এই তো মাত্র সেদিন, বাংলা একাডেমিতে গিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে। সেদিন মানে মোবাইল ফোন চেক করে দেখলাম দিনটি ৮ ফেব্রুয়ারি। আমরা তিনজন গিয়েছিলাম, বাকি দুজনের নাম উল্লেখ করছি না, তাঁরা জনকণ্ঠ ও প্রথম আলোয় আমার সাবেক সিনিয়র সহকর্মী। একটি পরামর্শের জন্য গিয়েছিলাম আপনার কাছে।
বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যানের কক্ষে আমরা চারজন অনেকক্ষণ আলোচনা করলাম। আপনি চা খাওয়ালেন। কিন্তু নিজের মুখ থেকে মাস্ক খুললেন না। আমরা মাস্ক খুললাম, বিস্কুট খেলাম, চা পান করলাম।
কাকতালীয়ভাবে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া আমরা তিনজনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলাম, তিনজনই সুস্থ হয়ে উঠেছি। এটা শুনে স্যার আমাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। প্রবীণ এই মানুষটি এক মুহূর্তের জন্য মাস্ক খুললেন না।
আলাপচারিতায় জানলাম, স্যারের মেয়েরা দেশের বাইরে থাকেন। বাসায় এখন ভাবি এবং তিনি। খুব সাবধানে আসেন বাংলা একাডেমিতে, তাও মাঝে মধ্যে। একাডেমির সভাপতির পদে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আগে যারা সভাপতি ছিলেন, তারা সর্বক্ষণিক একাডেমিতে বসতেন না। কিন্তু স্যারের জন্য আলাদা কক্ষ এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে সরকার। ওনাকেও বেশ খুশি মনে হলো।
আসলে শামসুজ্জামান খানের জীবনটা বাংলা একাডেমির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নয় বছরই (২০০৯ থেকে ২০১৮) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন, এরপর থেকে একাডেমির চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি জাতীয় জাদুঘর এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, পাশে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। ছবি: ফোকাস বাংলা
৮১ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন, তারপরও তার মাপের লেখক ও গবেষকের চলে যাওয়াটা বাঙালির জন্য বড় ধরনের ক্ষতি। রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব এবং মেধার সমন্বয় থাকা এমন মানুষ এই সমাজে আসলেই কম আছে। কেন যেন আরও অনেক কিছু পাওয়া বাকি ছিল ওনার কাছে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, নববর্ষ, ঈদসহ জাতীয় দিবসে সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্রে ওনার লেখা আর দেখা যাবে না।
আসলে স্যারের কাছে গিয়েছিলাম পরামর্শের জন্য। আমরা কজন একটি নতুন বাংলা দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগে সম্পৃক্ত হয়েছি। এরই অংশ হিসেবে ওনার পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম। পত্রিকার নাম শুনে খুশি হলেন। কারা আছি, কারা থাকব—সেসব শুনলেন। তিনি বেশকিছু পরামর্শ দিলেন। আশ্বস্ত করলেন, সব ধরনের সহায়তা করবেন।
দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজনের সঙ্গে আমরা দেখা করেছি এবং করছি। লক্ষ্য তাদের পরামর্শ, মতামত ও উপদেশ শোনা এবং নিজেদের সমৃদ্ধ করা। এরই অংশ হিসেবে গিয়েছিলাম স্যারের কাছে। অনেক দিন পর তার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা। শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখলাম সেই চিরচেনা চাপা হাসি আর নরম গলার মানুষটিকে।
তাকে ঘিরে অনুভূতিটা হচ্ছে, ভদ্র মানুষের চেহারা মানেই শামসুজ্জামান খান। নীতি–নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন— এমনটি শুনিনি কখনও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি এবং তাকে নিয়ে বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বক্তৃতায় তার এই সরাসরি শিক্ষকের সুনাম করেছেন। সদা হাসিখুশি এবং বিনয়ী শামসুজ্জামান খানের জন্য বেহেশত কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই।
লেখক: সাংবাদিক