বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুভমেন্ট পাসের বিড়ম্বনা ও উল্টো কাণ্ড

  •    
  • ১৫ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:১০

রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশের কাছে কি মুভমেন্ট পাসের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই, নাকি কেউ কেউ দায়িত্ব পালনের নামে বাড়াবাড়ি করছেন? সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের ভেতরেও যেহেতু সব হাসপাতাল খোলা, সেখানে ডাক্তার-নার্সসহ হাসপাতালের যেকোনো কর্মীর বের হতে কেন মুভমেন্ট পাস লাগবে? বরং এটি তো এ রকম হওয়া উচিত যে, কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতালের কর্মীর যদি কর্মস্থলে পৌঁছাতে সমস্যা হয়, তাহলে পুলিশই তাকে পৌঁছে দেবে।

সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের প্রথমদিন বুধবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে একজন নারী ফেসবুক মেসেঞ্জারে জানতে চান, বৃহস্পতিবার তার করোনার টিকা নেয়ার সময় নির্ধারিত। হাসপাতালে যেতে তিনি মুভমেন্ট পাস সংগ্রহের জন্য প্রায় তিনঘণ্টা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তার প্রশ্ন, মুভমেন্ট পাস ছাড়া তিনি হাসপাতালে যেতে পারবেন কিনা? করোনার টিকা নেয়ার প্রমাণস্বরূপ তার হাতে হাসপাতালের কাগজ থাকলেও পুলিশ মুভমেন্ট পাস চাইবে কি না এবং না থাকলে জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে কিনা?

বাস্তবতা হলো, চিকিৎসক, হাসপাতালের কর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ এরকম জরুরি কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যে মুভমেন্ট পাস লাগবে না— সেটি পুলিশের তরফে আগেই জানানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও লকডাউনের প্রথম দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেক চিকিৎসককে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তাদের গাড়িকে মামলা দেয়া হয়েছে। অথচ তারা পুলিশকে তাদের পরিচয় দিয়েছেন। প্রমাণপত্র দেখিয়েছেন। কিন্তু তারপরও পুলিশ যেহেতু গাড়ির নামে মামলা দিয়েছে, অসদাচরণ করেছে, সে কারণে মোহাম্মদপুরের ওই নারীর শঙ্কা, টিকা নেয়ার বিষয়ে হাসপাতালের কাগজ থাকলেও পুলিশ তাকে হয়রানি করবে কিনা?

গণমাধ্যমের খবর বলছে, কঠোর বিধিনিষেধের এই সময়ে চিকিৎসকদের জন্য সরকারিভাবে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে চিকিৎসকরা ব্যক্তিগত গাড়ি বা সিএনজি অটোরিকশায় কর্মস্থলে যাওয়ার সময় পুলিশের জেরার মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিকিৎসক পরিচয় দেয়ার পরও কেউ কেউ মামলার শিকার হয়েছেন।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীর গেটে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। তিনি হাসপাতালের পরিচয়পত্র দেখান। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশ বলেন, ‘কসাইগিরি ফলাস, তোর কসাইগিরি বাইর করতেছি, লাথি দিয়া পা ভাইঙ্গা দিমু’। সত্যি হলে এটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একজন চিকিৎসকে প্রকাশ্যে এরকম অপমান করার অধিকার কারো নেই। প্রশ্ন হলো, ওই চিকিৎসক কি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন? যদি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ না-ও করেন, তারপরও যেহেতু এটা নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে, এই রিপোর্টের আলোকেই পুলিশের উচিত ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া। এটা পুলিশি রাষ্ট্র নয় যে, পুলিশ যা খুশি করবে বা যা খুশি বলবে।

কুর্মিটোলা হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক কৃষ্ণা হালদারও জানিয়েছেন, তার পরিচয় জানার পরও পুলিশ তার গাড়ির নামে মামলা দিয়েছে। সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে, গাড়িতে থাকা তার আইডি কার্ড ছুড়ে মেরেছে। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেও মুভমেন্ট পাস বের করতে পারিনি। তাহলে আমি কীভাবে কোভিড ডিউটি করব?’

প্রশ্ন হলো, একজন চিকিৎসককে কেন মুভমেন্ট পাস নিয়ে বের হতে হবে? তার পরিচয়পত্রই তো তার মুভমেন্ট পাস। পুলিশ কী করে একজন চিকিৎসকের পরিচয়পত্র ছুড়ে মারে? এই ঔদ্ধত্যের উৎস কী? কর্তৃপক্ষ কি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে? যদি অভিযোগ মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

এরকম অনেক চিকিৎসক লকডাউনের প্রথম দিনে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে এরকম পুলিশি হয়রানির কথা জানিয়েছেন— যা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক, লজ্জাজনক। চিকিৎসকরাই এখন এই অতিমারিকালে আমাদের আশার আলো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মানুষের সেবা করছেন। অথচ সেই মানুষগুলোকে পুলিশ রাস্তায় অপমান করবে, এটি মেনে নেয়া যায় না। সবগুলো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।

এখানে মূল প্রশ্ন হলো, রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশের কাছে কি মুভমেন্ট পাসের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই নাকি কেউ কেউ দায়িত্ব পালনের নামে বাড়াবাড়ি করছেন? সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের ভেতরেও যেহেতু সব হাসপাতাল খোলা, সেখানে ডাক্তার-নার্সসহ হাসপাতালের যেকোনো কর্মীর বের হতে কেন মুভমেন্ট পাস লাগবে? বরং এটি তো এরকম হওয়া উচিত যে, কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতালের কর্মীর যদি কর্মস্থলে পৌঁছাতে সমস্যা হয়, তাহলে পুলিশই তাকে পৌঁছে দেবে। দেশের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে মানুষের তো এটিই প্রত্যাশা হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখছি উল্টো। চিকিৎসকদের সহায়তার বদলে তারা হয়রানি করছেন— যা পুরো উদ্যোগটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সরকার করোনার প্রকোপ কমানোর জন্য সাধারণ ছুটি বা লকডাউন দিয়ে মানুষকে ঘরে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির কথা বিবেচনায় নিয়ে কিছু কলকারখানাও চালু রেখেছে। তাহলে এসব কারখানার শ্রমিকরা কীভাবে কর্মস্থলে যাবেন? তাদের আইডি কার্ডই তো মুভমেন্ট পাস হওয়ার কথা। তাছাড়া একবার পাস জোগাড় করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়।

পোশাক শ্রমিকদের সবাই তথ্যপ্রযুক্তিতে খুব সাবলীল নন। আবার একবার কেউ পাস নিলে দ্বিতীয়বার পাস পেতে বিড়ম্বনার মুখে পড়ছেন। পাসের মেয়াদ মাত্র তিন ঘণ্টা। তার মানে তিনি একবার পাস নিয়ে কর্মস্থলে গেলেন, বাসায় ফেরার পথে আবার পাস নিতে হবে? এটি কি বাস্তবসম্মত?

সবচেয়ে বড় কথা, মুভমেন্ট পাসের অ্যাপটাই ঠিকমতো কাজ করে না। ঈদের সময় ট্রেনের টিকিট কাটার সময় যেরকম সার্ভার ডাউন হয়ে যায়, সেই অবস্থা হয়েছে। ব্যাংক খুলে দেয়া হয়েছে। তাহলে ব্যাংকার কী করবেন?

পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ বলেছিলেন, ‘মুভমেন্ট পাস নিতেই হবে এমন নয়। আমরা কাউকে বাধ্য করছি না। এখানে আইনগত কোনো বিষয় নেই।’ প্রশ্ন হলো, যে জিনিসের আইনগত ভিত্তি নেই, পুলিশ সেটি জনগণকে মানতে বাধ্য করে কী করে এবং জরিমানা করে কীভাবে? জরিমানা তো আইনি বিষয়।

তার মানে, কোথাও যে কোনো সমন্বয় নেই—মুভমেন্ট পাসের ক্ষেত্রে তা-ই মনে হচ্ছে। কোন সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হবে, সেসব চিন্তা না করে জনগণের ওপর একটা জিনিস চাপিয়ে দিলেই হয় না। তাতে ভোগান্তি বাড়ে। সরকারের ভালো উদ্যোগও প্রশ্নের মুখে পড়ে। এবারের লকডাউন বা সাধারণ ছুটির পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এই মুভমেন্ট পাস। সুতরাং, মুভমেন্ট পাস নিয়ে সরকারের তরফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসা উচিত এবং এরকম একটি পদ্ধতি আদৌ চালু রাখার প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও ভেবে দেখা দরকার। যদি চালু রাখতেই হয়, তাহলে এর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা এবং মাঠপর্যায়ে পুলিশ যাতে এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে; চিকিৎসক-সাংবাদিক-ব্যাংকারসহ জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যে এই পাস লাগবে না এবং যেসব কারখানা চালু আছে, তাদের শ্রমিকদের চলাচলের পদ্ধতি কী হবে— সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আসা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর