বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি বাঙালি জাতির জন্য বরাবরই আনন্দের দিন। ১৭ বছর আগের এই দিনটি সমগ্র বিশ্বের সকল বাঙালির জন্য ছিল একটি গৌরবের দিন, আনন্দের দিন, স্মরণীয় দিন। ওই দিন বাঙালি জাতির মহান নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হন। আর এমন একসময়ে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বীকৃতি অর্জন করেন, যখন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মুজিবের নাম এই বাংলায় প্রায় মুছে ফেলে দিয়েছিল।
বাংলা ও বাঙালি জাতির এমন কঠিন ও দুঃসহ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। এটা ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক বিশাল আনন্দঘন পুরস্কার। ১৬ ডিসেম্বর যেমন বাঙালির জন্য বিজয়ের দিন, তেমনি বঙ্গাব্দ ১৪১১ সালের পয়লা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল, ২০০৪) দিনটি বিশ্বের সকল বাঙালির জন্য এক আনন্দঘন দিন।
২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ) দিনটি ছিল শুক্রবার। বিবিসি বাংলা বিভাগের বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের ভোটে বঙ্গবন্ধু ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালির তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা নববর্ষের প্রথমদিনে শীর্ষ ২০ জন বাঙালির মধ্যে এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম প্রচারিত হয়। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ওই অনুষ্ঠানটি বিবিসি প্রচার করে। ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের হাজার হাজার শ্রোতা চিঠি, ই-মেইল এবং ফ্যাক্সের মাধ্যমে তাদের মনোনয়ন পাঠায়। শ্রোতাদের মতামতের ভিত্তিতে বিবিসি তৈরি করে শীর্ষ ২০ জন বাঙালির তালিকা।
২৬ মার্চ ২০তম স্থান লাভকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম প্রথম প্রচারিত হয়। এরপর উনিশ নম্বরে জিয়াউর রহমান, আঠারো- অতীশ দীপঙ্কর, সতেরো- স্বামী বিবেকানন্দ, ষোলো- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পনেরো- বায়ান্নর ভাষা শহীদগণ, চৌদ্দ- ড. অমর্ত্য সেন, তেরো- সত্যজিৎ রায়, বারো- লালন শাহ, এগারো- মীর নিসার আলী তিতুমীর, দশ- রাজা রামমোহন রায়, নয়- মওলানা ভাসানী, আট- ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর, সাত- জগদীশচন্দ্র বসু, ছয়- বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, পাঁচ- সুভাষচন্দ্র বোস, চার- আবুল কাশেম ফজলুল হক, তিন- কাজী নজরুল ইসলাম এবং দুই নম্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম পর্যায়ক্রমে ঘোষণা করা হয়।
আগেই বলা হয়, ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) বিবিসি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির নাম ঘোষণা করবে। ১৩ এপ্রিল সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির শীর্ষ ২০ জনের মধ্যে দুই নম্বরে কবিগুরুর নাম প্রচারিত হওয়ার পর সবাই বুঝে যায়, এক নম্বরে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৪১১) শুক্রবার প্রভাতী অনুষ্ঠানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির নাম প্রচারের সময় বিবিসি মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। ভাষ্যকার বলেন, এবার শ্রোতাদের মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির নাম। রেকর্ডে ধারণকতৃ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর বাজানো হয়-
“এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘুরে দুর্গ গড়ে তোল।”
এরপর বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান যার বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশ করেছিল। এরপর আবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হয়-
“মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!” শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে কেন মনোনীত করেছেন- জবাবে জাপানের নাগাসাকি শহর থেকে একজন শ্রোতা মনিকা রশিদ বিবিসির অনুষ্ঠানে বলেন, “আজ আমরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যে যেখানেই বসে যা কিছু করছি, যা বলছি এর কোনোটাই সম্ভব হতো না যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে না পেতাম। তিনিই বাঙালি জাতিকে প্রথম বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলা ভাষা ও সংস্কতি- সর্বোপরি বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। মৃত্যুভয় বা ক্ষমতার লোভ কোনো কিছুই তার দীর্ঘ সংগ্রামী মনোভাবকে দমিয়ে দিতে পারেনি।”
বিবিসির সেদিনের প্রভাতী অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আতাউস সামাদ বলেন, “১৯৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিব তার নির্বাচনি প্রচারণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে মূল বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি সবখানেই ছয় দফার কথা বলতেন এবং ৬ দফা না হলে একটা আঙুল তুলে বলতেন আমার দাবি ‘এই’ অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করতে হবে।”
বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে তাদের পছন্দমতো ৫ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা পাঠাতে বলা হয়। বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের প্রাপ্ত তালিকার ভিত্তিতে বিবিসি বাংলা সার্ভিস লন্ডন থেকে ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা তৈরি করে। সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নাম প্রচারের সময় কেন এবং কী কারণে শ্রেষ্ঠ- এ সম্পর্কে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতামতও প্রকাশ করা হয়।
২৬ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বিবিসির এ অনুষ্ঠানের সামনে শ্রোতাদের উৎসুক ভিড় ছিল। সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ওপর তিনদিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে বিবিসি। বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সাবির মুস্তাফার তত্ত্বাবধানে পুরো জরিপটি পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ঘোষণার পর রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসির অনুষ্ঠানে বলেন, ‘তিনি সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং আপসহীন ছিলেন। যার অভাব আমাদের দেশের নেতৃত্বে আমরা বার বার দেখছি।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, তিনি বাঙালিকে একটি রাষ্ট্রীয় সত্তায় ঘোষিত করেছিলেন। কিসিঞ্জারের মন্তব্য ‘বঙ্গবন্ধু ডিফাইড হিস্ট্রি’র সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ড. কিসিঞ্জার বাঙালি আর বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না বলেই একথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার যে উদ্ভব সেটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুঘটক নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। কাজেই তিনি ইতিহাসকে দায়ী করেননি এবং ইতিহাসের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছেন।
অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বলা হতো অসম্ভবকে সম্ভব করা হলো, সেটা বঙ্গবন্ধু করেছেন এবং আমার মনে আছে কিসিঞ্জার তাকে যে ট্রিবিউটটা দেন, উই হ্যাভ ডিফাইড হিস্ট্রি, আমাদের ইতিহাসবিদদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এভাবে একটি রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠা হতে পারে না, কিন্তু তোমরা তা করে ফেললে।’
ফলাফল প্রচারের পর পর বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জরিপে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রোতা এবং বিশ্বের সকল বাঙালির প্রতি অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে বলেন-
“সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতির গৌরব বাঙালি জাতির। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে তার নিজস্ব ভাষা ছিল, কৃষ্টি ছিল, সংস্কতিৃ ছিল, ঐতিহ্য ছিল। ছিল না শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালিকে দিয়েছিলেন জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সার্থকতা। বঙ্গবন্ধু ধারণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্নকে। বাস্তবায়িত করেছেন তিতুমীর, সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ বসু, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীসহ মুক্তিকামী বাঙালির আকাঙ্ক্ষাকে। তার নেতৃত্বেই পরাধীনতার শিকল ভাঙে বাঙালি জাতি।”
গত চার দশকে বহুবার লিখেছি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনো রাজনীতিবিদের তুলনা হয় না। এই মহান নেতার মধ্যে যত রাজনৈতিক গুণাবলির সমাহার ছিল, বিশ্বের আর কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে এককভাবে এতো গুণাবলি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তার কি কোনো তুলনা হয়?
১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচনে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দেয়। বঙ্গবন্ধু একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেন, এর কোনো দ্বিতীয় নজির নেই।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে করতে না দেয়ায় বেতার-টিভি কর্মচারীরা বেতার ভবনে তালা লাগিয়ে দেয়। ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকা এলে বাঙালি বাবুর্চিরা রান্না করতে অস্বীকার করেন। সামরিক গভর্নর টিক্কা খানকে শপথ করাননি বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী। সামরিক শাসন বহাল থাকা অবস্থায় অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিন বঙ্গবন্ধুর কথায় পূর্ব বাংলা পরিচালিত হয়েছে। শত্রুর কামান-বন্দুক-মেশিনগানের মুখে ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে ৭ মার্চ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। ইতিহাস বলবে, ৭ মার্চের বক্তৃতাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং পাকিস্তানের ওয়ালী খান বলেছেন, মুজিবের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে বেশি সফল ছিল। নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মহান নেতা মুজিব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের বক্তৃতার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই। ১৯৮০ সালের ১৬ মার্চ এক সভায় তিনি বলেন, ‘যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, করতোয়া, কীর্তনখোলা নদীর দুই তীরের মানুষ বেঁচে থাকবে, যতদিন এদেশের মানুষের হৃদয়ে উত্তাপ থাকবে, ততদিন অন্তরের মণিকোঠায় একটি নাম চির জাগরূক থাকবে- শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।