস্থাশীল এক ঝাঁক মেধাবি নেতৃত্বকে যারা তার যেকোনো নির্দেশনা, কর্মসূচি, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তাদের সেই সততা, দেশপ্রেম, মেধা ও যোগ্যতাও ছিল। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন গড়ে উঠেছিল তারা সবাই তখন সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য কাজকে সম্পন্ন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
পাকিস্তান সরকার ভেবেছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার এবং পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালানোর পর পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা অকার্যকর হয়ে পড়বে। কিন্তু তাদের ধারণা একেবারেই ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের প্রতি আস্থাশীল থেকেই তাদেরকে ২৫ মার্চ রাতে নেতৃবৃন্দকে তার ঘোষিত স্বাধীনতা অর্জন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সেটিই নেতৃবৃন্দ মনে রেখে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। সেখান থেকে একত্রিত হয়ে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নেয়।
জনগণ বঙ্গবন্ধু এবং তার দলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি আস্থাশীল ছিল। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ যত মূল্য দিয়েছিল তার কোনো পরিমাপ কেউ কখনও করতে পারবে না। মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে, সকল ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়েছে, এমন আত্মত্যাগ কোনো জাতি আপনাআপনি করে না। বঙ্গবন্ধু এবং তার নামে গঠিত সরকারের প্রতি অগাধ আস্থা ও ভালোবাসার কারণেই সবকিছু সম্ভব হয়েছে। ভারতসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের জনগণ ও সরকার বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত প্রথম সরকারকে উপেক্ষা করেনি বরং সর্বতভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থায় বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত সরকারের নেতৃত্বে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ভারত, ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করার পর পৃথিবীর আর কোনো ষড়যন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বমর্যাদায় নিজদেশে ফিরে এসেছেন। পৃথিবীর দেশসমূহ বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বপ্রদানকারী সরকার আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম সরকার। ১০ এপ্রিল থেকে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে স্বাধীনতার বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদাতা, সরকারপ্রধান হিসেবে ঢাকায় পদার্পণ করেন। এরপর গঠিত হয় নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সরকার। সেই সরকারেরও প্রধান তিনিই হন। তবে ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি গোটা জাতিকে নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখালেন; সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার যে সরকার গঠিত হলো তাতে তিনি স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তার আসন ছিল অনেক বড়।
১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানে তার সেই আসন শূন্য দেখালেও মানুষের প্রেরণাতে ছিলেন তিনি, সরকারের কর্মকাণ্ডেও ছিল তার চিন্তাধারার প্রতিফলন। সেকারণেই সরকার প্রতিদিন সংহত হয়েছিল, পাকিস্তান দুর্বল হতে হতে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। মুজিবনগর সরকার নামেই শুধু নয়, কাজে ও শক্তিতে কতটা সবল ছিল সেটি প্রমাণ করে দেখাল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছরেরও কম মেয়াদে থাকা সরকার বাংলাদেশ থেকে যা দিতে সক্ষম হয়েছে তার কোনো তুলনাই কোনো কালে হবে না। সেকারণেই মুজিবনগর সরকার চিরকালের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অসামান্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী গৌরবোজ্জ্বল সরকার। এই সরকারের কাছ থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা নিয়েই কেবল সমৃদ্ধ হওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি এই সরকারকে ভয় পায়, বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু মুজিবনগর সরকার দেশ ও জাতিকে সৃষ্টির সরকার। সুতরাং এর মূল উৎপাটন করার চেষ্টা করলে আখেরে নিজেকেই হেলে পড়তে হবে।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।