বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুজিবনগর সরকারের সুবর্ণজয়ন্তী

  •    
  • ১৭ এপ্রিল, ২০২১ ১০:৫৮

শপথ গ্রহণের স্থান চূড়ান্ত করার বিষয়ে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় ছিল- স্থানটি হতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় সমস্যা হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোটা ঘটনা নিজে তদারক করেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বেসামরিক পোশাকে বিএসএফ-এর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তারা সফল হয়।

পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর গণহত্যা শুরুর সপ্তাহ যেতে না যেতেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ্যে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় বাংলাদেশ টিকে থাকতেই এসেছে।

১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল মেহেরপুরের আমবাগানে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী প্রধান সেনাপতি।

শপথ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়, জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়, গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। বঙ্গভবনে আমরা এখন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যা দেখি, ১৭ এপ্রিল কোনো কিছু বাদ ছিল না।

শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) আর পি সিং। ১৯৬৯ সালে তিনি ভারতের সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসেবে যোগ দেন, অবসর নেন ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মেহেরপুরের আমবাগানে শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে। তার সঙ্গে ঢাকায় আমার কয়েকবার কথা হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, শিখ সম্প্রদায়ের সদস্য আমি। আমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী লম্বা চুল ও দাড়ি রাখতে হয়, পাগড়ি পরতে হয় এবং কৃপাণ থাকে সর্বক্ষণ। কিন্তু এ সব থাকলে তো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না।

পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা শিখ যুবকের ছবিও হয়ত পেয়ে যাবে এবং এটা দেখিয়ে প্রচার করবে- মুক্তিবাহিনীর নামে লড়াই করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি শিখ ধর্মের সব চিহ্ন বিসর্জন দেন। ক্লিন শেভড আর পি সিংকে কখনও দেখা যায় বাঙালি কৃষকের লুঙ্গি-গেঞ্জি পোশাকে, কখনওবা ছাত্রদের মতো প্যান্ট-শার্টে।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন আর পি সিংয়ের ওপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত হয়- বাংলাদেশের ১৩২ জন তরুণকে সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার ইন্সট্রাক্টর। এই দলে ছিলেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও ধানমন্ডির গৃহবন্দিদশা থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। বয়স কেবলই ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। পাকিস্তান আর্মি পাহারায় ছিল। কিন্তু কখন যে শেখ জামাল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে উধাও হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি অনেকে।

পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা দেবে না, এমন ধারণা থেকে ২০ মার্চ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ভারত কয়েকটি ইউনিট মোতায়েন করে। এর মধ্যে আর পি সিংয়ের ইউনিটও ছিল। তিনি বলেন, ৩০ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত থেকে খবর আসে, বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ও তরুণ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বানপুর সীমান্ত চৌকিতে খবর পাঠিয়েছেন যে, তারা ভারতে প্রবেশ করতে চান।

এ খবর পেয়ে বিএসএফ-এর আইজি গোলক মজুমদার নিজে গিয়ে তাদের স্বাগত জানিয়ে কলকাতা নিয়ে আসেন। নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দফতরেও এ খবর পৌঁছায় এবং তাদের দু’জনকে ১ এপ্রিল রাতে বিশেষ বিমানে গোপনে দিল্লি পাঠানো হয়। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশকে সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেন।

দিল্লি থেকে কলকাতা ফিরে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের একত্রিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেন। আলোচনার বিষয় ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন। বিএসএফ-এর রুস্তমজী ও গোলম মজুমদার এ কাজে তাকে সহায়তা করেন। ১১ এপ্রিল আমরা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আগে ধারণকৃত জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ শুনতে পাই। ভাষণটি ছিল উদ্দীপনা-অনুপ্রেরণায় পূর্ণ।

আর পি সিং বলেন, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম কুষ্টিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে শপথ গ্রহণের স্থান হিসেবে বৈদ্যনাথতলার নাম প্রস্তাব করেন।

শপথ গ্রহণের স্থান চূড়ান্ত করার বিষয়ে দুটি বিষয় বিশেষ বিবেচনায় ছিল- স্থানটি হতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় সমস্যা হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গোটা ঘটনা নিজে তদারক করেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বেসামরিক পোশাকে বিএসএফ-এর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তারা সফল হয়। তদুপরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকেও এ কাজে বেসামরিক পোশাকে যুক্ত করা হয়।

পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের চররা এ সময়ে পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গায় সক্রিয় ছিল। তিনদিন আগে তারা চুয়াডাঙ্গায় বোমাবর্ষণ করে। তাদের কাছে খবর ছিল- ওই মহকুমা শহরে শপথ অনুষ্ঠান হতে পারে। মেহেরপুরে ক্যাপ্টেন আর পিং সিংকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

আর পি সিং জানান, ১৫ এপ্রিল ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশনায় ভারতের সেনাবাহিনীর একটি দল আসে সীমান্ত এলাকায়। পরদিন প্রয়োজনে স্থলবাহিনীকে সহায়তা প্রদানের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী ও আর্টিলারির সহায়তার বিষয়টি আলোচনা হয়।

১৬ এপ্রিল মধ্য রাতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট মোতায়েন করা হয়। মুক্তিবাহিনী ও বিএসএফ সদস্যরা বৈদ্যনাথতলা ও আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করেন অতি গোপনে, কেউ তাদের উপস্থিতি বুঝতে পারেনি। আর পি সিং ভারতীয় এক গোয়েন্দা অফিসারের মোটর সাইকেলে নিরাপত্তার সার্বিক আয়োজন তদারকি করেন।

ভারতীয় বিমান বাহিনী ও আর্টিলারি অফিসাররা আশপাশের উঁচু ভবন ও বড় গাছে অবস্থান নিয়ে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। ওয়্যারলেস সেটগুলো ছিল সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয়। তবে এতে কেবল শত্রুর তথ্য আদান-প্রদানের খবরই ধরা পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। যেকোনো আকস্মিক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল তিনটি কুইক রিঅ্যাকশন টিম। তাদের হাতে পর্যাপ্ত যানবাহন ও অস্ত্র মজুদ ছিল। ভারতীয় বিমান বাহিনীর কমব্যাট এয়ার প্যাট্রোলও নিশ্চিত করা হয়।

সকাল থেকেই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতারা অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হতে শুরু করেন। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক আসেন কলকাতা থেকে। এ দলে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন-কর্মীরা ছিল। তারা কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে রওনা দেয়ার সময় কিংবা পথেও জানতেন না- কোথায় যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে বুঝতে পারেন- পেশাগত জীবনে রোমাঞ্চকর এক ঘটনার মুখোমুখি তারা, কেউ চাইলেই এমন সুযোগ জীবনে আসে না। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর উল্লেখ ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তেজোদীপ্ত ও উদ্দীপনাপূর্ণ ভাষণ দেন। যখন তিনি জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা...’ পরিবেশনের সময় লাল-সবুজ-সোনালি রঙের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত। সমস্বরে স্লোগান ওঠে ‘জয় বাংলা’।

বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, তা এভাবে বাস্তবে রূপ নেয়। শপথের স্থানটি পরিচিত হয় মুজিবনগর হিসেবে, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে- মুজিবনগর সরকার।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন সংবাদ সূত্রে গোটা বিশ্ব জেনে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ-এর ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণের সময় আরও বলেছিলেন- আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। বাস্তবে তিনি হুকুম দিয়েছিলেন এবং জনগণ সেটা অনুসরণ করে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে হারিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল।

মুজিবনগর সরকারের শপথের ঐতিহাসিক দিনটির আজ সুবর্ণজয়ন্তী। বাংলাদেশ চিরজীবী হবে, এ দিনটিও থাকবে প্রেরণা হয়ে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর