বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বই ও বইমেলা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:৫৯

প্রায় পাঁচ শ’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় স্টল বরাদ্দ পান। এদের মধ্যে সিংহভাগই মৌসুমি প্রকাশক। সারা বছর বই নিয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এলেই এদের বই প্রকাশের তোড়জোড় বেড়ে যায়। একুশে গ্রন্থমেলাই হচ্ছে তাদের সারা বছরের অর্থ কামানোর একমাত্র অবলম্বন। কীভাবে তারা সে অর্থ কামান, সেটা কমবেশি সবাই জানেন।

শেষ হয়ে গেল বইমেলা ২০২১। এবারের বইমেলাকে অনেকেই বিষণ্ন, কষ্টের বইমেলা বলে অভিহিত করেছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই যদিও অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু করার রেওয়াজ, কিন্তু এবার তা হয়নি। করোনা পরিস্থিতিতে বইমেলা পিছিয়ে মার্চের ১৮ তারিখ থেকে শুরু হয়। করোনাকালে বইমেলার আয়োজন নিয়ে এবার পক্ষে-বিপক্ষে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন প্রকাশকরা। সময়টাও ছিল ভীষণ বৈরী। একে তো ফেব্রুয়ারির আমেজের অভাব, তার ওপর চৈত্রের তাপদাহ। সব মিলিয়ে প্রতিকূল পরিবেশেই এবার বইমেলা হয়েছে।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো বইমেলার সময়েই শুরু হয়ে যায় করোনার ভয়ংকর সংক্রামক দ্বিতীয় ঢেউ। যদিও দর্শনার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিধির প্রায় সব ব্যবস্থাই মেলা কর্তৃপক্ষ করে রেখেছিলেন। তবু দু’চারদিন বাদে প্রায় প্রতিদিনই মেলা প্রাঙ্গণ খাঁ খাঁ করেছে দর্শনার্থীদের অভাবে। মেলায় যতজন বিক্রয়কর্মী ছিলেন, বেশিরভাগ দিনে অতজন দর্শনার্থীও ছিলেন না।

মেলায় আসা প্রায় সব প্রকাশক যে টাকা খরচ করে স্টল করেছেন, বই বিক্রি করে সেই স্টল নির্মাণের খরচই তুলতে পারেননি। এর সঙ্গে রয়েছে স্টলের প্রতিদিনের নিয়মিত খরচ, স্টল ভাড়া, স্টলের কর্মীদের পাওনা। লাভ তো পরের কথা, এবার প্রকাশকদের কেবল লোকসান গুনতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে লোকসান দিয়ে কতদিন!

এমনিতেই আমরা বইবিমুখ জাতি। ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রকাশিত এনওপি ওয়ার্ল্ড কালচার স্কোর অনুসারে দুনিয়ার সবচেয়ে বই পড়ুয়া দেশ ভারত। ভারতে গড়ে একজন মানুষ এক সপ্তাহে বই পড়ায় ব্যয় করেন ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে যে কোথায়, সেটা না বলাই ভালো। নিজেদের দীনতার কথা যত কম বলা যায়।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে তবু মানুষ মেলায় যান। ঘুরে ঘুরে দু’চারটি বই কেনেন। কিন্তু গত একবছর ধরে করোনার থাবায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি। শিল্পকারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন নেই। চাকরি হারিয়েছেন অনেক মানুষ। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ। বই কেনায় সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। ওদিকে প্রতি বছরই আট-দশজন নতুন প্রকাশক যুক্ত হচ্ছেন অমর একুশে বইমেলায়। এবং মাত্র বিশ বছরের মধ্যে প্রকাশকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের মতো। বই ব্যবসা কি তাহলে লাভজনক?

প্রায় সব প্রকাশকই এর জবাবে বলবেন, না, বইব্যবসা লাভজনক নয়। যদি সেটা না-ই হয়, তবে বছর বছর এত প্রকাশক বাড়ে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যাও সে হারে বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সবাই কি তাহলে লোকসান দিতেই প্রকাশক হচ্ছেন? নতুন প্রকাশকরা কি লোকসান হবে জেনেও টাকা লগ্নি করছেন?

বাংলাদেশে ইচ্ছে করলেই যে কেউ প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করতে পারেন। কোনো বাধা নেই। কেবল সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স জোগাড় করতে পারলেই হলো। সেটাও অতো গুরুত্বপূর্ণ হতো না, যদি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল বরাদ্দে ওই লাইসেন্সের প্রয়োজন না পড়ত।

প্রায় পাঁচ শ’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় স্টল বরাদ্দ পান। এদের মধ্যে সিংহভাগই মৌসুমি প্রকাশক। সারা বছর বই নিয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এলেই এদের বই প্রকাশের তোড়জোড় বেড়ে যায়। একুশে গ্রন্থমেলাই হচ্ছে তাদের সারা বছরের অর্থ কামানোর একমাত্র অবলম্বন। কীভাবে তারা সে অর্থ কামান, সেটা কমবেশি সবাই জানেন। একটা হিসাব দেয়া যাক।

গত বছর মানে ২০২০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বই প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার। সব বইতে কি প্রকাশকের টাকা লগ্নি করা হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে তাহলে পাঁচ হাজার বইতে কত টাকা লগ্নি করা হয়েছিল? গড়ে প্রত্যেকটা বইতে যদি ৩০ হাজার টাকা করে খরচ হয়, তাহলে শুধু বই প্রকাশবাবদ লগ্নি করা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। মেলা উপলক্ষে এ টাকা লগ্নি হয় ঠিকই, কিন্তু এত লগ্নি করার মতো সামর্থ্য কি সব প্রকাশকের থাকে? থাকে না। তাহলে লগ্নি করা টাকাগুলো আসে কোত্থেকে?

করোনাকালে বইমেলায় এবার সমর্থন ছিল না অনেকেরই। তবু কেন হলো বইমেলা? স্বার্থটা কার? চেতনার ধুয়ো তুলে নিশ্চয়ই কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়াদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। তবু তাদের ইচ্ছেটাই পূরণ হলো। কিন্তু লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রায় সবাইকে। তাই বইমেলা নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় হয়েছে। ভাববার মতো অনেকগুলো বিষয় আছে।

ক. দীর্ঘ একমাস বইমেলা করার কি প্রয়োজন আছে? টানা একমাস বইমেলা করার বিপক্ষে এখন অনেকেই সোচ্চার হচ্ছেন। অনেক প্রকাশকের মতে, একমাসের জায়গায় মেলা দশ থেকে পনেরো দিনের করা ভালো। কলকাতা বইমেলার ব্যাপ্তি থাকে বড়জোর বারো দিন।

পৃথিবীর বিখ্যাত ফ্রাংকফুট বইমেলা হয় পাঁচ দিনের। ওসব মেলায় খামোখা ঘোরাফেরা করে সময় কাটানোর কোনো সুযোগ নেই। বইয়ের তালিকা নিয়ে এসে দর্শনার্থীরা মেলায় ঢোকেন এবং বই কিনে নিয়ে চলে যান। দীর্ঘমেয়াদি অমর একুশে বইমেলায় দর্শনার্থীরা মেলার অর্ধেক সময় ঘুরে ফিরেই কাটান। বই বিক্রি হয় মূলত পরের দশ বারো দিন। তাহলে প্রথম আঠারো-বিশ দিন শুধু শুধু মেলা রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ কি আছে? এতে অনেক কর্মঘণ্টা তো নষ্ট হয়-ই। আরও অনেক লোকসান গুণতে হয়।

বইমেলা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনেক রাষ্ট্রীয় সংস্থা যুক্ত থাকে। ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, নিরাপত্তাবাহিনী, বাংলা একাডেমি প্রভৃতি। একটা মাস কিছু মানুষের ঘোরাফেরার জন্য মেলার পিছনে এত সময় ও অর্থব্যয় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকাশকরাও অনেক খরচ থেকে রেহাই পাবেন। তাদের খরচও অর্ধেকে নেমে আসবে।

খ. মেলার জন্য একক স্থান নির্ধারণ করা দরকার। একসময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা হতো। এখন দু’ভাগ হয়েছে। কিছু বাংলা একাডেমিতে, সিংহভাগ বা মূল মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। পুরো মেলাটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হলে সবদিক থেকেই সাশ্রয়। দর্শনার্থীদের যেমন সময়ের সাশ্রয় হবে, তেমনি আয়োজকদের অন্যান্য খরচও সাশ্রয় হবে।

গ. অমর একুশে গ্রন্থমেলার সময়টায় একই সঙ্গে পুরো দেশে বইমেলা করা যেতে পারে। এতে দেশের বাকি অংশের পাঠককেও নতুন বইয়ের জন্য কিংবা বইমেলার আমেজের জন্য ঢাকামুখী হতে হবে না। নিজ নিজ জেলা শহরেই তারা বইমেলা পাবেন। ঢাকায় আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার যে খরচটা হবে, সেটা দিয়ে বরং আরও আটদশটি বই বেশি কিনতে পারবেন।

ঘ. বইমেলার প্রচার আরও বেশি হওয়া দরকার। প্রতিবছর বাংলা একাডেমি মানসম্পন্ন বইয়ের তালিকা করে। প্রয়োজনে বাংলা একাডেমির দৃষ্টিতে মানসম্পন্ন ওই বইগুলোর প্রচার-প্রচারণা করা হোক। এতে অনেক নতুন লেখক যেমন উঠে আসবেন, তেমনি বইয়ের বিক্রি এবং প্রসারও বাড়বে। বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার মর্যাদা আরও বাড়বে। লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করার ব্যাপারে আরও বেশি প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।

ঙ. কেবল বইমেলায় বই বিক্রি বা সরকারি সাপ্লাইয়ের আশায় না থেকে বইকে কীভাবে আরও সহজলভ্য করা যায়, সে বিষয়েও ভাবতে হবে। বইয়ের মার্কেটিংয়ে নতুনত্ব ও চমকপ্রদ কিছু আনতে হবে। এ কাজটা করতে পারে বইবিক্রেতা সমিতি। প্রয়োজনে মার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

চ. বইয়ের মান নিয়ে অনেক পাঠক সন্তুষ্ট নন। অনেক প্রকাশকও বলে থাকেন, ভালো মানের পাণ্ডুলিপি তারা পান না। যা পান তা-ই তাদের বাধ্য হয়ে ছাপতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা সমিতি সরকারের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে একটা একাডেমি গড়ে তুলতে পারেন। সে একাডেমিতে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করার জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ রাখা যায় লেখক, বানান সমন্বয়ক, প্রকাশক- সবার জন্য।

ছ. দুনিয়ায় খুব দেশেই আছে যেখানে সম্পাদনা ছাড়া বই প্রকাশিত হয়। বিশ্বের ৫ম বা ৬ষ্ঠ বৃহৎ ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষায় সুপরিকল্পিত সাহিত্যচর্চা হচ্ছে না। যে কারণে বিশ্ব সাহিত্য থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য। বই সম্পাদনাকে মাথায় রেখে, সম্পাদনা বিভাগ চালু করতে পারে বিক্রেতা সমিতি কিংবা বাংলা একাডেমি। প্রয়োজনে বইয়ের প্রচ্ছদে সিলমোহর দেওয়া থাকবে-বইটি বাংলা একাডেমি কিংবা বিক্রেতা সমিতির সম্পাদনা বিভাগ থেকে সম্পাদিত। তাহলে মানহীন বা রুচিহীন বই কিনে সাধারণ পাঠকের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। পাঠকও সুপাঠ্য বই পাবেন। সুপাঠ্য বইয়ের অভাবে কিন্তু অনেক পাঠকের বইয়ের প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। ঝরে পাওয়া পাঠকদের আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।

জ. কিছু প্রকাশক স্কুলে বইমেলা করছেন। কেউ এককভাবে। কেউ সম্মিলিতভাবে। স্কুলে বইমেলার সাড়া দেখেই বোঝা যায়, বইকে পাঠকের নাগালের মধ্যে আনতে পারলে বিক্রি ভালো হবে। স্কুলে বইমেলা নিয়েও আরও চমকপ্রদ কিছু করার সময় এসেছে।

ঝ. বইয়ের প্রকাশকরা যদি একটি একক প্লাটফর্মে আসতে পারেন, তাহলে সবার জন্যই উত্তম। বিক্রেতা সমিতির মাধ্যমেই এটি হতে পারে। সব প্রকাশক একটা অনলাইন প্লাটফর্ম করতে পারেন। যেখানে সব বই পাওয়া যাবে। ওই অনলাইনে সম্ভব হলে প্রত্যেকটা বই সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া থাকবে। পাঠক ওই তথ্য জেনে সে বইটি কিনতে উৎসাহী হবেন। ওই প্লাটফর্মের সঙ্গে লেখকরাও যুক্ত থাকবেন। তাহলে লেখকও জানতে পারবেন তার কয়টি বই বিক্রি হচ্ছে। একটি বই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে লেখকের অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার প্রাপ্য রয়্যালটি চলে যাবে। সরাসরি এই প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারলে এর সুফল লেখক-প্রকাশক সবাই পাবেন। পাঠকও তুলনামূলক কমদামে ভালো বই পাবেন। এমনিতেই লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে বই বিক্রির হিসাব নিয়ে অঘোষিত ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। এরকম অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি হলে ওই ভুল বোঝাবুঝিও থাকবে না।

বই ও বইমেলা নিয়ে আবেগে না ভেসে বাস্তবতাকে মাথায় নিয়ে এগোতে হবে। কারণ বইয়ের বিকল্প বই-ই। একসময় মানুষ বইমুখী হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যতই বলি বইবিমুখতার মূল কারণ প্রযুক্তি বা স্মার্টফোন- এটা কিন্তু সত্য নয়। পশ্চিমা বিশ্বে প্রযুক্তির এত ছড়াছড়ি সত্ত্বেও কিন্তু বইয়ের পাঠক কমেনি বরং বেড়েছে। হাতে ধরে বই পড়ার যে আনন্দ, যে দৃশ্যকল্পনা, সেটা কি স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে পাওয়া যায়?

কাজেই বই ও বইমেলা নিয়ে কি আমরা নতুন করে ভাবতে পারি না?

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর